Logo
Logo
×

দশ দিগন্ত

লালকেল্লা বিস্ফোরণের পর মুসলিম হয়রানি

কাশ্মীরে দমনপীড়ন চালাচ্ছে ভারতের পুলিশ-সেনাবাহিনী

সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখছে : মুখ্যমন্ত্রী * কাশ্মীর টাইমসের কার্যালয়ে অভিযান জম্মুতে মুসলিম শিক্ষার্থীদের ভর্তি বাতিলে বিক্ষোভ

Icon

যুগান্তর ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কাশ্মীরে দমনপীড়ন চালাচ্ছে ভারতের পুলিশ-সেনাবাহিনী

কাশ্মীরের বাসিন্দাদের ওপর রীতিমতো চড়াও হয়ে উঠেছে দেশটির পুলিশ-সেনাবাহিনী। ফাইল ছবি

দিল্লির লাল কেল্লা বিস্ফোরণের ঘটনায় কাশ্মীরের জনগণের ওপর ব্যাপক দমনপীড়ন চালাচ্ছে ভারতের মোদি সরকার। ১০ নভেম্বরের ওই ঘটনার পর থেকেই ‘অবরুদ্ধ’ এ জনপদের মুসলিমদের সন্দেহের চোখে দেখছে মোদি প্রশাসন। রাস্তায় রাস্তায় তল্লাশি, নজরদারি, দোকানপাট-ঘরবাড়িতে অভিযান-সবমিলিয়ে মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীরের বাসিন্দাদের ওপর রীতিমতো চড়াও হয়ে উঠেছে দেশটির পুলিশ-সেনাবাহিনী।

একই তালে চোখ রাঙাচ্ছে রাজ্যের অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও। মধ্যরাতে ঘরে ঢুকছে; ঘুমের ঘোরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। নিরাপত্তার নামে এ নিপীড়ন শুধু কাশ্মীরেই সীমাবদ্ধ নেই-ভিন্ন রাজ্যে বসবাসকারী ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী ও চাকরিজীবী কাশ্মীরীদের ওপরও চলছে মানসিক নির্যাতন। সন্দেহ ও অবিশ্বাসের ঘেরাটোপে একঘরে করে ফেলা হচ্ছে তাদের। কাশ্মীর টাইমস, রাইজিং কাশ্মীর।

হামলার কয়েক দিনের মধ্যেই কাশ্মীর থেকে অন্তত ১৫০০ মুসলিমকে আটক করা হয়। বৃহস্পতিবার জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের স্টেট ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এসআইএ) কাশ্মীর টাইমস পত্রিকার অফিসে অভিযান চালায়। এ বিষয়ে কুলগামে এক অনুষ্ঠানে বুধবার মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ বলেন, ‘দু-একজনের কাজের জন্য আজ আমাদের সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। আমাদের হেয় করার চেষ্টা চলছে, যেন আমরা সবাই সেই ঘটনার জন্য দায়ী!’ ডন।

পরিচয়ের ভিত্তিতে সন্দেহ : বিস্ফোরণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই, যখন কোনো সন্দেহভাজন শনাক্তই হয়নি, পুলিশ দেশজুড়ে মুসলিমদের লক্ষ্য করে তল্লাশি শুরু করে। রেলস্টেশনগুলোতে ধর্মীয় চেহারার ভিত্তিতে যাত্রীদের থামিয়ে তাদের তল্লাশি করা হয়। একই দৃশ্য কাশ্মীর ছাড়াও উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, গুজরাটেও দেখা গেছে। ডানপন্থি সোশ্যাল মিডিয়া ঘটনাটিকে স্পষ্টভাবে মুসলিমবিরোধী রূপ দেয়। বিজেপির ঘনিষ্ঠ ‘বাবা বনরস’ কোনো প্রমাণ ছাড়াই দাবি করে বিস্ফোরণে ব্যবহৃত গাড়িটি নাকি একজন কাশ্মীরী মুসলিমের। তারা প্রকাশ্যে কাশ্মীরে গণগ্রেফতারের দাবি তোলে।

