দিলীপ কুমার : এক জীবনের গল্প
বিনোদন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মাত্র দুই বছর পার হলেই তিনি হতে পারতেন শতবর্ষী। কিন্তু সে মাইলফলক তার নামের আগে যোগ হয়নি। তাতে কী হয়েছে? ৯৮ বছর বয়সে তার ঝুলিতে আছে অভাবনীয় অর্জন। তিনি উপমহাদেশের কিংবদন্তি অভিনেতা দিলীপ কুমার। তাকে বলা হয় ভারতীয় সিনেমার ট্র্যাজেডি কিং। মুম্বাইয়ের পি ডি হিন্দুজা হাসপাতাল অ্যান্ড মেডিকেল রিসার্চ সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ৭ জুলাই সকাল সাড়ে ৭টায় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন এই প্রখ্যাত অভিনেতা। শ্বাসকষ্ট নিয়ে ২৯ জুন থেকে এ হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি ছিলেন দিলীপ কুমার। বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিলেন তিনি।
পাকিস্তানের ফল বিক্রেতার ছেলে থেকে বলিউডে নায়ক
উপমহাদেশের সিনেমায় দিলীপ কুমার ছিলেন অনন্য অসাধারণ এক অভিনেতা। বলা যায় ভারতীয় সিনেমার দারুণ এক সংযোজন তিনি। বলিউডি নাম-যশ-খ্যাতির আড়ালে এই কিংবদন্তি অভিনেতার আরও একটি ইতিহাস আছে। তার আসল নাম মহম্মদ ইউসুফ খান। ১৯২২ সালের ১১ ডিসেম্বর অবিভক্ত ভারতের পেশোয়ারে তার জন্ম। বর্তমানে স্থানটি পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনওয়ালার অন্তর্ভুক্ত। পাঠানদের অন্যতম গোত্র আওয়ান পরিবারের সন্তান তিনি। তারা ছিলেন ১২ ভাইবোন। বাবার নাম লালা গুলাম সরোয়ার ছিলেন ফল ব্যবসায়ী। পেশোয়ার ও মহারাষ্ট্রের দেওলালিতে ছিল নিজস্ব বাগান। ইউসুফ খান লেখাপড়া করেন দেওলালির বিখ্যাত বার্নস স্কুলে। ত্রিশ দশকের শেষ দিকে তার পরিবার স্থায়ীভাবে মুম্বাইয়ে বসবাস শুরু করে। চল্লিশের দশকের শুরুতে পুনেতে নিজস্ব ব্যবসা শুরু করেন তিনি। একটি ক্যান্টিন চালাতেন এবং স্থানীয় বাজারে শুকনো ফল সরবরাহ করতেন।
দেখতে বেশ সুদর্শন ছিলেন ইউসুফ খান। সিনেমার প্রতি অদম্য নেশা ছিল। এ কারণে প্রায়ই ছুটে যেতেন সিনেমার শুটিং দেখতে। কখনো একা, আবার কখনো কলেজের সহপাঠী রাজ কাপুরের সঙ্গে। এভাবেই আসা-যাওয়ার মধ্যে একদিন বলিউডের তৎকালীন সুপারস্টার দেবিকা রানীর চোখে পড়েন। তিনি ইউসুফের কাছে জানতে চান উর্দু পারেন কিনা? পাকিস্তানি শুনেই দেবিকার পরের প্রশ্ন ছিল- তুমি অভিনেতা হতে চাও কি-না। বাকিটা ইতিহাস।
ইউসুফ খান থেকে দিলীপ কুমার
ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তখন ধর্ম কিংবা নামের একটি বিষয় ছিল। স্বভাবতই মুসলিম কোনো নামকে তারা নিতে পারবেন না। এমনটিই ধারণা ছিল দেবিকা রানীর। তিনি এটাও জানতেন, ইউসুফ খান নামটি একজন রোমান্টিক হিরোর জন্য মানানসই হবে না। এ বিষয়ে সুপরিচিত হিন্দি কবি নরেন্দ্র শর্মার সঙ্গে আলাপ করলে তিনি জাহাঙ্গীর, ভাসুদেব ও দিলীপ কুমার- এ তিনটি নাম প্রস্তাব করেন। এর মধ্যে ‘দিলীপ কুমার’ নামটিই পছন্দ করেন নিজের জন্য। নাম পরিবর্তনের বিষয়ে ইউসুফ খানেরও বেশ আগ্রহ ছিল। তার রক্ষণশীল বাবা তার এই নতুন পেশার কথা যেন না জানতে পারেন। কারণ তার বাবা সিনেমা জগতের মানুষদের নিয়ে তামাশা করতেন।
মুসলিম হয়েও নেই মুসলিম চরিত্রে
মুসলিম নাম বদলে হিন্দু ঘরানার নাম গ্রহণ করলেও পুরো ক্যারিয়ারে দিলীপ কুমার মাত্র একবার মুসলিম চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সে ছবির নাম ‘মুঘল ই আযম’। এরপর আর কোনো ছবিতে তাকে মুসলমান চরিত্রে দেখা যায়নি। অবশ্য এসব বিষয় কখনো তার ভাবনাতেও ছিল না।
দিলীপ কুমারের প্রেমিকারা
বলিউডে থিতু হয়েছেন, কিন্তু তার জীবনে প্রেম আসবে না, এটা কী সম্ভব? দিলীপ কুমারের জীবনেও প্রেম এসেছিল। তাও একাধিকবার। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ৬৩টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। বেশিরভাগই রোমান্টিক গল্পে। ব্যক্তি জীবনেও বেশ রোমান্টিক ছিলেন তিনি। প্রেমিকাদের নিয়ে বেশ কয়েকবার খবরের শিরোনামও হয়েছিলেন। ভারতীয় গণমাধ্যমের মতে, অভিনয়ের প্রথম দিকে দিলীপ কুমার নাকি কামিনী কুশলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান। কিন্তু কামিনীর দাদা মেনে নিতে পারেননি ওই সম্পর্ক। আচমকা কামিনীর বোনের মৃত্যু হওয়ায় তার স্বামীকে বিয়ে করেন ওই অভিনেত্রী। ক্যারিয়ারের প্রথম প্রেমেই ধাক্কা খান দিলীপ কুমার। এই ধাক্কা সামলে নিতে শরণাপন্ন হন মধুবালার।
মধুবালা ছিলেন অভিনেতা ও গায়ক কিশোর কুমারের স্ত্রী। কিশোরের সঙ্গে বিয়ের আগে মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবেসেছিলেন দিলীপ কুমারকে। চেয়েছিলেন তাকে বিয়ে করতে। কিন্তু পারেননি। ক্যারিয়ারের ইগো আর মধুবালার বাবার কূটচালের কাছে সেই সম্পর্ক ভেঙে যায়। অনেকটা অভিমান ও দিলীপ কুমারের ওপর ক্ষোভ নিয়েই পরে কিংবদন্তি গায়ক কিশোর কুমারকে বিয়ে করেছিলেন মধুবালা। কিন্তু সুখী হননি। ৯ বছর টিকে ছিল তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক। রোগেশোকে ভুগে মারা যান কোটি পুরুষের স্বপ্নের রানী মধুবালা। দিলীপ কুমার নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছেন, আতাউল্লা (মধুবালার বাবা) এই সম্পর্কটাকে একটা বিজনেস ভেঞ্চার হিসাবে ফায়দা তুলতে চেয়েছিলেন যার জেরে সন্তুষ্ট হয়ে মধুবালার ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন তিনি।
দিলীপের জীবনে সায়রা বানুর আগমন
মধুবালার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর বেশ কিছুদিন নিজেকে সম্পর্কের বেড়াজাল থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন দিলীপ কুমার। এরপর সায়রা বানুর সঙ্গে পরিচয় হয়। দিলীপ কুমারের ওপর আগে থেকেই আকর্ষণ ছিল সায়রা বানুর। সেই কারণেই ২২ বছর বয়সের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সায়রা বানু তার গলায় মালা পরান। সম্পর্কটা এখানেই স্থায়ী হতে পারত। কিন্তু হয়নি। সায়রা বানুকে বিয়ের পর ফের আসমা নামে এক পাকিস্তানি মহিলার সঙ্গে নতুন করে সম্পর্কে জড়ান দিলীপ কুমার। ফলে ভেঙে যায় দিলীপ-সায়রা সংসার। এরপর আসমাকে বিয়ে করেন