আমার জীবনে অপ্রাপ্তি বলে কিছু নেই : সুবীর নন্দী
সুবীর নন্দী। সঙ্গীত জগতে নামেই যার পরিচিতি। আধুনিক বাংলা গানের জনপ্রিয় এ কণ্ঠশিল্পী ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে গান গেয়েছেন আড়াই হাজারেরও বেশি। বেতার থেকে টেলিভিশন, তারপর চলচ্চিত্রে। একের পর এক সুরের মায়া ছড়িয়েছেন সঙ্গীত জগতে। গানের পাশাপাশি দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন ব্যাংকে। আধুনিক সঙ্গীতের পাশাপাশি গেয়েছেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, ভজন, কীর্তন এবং পল্লীগীতিও। এত গানের মাঝেও নজরুল সঙ্গীতের প্রতি অন্যরকম ভালোলাগা রয়েছে তার। তাই সেটি পূর্ণতা দিতেই সম্প্রতি নজরুল সঙ্গীতের অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন তিনি। সঙ্গীত জীবনের নানা গল্প নিয়ে সম্প্রতি যুগান্তরের সঙ্গে আড্ডায় জীবনের নানা গল্প ভাগাভাগি করে নেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন - সাদিয়া ন্যান্সী
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী সুবীর নন্দী
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শৈশবকালের কাটানো দিনগুলো কেমন ছিল আপনার?
আমার জন্ম ১৯ নভেম্বর ১৯৫৩ সালে সিলেটের হবিগঞ্জ হোকুমার তেলিয়াপাড়া চা বাগানে। স্বাধীনতার পর যেটি হল হবিগঞ্জ জেলা। আমার বাবা সুধাংশু নন্দী তখনকার একজন মেডিকেল অফিসার ছিলেন। বাবার চাকরিসূত্রে আমার শৈশবকাল চা বাগানেই কেটেছে। পাঁচ-ছয় বছর বয়স পর্যন্ত বাগানেই ছিলাম। সেখানের একটি স্কুলেই আমার প্রথম হাতেখড়ি। তবে পড়াশোনার অধিকাংশ সময়ই কেটেছে হবিগঞ্জ শহরে।
গানের যাত্রা কীভাবে?
আমার মা পুতুল রানী খুবই চমৎকার গান করতেন। কিন্তু পেশাদারি সঙ্গীতে আসেননি কখনও। আমার সঙ্গীতে হাতেখড়ি ঘটে মায়ের কাছেই। তখন আমার বয়স ৭-৮ বছর। বড় ভাইকে দেখতাম ওস্তাদের কাছে গান শিখতেন। মাকে বললাম আমিও ওস্তাদের কাছে গান শিখব। মা বললেন, এখন তুমি আমার কাছেই শেখ। আরেকটু বড় হও তারপর ওস্তাদের কছে শিখবে। ভাই তপন কুমার নন্দীর কাছ থেকেও আমি এ বিষয়ে তালিম নিয়েছি। এর আগে যখন জগদীশপুর হাইস্কুলে ছিলাম তখন স্কুলেও গান করেছি। তা ছাড়া ভাইবোনের সঙ্গে দীর্ঘদিন প্রয়াত ওস্তাদ বাবর আলী খান সাহেবের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নেয়া হয়। ওস্তাদ বাবর আলী খানের কাছেই আমার সঙ্গীতের হাতেখড়ি হয়।
তাহলে কি ভাইবোনদের দেখেই গানের প্রতি ভালোলাগা?
তা তো একটা বিষয় ছিলই। তা ছাড়া বাবার সংগ্রহে প্রচুর রেকর্ড ছিল। প্রায় হাজারখানেক ক্যাসেটের গ্রামোফোন রেকর্ডের একটা তাক ছিল। এগুলোই আমাকে গান করতে আগ্রহী করেছে। ওই সময়ে যারা ভালো গাইতেন যেমন লতা মুঙ্গেশকর, তাদের গান বাবা বেশি শুনতেন, বাংলা গান খুব বেশি শুনতেন। যেমন আঙুর বালা, কমলা এ রকম অনেক কালেকশন ছিল। আমার মামাবাড়িতেও গানবাজনা হতো। মামা ভালো গাইতে পারতেন। মূলত পরিবারের সবাইকে দেখেই ভালোলাগা তৈরি হয়।
আনুষ্ঠানিকভাবে সঙ্গীত জগতে প্রবেশের গল্প কেমন ছিল?
