Logo
Logo
×

তারাঝিলমিল

দীক্ষাহীন শিল্পীদের কারণে বাউল গান এখন ‘আইসিইউতে’

Icon

রিয়েল তন্ময়

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাউল গান, সংগীতের অনেক বড় মাধ্যম। এ সময়েও বাউল গান বেশ জনপ্রিয়। তবে এ গানের প্রকৃত শিল্পী, সাধক, গীত রচয়িতার সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। অনেকেই বাউল গানের সাধনতত্ত্বের কথা জানেন না, এমনকি জানেন না বাউল সাধকদের জীবনাচার সম্পর্কে। না জেনেই গান করছেন বর্তমান শিল্পীরা। তাই এখনকার বাউল শিল্পীদের কণ্ঠে গানের আবেদন-নিবেদনের অনেকটা খামতি থেকেই যাচ্ছে।

বাউল গান মূলত আখড়ার গান। আখড়ায় সাধকরা তাদের তত্ত্বকথার ভেতর দিয়ে শিষ্যদের দেহকেন্দ্রিক সাধন-ভজনের ক্রিয়া-করণ বুঝিয়ে দিতেন। কখনোবা সাধক আত্মনিবেদনে নিমগ্ন হন গানের অতলস্পর্শী সুরের আমেজে। তখন আখড়ার মধ্যে যে সাংগীতিক আবহ তৈরি হয়, সেটি এখনকার শহরের রঙিন বাতির আলো ঝলমলে মঞ্চের বিদেশি বাদ্যযন্ত্রের শব্দে পাওয়া যায় না। বরং কর্ণপীড়ার সৃষ্টি করে।

বর্তমানে লক্ষ করলেই দেখা যায়, যারা বাউল গান করছেন বা নিজেকে বাউল বলে পরিচয় দিচ্ছেন, সেসব শিল্পীর তেমন গুরু দীক্ষা নেই, সাধন-ভজনেও মন নেই। কোনোভাবে একটা গান গেয়ে ইউটিউবে ছেড়ে দিয়েই নিজেকে বাউল পরিচয় দিয়ে ধন্য মনে করছেন। বায়না নিয়ে আসর মাতাচ্ছেন সারা দেশে। সেটা যদি হয় সুন্দরী রমণী, তাহলে তো আর কথা নয়। গানের চেয়ে বেশি কোমর দোলানোয় পারদর্শী হতে হয় তাদের। গান কি গাইছেন বা গানের তাল, লয়, ছন্দ কোনদিকে যাচ্ছে সেটার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন কোমর কতটা বাঁকা হচ্ছে কিংবা শরীর কতটা লাফাচ্ছে সেদিকে। এভাবে তারা বাউল গানে নানা বিকৃতি ও পরিবর্তন ঘটাচ্ছেন। বাউল গানের আদি সুর-বাণী এবং বক্তব্য নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই বা তাদের জানার আগ্রহও নেই। শ্রোতাসাধারণের মন মাতানোই তাদের কাছে মুখ্য। অবশ্য প্রবীণ বাউল সাধক যারা এখনো গান করছেন, তারা তাদের সাধনমার্গের অঙ্গ হিসাবেই তা করছেন। তারা গুরু পরম্পরায় পাওয়া বাণী ও সুর মেনেই গান করছেন।

বাউল সাধকদের শিরোমণি ফকির লালন সাঁই। লালন তার বিপুলসংখ্যক গানের মাধ্যমে বাউল মতের দর্শন এবং অসাম্প্রদায়িকতার প্রচার করেছিলেন। বাউল সমাজে তিনি ‘সাঁইজি’ ও তার গান ‘সাঁইজির কালাম’ হিসাবে পরিচিত। এছাড়া বাউল কবিদের মধ্যে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম, জালাল খাঁ, রশিদ উদ্দিন, হাছন রাজা, রাধারমণ দত্ত, সিরাজ সাঁই, পাঞ্জু শাহ, পাগলা কানাই, শীতলং শাহ, দ্বিজদাস, হরিচরণ আচার্য, মহর্ষি মনোমোহন দত্ত, লাল মাসুদ, সুলা গাইন, বিজয় নারায়ণ আচার্য, দীন শরৎ (শরৎচন্দ্র নাথ), রামু মালি, রামগতি শীল, মুকুন্দ দাস, আরকুম শাহ্, সৈয়দ শাহ নূর, উকিল মুন্সী, চান খাঁ পাঠান, তৈয়ব আলী, মিরাজ আলী, দুলু খাঁ, আবেদ আলী, উমেদ আলী, আবদুল মজিদ তালুকদার, আবদুস সাত্তার, খেলু মিয়া, ইদ্রিস মিয়া, আলী হোসেন সরকার, চান মিয়া, জামসেদ উদ্দিন, গুল মাহমুদ, প্রভাত সূত্রধর, আবদুল হেকিম সরকার, আবুল কাসেম তালুকদার, বাউল সুনীল কর্মকার, ক্বারী আমীর উদ্দিন আহমেদ, ফকির দুর্বিন শাহ, শেখ মদন, দুদ্দু সাঁই, কবি জয়দেব, কবিয়াল বিজয় সরকার, ভবা পাগলা, নীলকণ্ঠ, দ্বিজ মহিন, পূর্ণদাস বাউল, খোরশেদ মিয়া, সিরাজ উদ্দিন খান পাঠান, আব্দুল হাকিম, আলেয়া বেগম, দলিল উদ্দিন বয়াতি, মাতাল রাজ্জাক, হালিম বয়াতি, মালেক দেওয়ান, খালেক দেওয়ান, আবুল সরকার, শাহ আলম সরকার, আক্কাস দেওয়ান, মনির দেওয়ান, গোষ্ঠ গোপাল দাস প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এখনো তাদের গানই দেশে প্রচলিত। তবে বর্তমানে তাদের সৃষ্ট গানের মর্মকথা না জেনেই গাইছে অনেক বাউল শিল্পী। এসব শিল্পী রঙে-ঢঙে গেয়ে গানকে যেমন নষ্ট করছেন, তেমনি অশ্রদ্ধা করা হচ্ছে গানের সৃষ্টি সাধক বাউলদের। বর্তমানে যারা বাউল গান চর্চা করছেন বা বাউল গান নিয়ে গবেষণা করছেন তারা বলছেন, গানকে নতুনত্ব দিতে গিয়ে বা আসর মাতাতে গিয়ে গানের মূল বার্তা ও তত্ত্বকথার পরিবর্তন যেন না ঘটে, সেদিকে খেয়াল রেখেই শিল্পীদের গাইতে হবে। সাধকরা অনেক চর্চা করে ও অনেক সাধনা করেই এসব গান সৃষ্টি করেছেন। তাদের প্রত্যেক গানেই একটি বার্তা রয়েছে। গানটি গাওয়ার আগে এতে কী বার্তা দেওয়া হয়েছে সেটা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। গান গাইতে গিয়ে যেন তাদের গানে দেওয়া বাণীর পরিবর্তন করা না হয়। সবচেয়ে বড় কথা, বাউল গান গাওয়ার আগে বা নামের আগে বাউল বিশেষণ যোগ করার আগে অবশ্যই গুরুদীক্ষা নিতে হবে।