দোকানে দোকানে অভিযান : শ্রীনগর পুলিশ বৃহস্পতিবার শহরের সব জোনের হার্ডওয়্যারের দোকানগুলোতে ব্যাপক পরিদর্শন চালিয়েছে। এ অভিযান নোহাট্টা, লালবাজার, শাহীগঞ্জ, চানাপোরা, রাজবাগ, আরএমবাগ, রাজবাগ, সাদ্দার, ক্বামারওরি, যাদীবাল, হজরতবাল, সওরা, হারওয়ান, করণনগর এলাকায় চালানো হয়। পুলিশ সূত্র জানায়, পরিদর্শনের মূল উদ্দেশ্য ছিল-হার্ডওয়্যারসামগ্রী বা উপকরণ কোনো অবৈধ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করা। পাশাপাশি সব ব্যবসায়ী নিরাপত্তা ও নথিপত্রসংক্রান্ত বাধ্যতামূলক নিয়মাবলী মেনে চলছেন কিনা তা দেখা। অন্যদিকে ভারতীয় বাহিনীর সদস্যরা জম্মু ও কাশ্মীরের বারামুল্লা জেলায় সহিংস অবরোধ ও তল্লাশি অভিযান শুরু করেছে। কাশ্মীর মিডিয়া সার্ভিসের মতে, ভারতীয় সেনাবাহিনী, আধা-সামরিক বাহিনী এবং সীমান্ত রক্ষী বাহিনী উরি এবং জেলার অন্যান্য এলাকায় তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করেছে।

অভিযোগ ছাড়াই আটক : ১৩ নভেম্বরের মধ্যেই দিল্লি থেকে বহু দূরের কাশ্মীরই হয়ে ওঠে প্রধান টার্গেট। কুলগাম জেলায় ২০০টির বেশি স্থানে অভিযান চালানো হয়। চার দিনে পুরো জেলায় ৪০০ বেশি স্থানে অপারেশন চালানো হয়। অনেককে অভিযোগ না জানিয়ে কারাগারে পাঠানো হয় যেখানে আদালতের বিচার ছাড়াই দীর্ঘদিন রাখা যায়। অনেকের পুলিশ নথি, মোবাইল, কম্পিউটারসহ নানা জিনিস জব্দ করেছে পুলিশ। কিন্তু তারা তদন্তে কী পেয়েছে সে বিষয়ে কিছুই বলেননি। বারামুলা, বুদগাম, অনন্তনাগ, পুলওয়ামা, শোপিয়ানেও আরও ৩০টির বেশি অভিযান হয়।

রাতের অন্ধকারে ত্রাস : শোপিয়ানের জয়নাব মির (ছদ্মনাম) বলেন, ‘রাত ২টায় দরজা ভেঙে ঢুকে স্বামীকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। বাচ্চাদের সামনে বেধড়ক মারা হয়। ঘরবাড়িতে ব্যাপক তল্লাশি চালানো হয়। এরপর তাকে জেলে নেওয়া হয়।’ কুলগামের রাশিদ আহমদ (ছদ্মনাম) বলেন, ‘৬৭ বছর বয়সি অসুস্থ বাবাকে রাতের বেলা নিয়ে গেল। কোনো অভিযোগ নেই।’ বারামুলার সামীরা আব্দুল্লাহ (ছদ্মনাম) জানান, ভোরে পুরো মহল্লা ঘিরে ফেলে। ঘরে ঘরে ঢুকে ফোন দেখে। আমার ননদাইকে নিয়ে যায় শুধু তার কন্টাক্ট লিস্টে ‘সন্দেহভাজন’ একজন ছিল বলে। অনেকের দাবি-কর্তৃপক্ষ দিল্লি বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজনদের খুঁজছে না; বরং একটি পুরো সম্প্রদায়কে শাস্তি দিচ্ছে। অনেককে শুধু আত্মীয়তার কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে এটি স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ। ২০২৫ সালের এপ্রিলে পেহালগাম হামলার পরও একইভাবে শত শত মানুষকে আটক করা হয়।

উত্তর ভারতে কাশ্মীর বিদ্বেষ : জম্মু ও কাশ্মীর স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন সোমবার এক বিবৃতিতে জানায়, লালকেল্লা বিস্ফোরণের পর উত্তর ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে কাশ্মীরী ছাত্রছাত্রীদের হুমকি এবং বাড়ি খালি করার চাপে পড়তে হচ্ছে। সংগঠনের ন্যাশনাল কনভেনর নাসির খুইহামী দিল্লিতে এক সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, বিস্ফোরণের ঘটনার পর দেশজুড়ে কাশ্মীরীদের বিরুদ্ধে সন্দেহ ও অবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছে। উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, রাজস্থান ও দিল্লির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং আবাসিক এলাকায় এমন অভিযোগ উঠছে। এদিকে, জম্মুতে মেডিকেল কলেজ থেকে মুসলিম শিক্ষার্থীদের বাদ দেওয়ার দাবি তুলেছে ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। বৃহস্পতিবার জম্মুর আরএসএসের ‘সংঘ পরিবার’র সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সংগঠন শ্রীমাতা বৈষ্ণদেবী ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল এক্সেলেন্সের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ভর্তির তালিকা বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেছে। তাদের মূল দাবি, নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯০ শতাংশ মুসলিম এবং তারা কাশ্মীরের বাসিন্দা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম