অন্য আয়না
নারীর একলা জীবন ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি
সানজিদা শহীদ
প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
একার সংসারও একটা দারুণ সংসার হতে পারে। যৌথ পরিবার ভেঙে যেমন একক পরিবার তৈরি হয়েছে অনেক আগেই, তেমনি এখন হচ্ছে একার তৈরি সংসার। অনেকেই হয়তো চোখ কপালে তুলে বলবেন, একার আবার সংসার হয় নাকি? নানা কারণেই একজন নারী একা হতে পারেন, একা থাকতে চাইতে পারেন। নিতান্ত প্রয়োজনে, ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি হতে পারে একার সংসার।
হয়তো কেউ পরিবারের বড় মেয়ে বা ছেলে। অল্প বয়সে পরিবারের অভিভাবক বাবা কিংবা মা মারা যাওয়ার কারণে দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়েছে। এক সময় ছোট ভাইবোন মানুষ করে যে যার মতো সংসার গুছিয়ে নিয়েছে। শুধু বড় যে, তারই হয়তো আর বিয়ে নামক সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ওঠা হয়নি। এত বছর পর দেখা গেল দায়িত্ব পালন করতে করতে কখন যে শরীর স্থূলকায় হয়ে গিয়েছে, চুল কানের কাছে রুপালি রঙের হয়েছে, কেউই টের পায়নি। সারা জীবন হয়তো সে ভাবারই সময় পায়নি তার প্রিয় রং কোনটা বা একটা সুন্দর শাড়ি পরলে তাকে কেমন দেখায়। হয়তো সে বুঝতেই পারেনি, তার প্রিয় খাবার বা গান কোনটা? রাস্তার ধারে বা পার্কে দাঁড়িয়ে ফুচকা-চটপটি খাওয়ার সময়, সামর্থ্য বা বিলাসিতা কোনোটাই হয়তো তার এত বছরে হয়নি। সেও শখ করে একটা সংসার শুরু করে এই পড়ন্ত বেলায়, মনের অজান্তে। সেই সংসার-একার সংসার। সকালে ঘুম থেকে উঠে ঝালর দেওয়া বালিশ গোছায়, বিছানার চাদর টানটান করে। নরম রোদের আলোয় পত্রিকা নিয়ে বসে। ছুটির দিনে খুব ভোরে উঠে বাজারে গিয়ে দরদাম করে লাল ফুলকোওয়ালা তাজা মাছ, একটা বড় দেশি মোরগ, একমুঠো তরতাজা লাউশাক, একটা নারিকেল-আরও কত কী বাজার করে নিয়ে আসে। সেদিন নিজের জন্যই বেশি করে কিশমিশ দিয়ে পোলাও, বড় আলু দিয়ে মাংসের ঝোল রান্না করে। বিকালে হয়তো প্রিয় কোনো লেখকের বই কিংবা সেলাই অথবা কোনো প্রিয় সিনেমা দেখা। এ সময় এক কাপ ঘন দুধের চায়ে ঘিয়ে ভাজা টোস্ট ডুবিয়ে খেতে খেতে মনে হয়-জীবন নেহাত মন্দ না।
কারও হয়তো স্বল্প বা দীর্ঘ সুখী দাম্পত্য সংসার। হুট করে একজনকে একা করে দিয়ে আরেকজন চলে গিয়েছেন ‘মৃত্যু’ নামক শান্তিময় জায়গায়। দিনরাত, পুরো ঘরময় একজন মানুষের ঘ্রাণ, স্মৃতিতে মাখামাখি। একজন সঙ্গী হয়তো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, বাকিটা পথ তিনি মৃত সঙ্গীর স্মৃতি নিয়ে একাই সংসার করবেন। হয়তো দেখা যায় কোনো এক ঝুম বৃষ্টির রাতে তাকে এক কাপ চা হাতে তার ইজিচেয়ারে আধাশোয়া হয়ে স্মৃতিচারণ করতে। কিংবা টেবিলল্যাম্পের মৃদু আলোয় তাদের বিয়ের অ্যালবাম আবার উলটেপালটে দেখতে। হয়তো এ সময় গান বাজবে মৃদু স্বরে-শাওন রাতে যদি, মনে পড়ে মোরে প্রিয়...। জীবন নামের এই ছোট এক যাত্রায় হয়তো সে একার সংসার নিয়েই দারুণ খুশি, পরিতৃপ্ত।
হয়তো কেউ প্রেম করে ঘর বেঁধেছিল কিংবা বাসা থেকেই বিয়েটা দিয়েছিল। বিয়ের পরের মানুষটাকে কোনোভাবেই পারেনি সংসারমুখী করতে, সম্পর্কের প্রতি যত্নশীল হওয়া শেখাতে। দিন দিন তাদের সেই দূরত্ব বেড়েই চলেছে, তিক্ততায় পৌঁছে এক সময় দুজন বোঝাপড়া করে আলাদা হয়ে গিয়েছে। মেয়ে সঙ্গী চায়নি নতুন করে আর কারও সঙ্গে ঘর বাঁধতে। পুরোনো ক্ষত আর বাড়তে না দিয়ে সে একাই হয়তো শরতের স্নিগ্ধ আকাশ আর জারুল ফুল দেখার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। শেষ বিকেলের আলোয় বারান্দায় থাকা ফুলগাছগুলোয় পানি দিয়ে একটা ফুল ছিঁড়ে খোঁপায় গুঁজে, একা একাই হয়তো স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলে ওঠে-‘হেঁটে গেছ বহুবার,
দেখনি কীভাবে রোজ সন্ধ্যে ঘনায়।
হাত নেড়ে সাইকেলের ডাক বলে-
যে যাওয়ার সে যাক চলে,
নিজেকে ভালোবাসো তুমি আবার।’