দিলীপ। কিন্তু সেটাও টেকেনি। বিয়ের দুবছরের মধ্যেই আসমার সঙ্গে দিলীপ কুমারের দূরত্ব বাড়তে শুরু করে। আসমা তাকে ‘ঠকাচ্ছেন’, এ অভিযোগেই দূরে সরে যান দিলীপ। আসমার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ফের সায়রার কাছেই ফিরে আসেন দিলীপ। আবারও তারা বিয়ে করে সংসারী হন। জীবনের শেষ পর্যন্ত সায়রাই ছিলেন দিলীপের প্রেম, আশ্রয়, ঠিকানা, পরিচয়, সেবিকা। সায়রা ক্যারিয়ার, খ্যাতি সব ছেড়ে দিলীপ কুমারের বুকেই স্বর্গের সুখ খুঁজে নিয়েছিলেন। প্রায়ই তিনি বলতেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, আল্লাহর কাছে তিনি চিরকৃতজ্ঞ কোহিনূর রূপে দিলীপ কুমারকে তার কাছে পাঠানোর জন্য।
জোটেনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার
জীবদ্দশায় ৬৩টি ছবিতে অভিনয় করেছেন দিলীপ কুমার। তার সাফল্য কিংবা অর্জনের তালিকা অনেক লম্বা। প্রায় ছয় দশকের ক্যারিয়ারে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। সবচেয়ে বেশি পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতীয় অভিনেতা হিসাবে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসেও তার নাম রয়েছে। ফিল্ম ফেয়ার আটবার পেয়েছেন সেরা অভিনেতার পুরস্কার। মনোনীত হয়েছেন ১৯ বার। ফিল্ম ফেয়ার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন ১৯৯৩ সালে। ১৯৮০ সালে মুম্বাই শহরের সাম্মানিক শেরিফ পদটি অলংকৃত করেন তিনি। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য পেয়েছেন ভারত সরকারের সম্মাননা পদ্মভূষণ ও দাদা সাহেব ফালকে। পাকিস্তান সরকার তাকে ভূষিত করেছে ‘নিশান-এ-ইমতিয়াজ’ সম্মাননায়। কিন্তু ভারতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার তার ভাগ্যে জোটেনি।
নেই কোনো উত্তরসূরি
একজীবনে নাম-যশ-খ্যাতি সবই পেয়েছেন দিলীপ কুমার। কামিয়েছেন অর্থও। এতকিছুর পরও একটা জায়গায় এসে তার ভক্তদের থেমে যেতে হয়। এ সুপারস্টারের নেই কোনো উত্তরসূরি! ৯৮ বছরের সুদীর্ঘ জীবনে ৫৫ বছরের দাম্পত্য জীবন কাটিয়েছেন স্ত্রী সায়রা বানুর সঙ্গে। কিন্তু নেই কোনো সন্তান। এ বিষয় নিয়ে অবশ্য কোনো আক্ষেপ ছিল না এ কিংবদন্তির। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা সানন্দে মেনে নিয়েছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে একবার ভারতীয় গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দিলীপ কুমার বলেছিলেন- ‘এটা সত্যি যে, আমাদের সন্তান থাকলে দাম্পত্য আরও রঙিন হতো। তবে যোগ্য উত্তরাধিকারী নেই বলে আমাদের কোনো কষ্ট নেই। আমি মনে করি, সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাতেই আমাদের জীবনে এ শূন্যতা। আমি ও সায়রা এ অভাব মেনে নিয়েছি।’ সন্তান না থাকার শূন্যতা তিনি পূরণ করেছিলেন সায়রার ভাইকে দিয়ে। সায়রার ভাই সুলতান দিলীপ দম্পতির কাছে সন্তানের মতোই ছিলেন। পরবর্তীকালে সুলতানের ছেলেমেয়ে এবং নাতি-নাতনিই দিলীপ-সায়রার জীবনের বড় অবলম্বন হয়ে উঠেছেন।
