ভাষা আন্দোলন নিয়ে ৭২ বছরে মাত্র ৩ সিনেমা!
শাহনাজ হেনা
প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
১৯৫২ সালে মহান ভাষার বিপ্লব থেকেই বাঙালির সব আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল। সমগ্র জাতিকে এভাবে একাত্ম হতে এর আগে কখনো দেখা যায়নি। পরবর্তী সময়ে ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭০-এর ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন, এমনকি ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ ৫২-এর ভাষা আন্দোলনেরই ফসল। সেই বিপ্লবী চেতনাই আজও আমাদের প্রেরণা জোগায়, বুক ফুলিয়ে বাঁচতে শেখায়। যে আন্দোলন বাঙালির সব সাহস, শক্তি ও প্রেরণার প্রধানতম উৎস, সেই মহান অর্জনকে নিয়ে আমাদের সিনেমাঙ্গনে নেই উল্লেখযোগ্য নতুন কোনো শিল্পসৃষ্টি। বিস্তারিত লিখেছেন শাহনাজ হেনা
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান সংবলিত ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সেই প্লাকার্ড বাঙালি জাতির স্মৃতিতে এখনো উজ্জ্বল। থাকবে চিরকাল। মাতৃভাষার জন্য রক্তক্ষয় কিংবা আন্দোলনের নজির পৃথিবীতে আর নেই। প্রথমে রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং পরে সার্বভৌমত্ব অর্জনের মধ্য দিয়ে আজকের বাংলাদেশ। বছর ঘুরে একুশে ফেব্রুয়ারি সেই বার্তা নিয়ে হাজির হয় বিশ্ববাসীর নজরে। কারণ দিনটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃত। বিশ্বব্যাপী ইতিহাস ও ঘটনানির্ভর সিনেমা নির্মাণ নতুন কিছু নয়। বরং আগের চেয়ে বেড়েছে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট কিংবা ঘটনাবলী নিয়ে নির্মিত সেসব সিনেমা ব্যবসা সফলও হচ্ছে। পাশাপাশি সেই দেশ বা জাতির দলিল হিসাবেও থেকে যাচ্ছে আর্কাইভে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন কিংবা ভাষার অধিকার আদায় নিয়ে নেই পূর্ণাঙ্গ কোনো সিনেমা। ১৯৫২ সাল থেকে এ পর্যন্ত গত ৭২ বছরে মাত্র ৩টি সিনেমায় ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে বাংলা ভাষা নিয়ে আন্দোলনের সিনেমা বলতে গেলে মাত্র তিনটি! এগুলো হলো জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’, শহীদুল ইসলাম খোকনের ‘বাঙলা’ ও তৌকীর আহমেদের ‘ফাগুন হাওয়ায়’। অবশ্য স্বাধীনতার আগে জহির রায়হান ‘হাজার বছর ধরে’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করলেও সেটাকে ভাষা আন্দোলনের সিনেমা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া যায় না। আরেক বরেণ্য চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন ‘শহিদ আসাদ’ নামে একটি ছবি নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কুমিল্লার এক জনসভায় মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে নিয়ে সিনেমাটির মহরতও হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন পাক সরকারের অনুমতি না পাওয়ায় পরে এর কাজ এগোয়নি।
জহির রায়হান ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামে আরও একটি সিনেমা নির্মাণের উদ্যোগও নিয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন সরকারের অসহযোগিতার কারণে সেটি আর নির্মিত হয়নি। এরপর পরপরই ১৯৭০ সালে গণআন্দোলনের পটভূমিতে ‘জীবন থেকে নেয়া’ নিয়ে হাজির হলেন জহির রায়হান। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি এ সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছে। এটিই একমাত্র সিনেমা যাতে প্রভাতফেরি, ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহিদ মিনারে বিভিন্ন সংগঠনের পুষ্পস্তবক অর্পণের দৃশ্য, সমকালীন গণআন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন, রাজনীতি, পুলিশি নির্যাতন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ, একনায়কতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ইত্যাদি প্রসঙ্গ ও ঘটনা তুলে ধরা হয়েছিল। অর্থাৎ ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যে সূত্রপাত সেটি নির্মাতা এ সিনেমার মাধ্যমে নিখুতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘জীবন থেকে নেয়া’ মুক্তি পায় ১৯৭০ সালের ১১ এপ্রিল।
এরপর কেটে যায় ৩৫ বছর। এ দীর্ঘ সময়ে সিনেমার পর্দায় আর কেউ একুশ নিয়ে কথা বলেননি। স্বাধীনতার সাড়ে তিন দশক পর প্রয়াত নির্মাতা শহীদুল ইসলাম খোকন ভাষা আন্দোলনকে ফের পর্দায় ফেরানোর উদ্যোগ নেন। ২০০৬ সালে তিনি নির্মাণ করেন ‘বাঙলা’ নামে একটি সিনেমা। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফার লেখা উপন্যাস ‘ওংকার’ অবলম্বনে নির্মিত হয় সিনেমাটি। ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় সিনেমা এটি। প্রয়াত অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি, মাহফুজ আহমেদ ও শাবনূর অভিনয় করেন এ সিনেমায়।
‘বাঙলা’ নির্মাণের ১৩ বছর পর ২০১৯ সালে তৌকীর আহমেদ আবারও ভাষা আন্দোলনকে পর্দায় তুলে ধরেন। তিনি নির্মাণ করেন ‘ফাগুন হাওয়ায়’। টিটো রহমানের গল্প ‘বউ কথা কও’ অবলম্বনে নির্মিত এ সিনেমায় নুসরাত ইমরোজ তিশা, সিয়াম আহমেদ, আবুল হায়াত, ফজলুর রহমান বাবু অভিনয় করেন। এ সিনেমাটি ৪৪তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা সিনেমাসহ তিনটি বিভাগে পুরস্কৃত হয়। এছাড়া গত ৭২ বছরে বেশকিছু প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে। সরকারিভাবে ‘হৃদয়ে একুশ’ ও ‘বায়ান্নর মিছিল’ নামে ডকুমেন্টারি বানানো হয়েছে।
মহান ভাষা আন্দোলন নিয়ে সিনেমা সংশ্লিষ্টদের কেন এমন দীনতা? এ ধরনের ছবি কম হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে তৌকীর আহমেদ বলেন, ‘ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সিনেমা নির্মাণ করা বেশ ব্যয়বহুল আর সময়সাপেক্ষ বিষয়। এ অবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণ হওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া দেশি সিনেমা শিল্পের সার্বিক অবস্থাও ভালো নয়। সামগ্রিক জটিলতা না কাটলে বিশেষ সিনেমা তৈরি হওয়ার আশা করা ভুল হবে।’