১৯৬৪ সাল থেকে আমার ঢাকায় আসা শুরু। জীবনের প্রথম গান রেকর্ড করেছিলাম ১৯৬৭ সালে রেডিওতে। পেশাগতভাবে সঙ্গীতে আসা হয় সত্তরের দশকে। আমার প্রথম প্লে-ব্যাক রাজা হোসেন খান ও সুজেয় শ্যামের (রাজা শ্যাম) সঙ্গীত পরিচালনায় আবদুস সামাদ পরিচালিত ‘সূর্য গ্রহণ’ ছবিতে ১৯৭৪ সালে। এর আগে ১৯৭২ সালে প্রথম ঢাকা রেডিওতে লাইভ অনুষ্ঠানে গান করেছিলাম।
আজকের সুবির নন্দী হয়ে ওঠার পেছনে বড় অবদান কার?
এটা আসলে একজনকে আলাদা করে বলা কঠিন। কারণ পরিবারে মায়ের বাইরেও অনেকের কাছে গানের তালিম নিয়েছি। ওস্তাদ ছিলেন। স্কুলে গান করতে কেউ কেউ শিখিয়েছেন। একজনের অবদানে আজকের আমি হয়ে উঠিনি।
দীর্ঘদিন চাকরিতে ছিলেন, কোনটিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন গান নাকি চাকরি?
দীর্ঘদিন জনতা ব্যাংকে কর্মরত ছিলাম। এখন অবসরপ্রাপ্ত। দুটি বিষয় তো পুরোপুরি ভিন্ন। গানের পাশাপাশি একটি ব্যাংকে প্রায় ৪৫ বছর চাকরিতে ছিলাম। তবে চাকরির থেকে গানই আমার কাছে বেশি প্রিয়। সঙ্গীতের মাধ্যমে যেমন একজন শিল্পীর পরিপূর্ণ আত্মতৃপ্তি ঘটে। নিজেকে প্রকাশের জায়গা থাকে। যেটি চাকরিতে থাকে না।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন অনেকবার, এমন প্রাপ্তি কেমন লাগে?
কোনো কিছুর প্রাপ্তি তো সবসময় অনেক আনন্দের। তবে পুরস্কার পেয়েছি সেটি ভাবতেই মাথায় চলে আসে দায়িত্বের কথা। তখন মনে হয় পুরস্কার বা স্বীকৃতি আনন্দের চেয়ে দায়িত্ব বাড়িয়ে দেয়। এখানের স্বীকৃতি মানে হচ্ছে মনে করিয়ে দেয়া তোমার আরও অনেক কিছু করার আছে। তোমার কাছে দেশ ও জাতি আরও ভালো কিছু আশা করে।
জীবনের প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন কবে? সে দিনের অনুভূতি কেমন ছিল?
ভক্তদের আশীর্বাদে ৫০ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে প্রায় আড়াই হাজারেরও বেশি গান গাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তবে ছোটবেলায় কচি-কাঁচার মেলা করতাম। উৎপল সেনের একটি গান ‘ময়ূরপঙ্খী ভেসে যায়, রামধনু জ্বলে তার গায়...’ গানটি লিখেছিলেন পবিত্র মিত্র। স্কুলে এটি গেয়ে জীবনে প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলাম একটি ছড়ার বই। সে অনুভূতি বলে বোঝানোর নয়।
সঙ্গীত জীবনে কোন শিল্পীর গান আপনাকে বেশি প্রভাবিত করেছে?
নিজের অজান্তেই ছোটবেলা থেকে গান শুনতে শুনতে উপমহাদেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী পঙ্কজ মলিক, সায়গল, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, জগজিৎ সিং প্রমুখের অনুরক্ত ভক্তে পরিণত হয়েছিলাম। তাদের গান এখনও আমি শুনি যা তখন আমাকে প্রভাবিত করেছে।
আপনার গাওয়া গানগুলোর মধ্যে নিজের সবচেয়ে পছন্দের গান কোনটি?