গান গাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুদীক্ষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? এ বিষয়ে প্রখ্যাত বাউলশিল্পী শফি মন্ডল বলেন, ‘গান গাইতে গুরুদীক্ষার প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই আছে। তবে অনেকেই কিন্তু সেটা বোঝেই না। একবারেই যে কেউ দীক্ষা নিচ্ছে না তা নয়। তবে এর অংশটা কম। দীক্ষা নেবে কার কাছে? সেই মানুষটারই এখন অভাব। গুরুদীক্ষা নেওয়া শিল্পী আর শুধুই শিল্পী, দুটো আলাদা বিষয়। একটা হলো যারা বুঝে গান করে, আর কেউ কেউ শুধুই গান করে শিল্পী হিসাবে। এর পরিবর্তন হবে আশা করি। একটা সময় এই বাউল ও সুফি মতের মধ্যে পার্থক্য কী, তারাও সেটা বুঝতে পারবে আশা করি।’

তবে এ বিষয় নিয়ে বেশ অভিমান ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন আরেক বাউলশিল্পী কুদ্দুস বয়াতি। তিনি বলেন, ‘কী বলব, এখন আর গানের পরিবেশ ভালো নয়। একটা গান গেয়ে ভাইরাল হয়ে যায়, কিন্তু আর তো কোনো গান সে জানে না। কিন্তু তাকে নিয়েই চলে মাতামাতি। আর বাউলশিল্পীদের সংখ্যা দেখি শুধু বাড়ছে। শুনছি বাউলদের নাকি গোপন আস্তানা আছে। সেখানে অনেক কিছু নাকি হয়। আমি চাই মানুষ সুষ্ঠু জ্ঞানে, সুষ্ঠু মনে গান শুনুক, গান বুঝুক। গানে অর্থ থাকবে, পীর মুর্শিদের কথা থাকবে, সেটা বুঝেই কিন্তু গান গাইতে হবে আমাদের।’

প্রখ্যাত বাউলশিল্পী ফকির শাহাবুদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘যারা গাইছে তাদের কোনো দোষ নেই। তাদের গলা আছে দু-চারটা গান শিখছে, তারা গাইছে। আমরা যারা এখনো বাউল গান করছি, তারা মারা যাওয়ার পর এ ধরনের গান অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। তখন যার যার মতো করে কিন্তু তারা বাউল বলেন আর ফোক বলেন, সেই গানটাকে স্টাবলিস্ট করবে। এখন বাউল বলতে কেউ নেই। দুই চারটা গান গেয়েই বিভিন্ন প্রোগ্রামে চান্স পেয়ে যাচ্ছে। পুরুষরা যদিও একটু শিখার চেষ্টা করে, নারীরা তো একেবারেই না। এখন তো অনেকেই ইউটিউব থেকে গান শিখেই শিল্পী হয়ে যাচ্ছে। তারা কেউ ওস্তাদের বাড়ি যায় না, তাদের ওস্তাদ এখন ইউটিউব। আমার ৪৫ বছরের গানের জীবনে এখনো বাউল শব্দটা ব্যবহার করতে পারি না। আমি মনে করি আমি এখনো বাউল হতে পারিনি। তাই নামের আগে ফকির লাগিয়েছি। আর এখন দু-চারটা গান গেয়েই নামের আগে লিখে ফেলে বাউল। তারা মনে করে বাউল একটা নাম। এটার অবশ্যই পরিবর্তন দরকার।’

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম