অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় বাঙলা উপেক্ষিত
হাসান সাইদুল
প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গণমাধ্যমকে চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। ইলেক্ট্রনিক ও মুদ্রণ মাধ্যম- এ দুই ধরনের গণমাধ্যম বিশ্বের প্রায় সব দেশেই চালু আছে। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এক সময় ‘সংবাদপত্র’ই ছিল গণযোগাযোগের মাধ্যম। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে এখন আর কেবল ‘প্রিন্ট মিডিয়া’ বা কাগজে ছাপা সংবাদপত্রই গণযোগাযোগের মাধ্যম নয়। সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট এমনকি কোটি কোটি মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহৃত হাতের সেলফোনটিও এখন গণযোগাযোগের মাধ্যম। অবশ্য তথ্যপ্রযুক্তি আবিষ্কারের আগে সিনেমা এবং তথ্যচিত্রও অংশত গণমাধ্যম হয়ে উঠেছিল। তবে সিনেমা ছিল মূলত বিনোদনের মাধ্যম। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংবিধানস্বীকৃত। কখনও কখনও মন খুলে, স্বাধীন ও নির্ভয়ে প্রকাশের পরিবেশ অনুপস্থিত থাকে। তবুও গণমাধ্যমের থেমে নেই তার অসংকোচ প্রকাশের পথচলা। যদিও বিভিন্ন সময় অদৃশ্য কোনো কালো পর্দায় ঢাকা পড়ে গণমাধ্যমের খোলা জানালা।
গণমাধ্যম তথা পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন কিংবা বেতার শুধু খবর জানা বা খবর প্রকাশের মাধ্যম নয় বরং শিক্ষা এবং বিনোদনের মাধ্যম। প্রযুক্তির এ স্বর্ণযুগে মানুষ প্রযুক্তির যত সুবিধা ভোগ করছে তার চেয়ে বেশি অপব্যবহার করছে প্রযুক্তির। প্রযুক্তিগত যত সুবিধা-অসুবিধা রয়েছে তার মধ্যে মানুষের ভাষার অপব্যবহার সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে এখন পাঠ্যপুস্তক এবং সাহিত্য রচনার জন্য প্রমিত রীতিই সর্বজনগ্রাহ্য ভাষা। সবরকম আনুষ্ঠানিক পরিস্থিতি যেমন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান; রেডিও-টেলিভিশনে সংবাদ পাঠ; গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা অনুষ্ঠান; উপস্থাপনা, ঘোষণা, ইত্যাদির ভাষাও হওয়া উচিত প্রমিত রীতির। ঘাটতিটা এসব ক্ষেত্রে দুঃখজনক রকম। উচ্চারণত্রুটি অতি মারাত্মক কোথাও কোথাও। আমাদের দেশে ভাষাকে ব্যঙ্গ করা, বিকৃত করে উচ্চারণ করা, সেই সঙ্গে দর্শক-শ্রোতাদের হাসানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে বাংলা এবং বিদেশি ভাষার মিশ্রণে আমাদের ভাষাকে দূষিত করছে অনেক গণমাধ্যম কর্মী।
ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে বিজ্ঞাপন চিত্র, অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, খবরসহ সব অনুষ্ঠানে বাংলা ব্যবহারের স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা উচিত। একশ্রেণীর উপস্থাপক অযথাই বাংলা-ইংরেজি চটকিয়ে এমন এক অদ্ভুত ভাষার জন্ম দেন যা রীতিমতো কানের জন্য ক্ষতিকর। উপস্থাপনার শুরু কিংবা শেষ অথবা মধ্যম ভাগ মূল কথা, আধাঘণ্টার একটা অনুষ্ঠানে একজন উপস্থাপক কতটা শব্দ বাংলা ভাষায় কথা বলেন, আর কতটা বিদেশি শব্দ উচ্চারণ করেন তাই দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইংরেজি শব্দ অথবা ইংরেজি-বাংলা মিলিয়ে শব্দ উচ্চারণ একদিকে যেমন ভাষার অপব্যবহার; অন্যদিকে শব্দ দূষণ বলা যায়। তারা মুখের ভেতর বাংলা-ইংরেজির মুড়ি-ঝাঁকানির মাধ্যমে এমন সব বাক্যবমি করেন যা দুর্গন্ধ ছড়ায়।
রান্নাবিষয়ক অনুষ্ঠান দেখলে মনে হয়, আমাদের খাবারের তালিকা থেকে পেঁয়াজ, রসুন, আদা ইত্যাদি শব্দ তো উঠেই গেছে, আমরা খাচ্ছি আনিয়ন, গার্লিক, জিনজার, পিপার ইত্যাদি। তাছাড়া নতুন উৎপাত যোগ হয়েছে ক্রিকেট টকশো বা খেলার সংবাদে প্রচুর ইংরেজি শব্দের ব্যবহার। খেলার মাঠের বাংলা ধারাভাষ্যের দারুণসব গরম গরম শব্দ আজকাল আর শোনাই যায় না; সোজা ব্যাট-ঘূর্ণিবল-সীমানা ছাড়া-দূরপাল্লার শট-বোঝাপড়া- এরকম আরও বহু চালু বাংলা প্রতিশব্দ খেলার ভাষ্য থেকে হারিয়ে গেছে কেবল আধুনিক উপস্থাপনার দোষে।
বেসরকারি গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন, আইন আদেশ দিয়ে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন ও বাংলা ভাষার অবক্ষয় রোধ সম্ভব নয়। এটি বাঙালিকে মন থেকে নিতে হবে। অন্তর থেকে ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা না এলে সর্বস্তরে এর প্রচলন খুবই দুরূহ। যে ভাষা মানুষের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে, বিশ্বদরবারে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, সেই ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বাড়াতে হবে। তাহলেই সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন ও ভাষার অবক্ষয় রোধ সম্ভব হবে। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্টে একটি রিট করেন আইনজীবী ড. ইউনুস আলী আকন্দ। ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে একই বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭ অনুযায়ী অফিস-আদালত, গণমাধ্যমসহ সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ কেন দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে একটি রুল জারি করেন। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বিজ্ঞাপন বাংলায় লেখা ও প্রচলনের নির্দেশ দেন।
সব বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করে বাংলা ভাষার বিকৃতি চলছেই সেই সঙ্গে টেলিভিশন এবং রেডিওতে উপস্থাপকরা দেদার ব্যবহার করছে বিদেশি শব্দ। কিছু টেলিভিশনে চোখ রাখলে বোঝা যাবে বাংলাদেশি কেউ উপস্থাপনা করছে নাকি বিদেশি? নাটক-সিনেমা এমনকি টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনে বাংলা ভাষাকে করা হচ্ছে উপেক্ষা। সেই সঙ্গে ইংরেজি আধিক্যে হারাচ্ছে বাংলা ভাষার জৌলুস। শিক্ষিত মেধাবীরাই অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন বলে অনেকের ধারণা। কথিত এসব মেধাবীই ক্যামেরার সামনে বিশ্বদরবারে বাংলা ভাষার আগে-পেছনে করছে বিদেশি ভাষার ব্যবহার। তারা হয়তো ভুলে যাচ্ছেন রাষ্ট্র এবং মাতৃভাষা বাংলার ইতিকথা।