আমার গাওয়া সব গানই আমার কাছে সন্তানের মতো। কোনটি ভালো আর কোনটি মন্দ বলা মুশকিল। তবে তার মধ্যে কিছু গান আছে যেটি সমসময় শিল্পী মনকে নাড়া দেয়। পাখি রে তুই দূরে থাকলে’, চাঁদের কলঙ্ক, আমার দু’চোখে অনন্ত মেঘ, এই গানগুলো আমাকে ছুঁয়ে যায়।
সঙ্গীত জীবনের ৫০ বছরের বেশি সময় পাড়ি দেয়ার অনুভূতি কেমন?
৫০ বছর ধরে শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা প্রকাশ করছি গান পাগল মানুষদের প্রতি। যাদের ভালোবাসা না পেলে ৫০ বছর গানবাজনা করা সম্ভব হতো না। তবে সময় খুব দ্রুত চলে গেছে মনে হয়।
সঙ্গীতের দীর্ঘ পথচলায় শ্রোতাদের প্রত্যাশা কতটা পূরণ করতে পেরেছেন বলে মনে করেন?
প্রত্যাশা শেষ হওয়ার নয়। চেষ্টা করেছি পূরণ করার। কিছুটা হয়তো সফল হয়েছি বলে এখনও গান গাইতে পারছি। আমার অনেক গান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অনেক বছর পর মানুষ তা মনেও রেখেছে। সার্বিক দিক থেকে মনে হয় কিছুটা হলেও প্রত্যাশা পূরণের জন্যই আমাকে জাতীয় পুরস্কারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
প্লে-ব্যাকে আপনাকে একদমই দেখা যায় না। এর কারণ কী?
এখন বেশিরভাগ চলচ্চিত্রে নতুন নতুন সঙ্গীত পরিচালক কাজ করছেন। নতুন শিল্পীদের সঙ্গে বেশি কাজ করছেন তারা। এ কারণে চলচ্চিত্রের গানে দেখা যায় না। তা ছাড়া আমি মনে করি চলচ্চিত্র ছাড়াও একজন শিল্পীর গান গাওয়ার অনেক জায়গা আছে।
আমাদের দেশের শিল্পীরা শেষ জীবনে অর্থকষ্টে ভোগেন, এটার কারণ কী মনে করেন?
বিভিন্ন পেশার লোক নানা উপায়ে তাদের কাজের যোগ্য পারিশ্রমিক আদায় করে নেন। এজন্য তারা সংগঠিত। আমরা শিল্পীরা নিজেদের পাওনা আদায়ে মনোযোগী নই। নিজেদের অধিকার সম্পর্কে আমরা সচেতন নই। শিল্পীদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিজেদেরও ভাবতে হবে। পাশাপাশি দেশেরও শিল্পীদের প্রতি কিছু দায়িত্ব রয়ে যায়।
আপনার জনপ্রিয় গানগুলো সংরক্ষণের কথা কিছু ভাবছেন?
সেটা আমি ভাবার দরকার মনে করছি না। কারণ আমার গানগুলো সংরক্ষণের জন্য আমার ভক্তরা আছেন। আমার কাছে যেটুকু থাকা দরকার তা আমার সংরক্ষণ করা আছে।
ক্যারিয়ারে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব করেছেন কখনও?
অপ্রাপ্তি বলে আমার জীবনে কিচ্ছু নেই। ঈশ্বর আমাকে যা দিয়েছেন তা অনেক। সবার ভালোবাসা কাজের স্বীকৃতি জীবনে সব পেয়েছি। এমনকি পারিবারিক দিক দিয়েও আমি অনেক সুখী মানুষ। সে হিসেবে প্রাপ্তির পাল্লাই জুড়ে আছে সবটা।
সঙ্গীত নিয়ে সামনের দিনগুলো কীভাবে কাটাবেন?
নতুন প্রজন্মের শিল্পীরাও আমার সঙ্গে কাজ করতে অনেক আগ্রহী। যা আমাকে আরও অনেক দিন কাজ করার তাগিদ দেয়। তা ছাড়া আমার কাছ থেকে দেশ আরও কিছু প্রত্যাশা করে। তাই সামনের দিনগুলোতে আরও ভালো ভালো গান করে যেতে চাই।