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘এখন পড়ার সংস্কৃতির খুবই অভাব। আমরা এখন আর পড়ছি না, বাচ্চাদের পড়তে শেখাচ্ছি না, দেখতে শেখাচ্ছি। এফএম রেডিও বা টিভিতে যেটি দেখাচ্ছি, শোনাচ্ছি, সেটিই অনুকরণ করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ক্রমাগত অনুকরণ করতে শিখছি, নকল করে চলেছি। যে জাতি অনুকরণ-নকল করে চলে সে জাতির মৌলিকতা বাড়ে না। তাই পরিবার, শিক্ষাঙ্গন, মিডিয়া, সমাজ ও ব্যক্তির নিজের দায়িত্ব যে, আমরা বিকৃত ভাষা ব্যবহার করব, নাকি আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষার ব্যবহার করব।’ তিনি বলেন, যে বাচ্চা হিন্দি শিখছে, তাকে বোঝাতে হবে তোমার ভাষা ওই হিন্দির চেয়েও সুন্দর।’ বর্তমান সময়ে শিশুদের টিভি, রেডিওর সামনে বসার চেয়ে বই পড়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
আমাদের দেশে বর্তমানে প্রদর্শিত শতকরা ৮০ ভাগ চ্যানেলে হিন্দি তথা বিদেশিতে হচ্ছে। এর ফলে পরিবারের ছেলে-বুড়ো সবাই মনের অগোচরে হিন্দিতে দক্ষ হয়ে উঠছেন। প্রায়ই হিন্দিতে কথা বলছেন। আমাদের দেশের তরুণরা হিন্দিতে দক্ষ হয়ে উঠলেও ভারতে তরুণরা অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলছেন। এ দেশের ছেলেমেয়েদের হাতে হিন্দি ভিডিও-সিডি আর ভারতের তরুণদের হাতে হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজি নভেল, সিডি শোভা পাচ্ছে। এ দেশের তরুণরা বলিউড তারকাদের অনুষ্ঠানে টিকিটের জন্য যখন উদ্বিগ্ন তখন ওই দেশের ছেলেমেয়েরা কম্পিউটারের কোনো কুইজ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ নিয়ে চিন্তিত।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব হানিফ সংকেত বলেন, ‘আসলে আমাদের সত্তায়, মননে যেভাবে পরজীবী হওয়ার চাষ চলছে, তাতে যে কোনো সময়ই সর্বনাশ ঘটতে পারে। নিজের ভাষা ভুলিয়ে, হিন্দি-ইংরেজি গুলিয়ে শিশুদের যে অপভাষা গেলানো হচ্ছে তার পরিণতি খুব ভালো নয়। টিভিতে, ছবিতে, বিশেষ করে কিছু কিছু এফএম রেডিওতে বাংলা ভাষা যেন সহশিল্পীর মতো, সহ ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু রেডিওতেই নয়- এদের অনেকেই আবার ফেসবুক লাইভে এসেও ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে কথা বলছে। আশার কথা, বিষয়টি সম্প্রতি তথ্য মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আবার আজকাল কিছু নাটক দেখলে মনে হয় ছেলেমেয়েদের কোনো কাজ নেই- কাজ একটাই প্রেম করা, আড্ডা দেয়া, মোবাইলে কথা বলা, নইলে ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত থাকা। আর এসব করতে গিয়ে কিছু শিল্পী ভাষার বিকৃতি ঘটিয়ে এমন উদ্ভটভাবে সংলাপ বলেন, যা অত্যন্ত পীড়াদায়ক। আজকাল ইংলিশ মিডিয়ামের কিছু ছেলেমেয়ের বাংলা শুনলে মনে হবে খুব কষ্ট করে বাংলা বলছে। এরা ইংরেজি গান শোনে, ইংরেজিতে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বই নয়- ট্যাব এদের নিত্যসঙ্গী। যেখানে প্রযুক্তিকে আমাদের ব্যবহার করা উচিত, সেখানে উল্টো প্রযুক্তিই আমাদের ব্যবহার করছে। তাই এসব ছেড়ে বই পড়ার অভ্যাস বাড়াতে হবে। কারণ বই মনকে আলোকিত করে, কল্পনাশক্তি বাড়ায়, বই মানুষকে ভাবতে শেখায়, অজানাকে জানার সুযোগ করে দেয়। আসলে ভাষা যখন শিকড় হারিয়ে ভাসমান হয় অর্থাৎ ভাসে তখন অনেক জঞ্জালও ভেসে আসে, আমাদের সেসব জঞ্জাল থেকে মুক্ত থাকতে হবে।’
