Logo
Logo
×

দশ দিগন্ত

১৯৪৮ সালের প্রথম নাকবা থেকে...

সাতাত্তর বছর ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছি

গাজার ৮১ বছর বয়সি দাদির মুখে ইসরাইলি নৃশংসতা * জীবনটাই গেল ভয়ে-ভয়ে! আমরা আসলে বেঁচে নেই; মরে গেলেই বেঁচে যেতাম

Icon

যুগান্তর ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আজ থেকে সাত দশক আগের কথা। ১৯৪৮ সাল-ইসরাইল-ফিলিস্তিন প্রথম ‘নাকবা’ (বিপর্যয়, দুর্যোগ)। হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে তাড়িয়ে দিচ্ছিল ইসরাইল। বয়স কেবল চারের কোঠায় তখন। কিছুই বুঝত না ছোট্ট শিশু গালিয়া আবু মোতেইর। বাবা-মায়ের কোলে বসে সেবারই প্রথম পালানো শুরু। সেই প্রথম তাঁবু জীবনের হাতেখড়ি। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস-আজ ৮১ বছর বয়সেও ঘুরে ফিরে আবারও তাঁবুতে। মাঝের ৭৭ বছর যে খুব শান্তিতে ছিলেন তাও নয়। জীবনের লম্বা এ সময়ে আরও বহুবার পালাতে হয়েছে তাকে। কখনও রাফাহ থেকে খান ইউনিস, গাজা সিটি থেকে দেইর আল বালাহ কখনও আবার সেই রাফাহ। প্রাণ বাঁচাতে ছেলে-মেয়ে, ঘর-সংসার নিয়ে জর্ডানেও পালাতে হয়েছে গাজার এই দাদি’কে। পুরো জীবনটাই কেটে গেল ইসরাইলের ভয়ে ভয়ে। ছেলে-মেয়ে নিয়ে আজও কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই তার- যতবার গড়েছেন ততবারই ধ্বংস হয়েছে ইসরাইলের হামলায়! খান ইউনিসের শরণার্থী তাঁবুর সামনে বসে বার্তা সংস্থা এপির দুই সাংবাদিককে সেই গল্পই শোনালেন ৪৫ নাতিপুতির দাদি মোতেইর।

বাবা-মা, তিন ভাইয়ের সঙ্গে সেদিন এক কাপড়ে পালিয়েছিলেন তারা। উপকূল ধরে টানা ৭৫ কিলোমিটার (৪৫ মাইল) হেঁটে এসেছিলেন গাজার খান ইউনিস শহরের শরণার্থী শিবিরে। সেখানে তখন মোতেইর পরিবারের মতো হাজার হাজার শরণার্থীর ভিড়। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনবিষয়ক ত্রাণ ও কর্মসংস্থার (ইউএনআরডব্লিউএ) উদ্যোগে প্রথম উদ্বাস্তু শিবিরি ছিল সেটি। তারপর কত বছর পেরিয়ে গেছে- জীবনের এ পড়ন্ত বেলায় দুঃসহ সেসব স্মৃতিও আজ অস্পষ্ট। খানিকটা ভয়ার্ত কণ্ঠেই বললেন, ‘আমি সব যুদ্ধ দেখেছি। কিন্তু একটিও এই যুদ্ধের মতো নয়।’ এবারের যুদ্ধ নিয়ে হতাশ এই দাদি বলেন- ‘আমাদের পুরো জীবনটা কেটেছে ভয়ে-ভয়ে। দিনরাত, মাথার ওপর ক্ষেপণাস্ত্র-যুদ্ধবিমান। আসলে আমরা বেঁচে নেই বরং মরে গেলেই বেঁচে যেতাম।’ এপি।

গত বৃহস্পতিবার মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছিল ফিলিস্তিনি ‘নাকবা’ দিবস। ১৯৪৮ সালের সেদিন ৭ লাখ ফিলিস্তিনিকে ইসরাইলি বাহিনী তাড়িয়ে দিয়েছিল। শরণার্থীদের মধ্যে প্রায় ২ লাখ জনকে ছোট উপকূলীয় অঞ্চলে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। আবু মোতেইরের তার নিজ গ্রাম ওয়াদ হুনায়েন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু মনে নেই। তেল আবিবের দক্ষিণ-পূর্বে লেবুর বাগানে ঘন একটি ছোট গ্রাম ছিল। দখলদার ইসরাইলিরা প্রবেশ করলে মোতেইর তার বাবা-মা এবং তার তিন ভাইকে নিয়ে পালিয়ে যায়। আবু মোতেইর বলেন ‘আমরা আমাদের পোশাক, কোনো পরিচয়পত্র, কিছুই না নিয়ে চলে এসেছিলাম’। আবু মোতেইর তার জীবিত ছেলে-মেয়ে এবং ৪৫ জন নাতি-নাতনি নিয়ে বাস্তুচ্যুত শিবিরেই থাকছেন। তিনি বলেন, ‘আজ আমরা আগের নাকবার চেয়েও বড় নাকবায় আছি’। দুই বছর তাঁবুতে থাকার পর, তার পরিবার আরও দক্ষিণে রাফায় চলে যায় এবং একটি বাড়ি তৈরি করে। ১৯৫৬ সালে যখন ইসরাইলি বাহিনী মিসরের সিনাই আক্রমণের জন্য গাজা দিয়ে আক্রমণ করে, তখন পরিবারটি আবার মধ্য গাজায় পালিয়ে যায় এবং রাফাহ ফিরে আসে। ১৯৬৭ সালের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের পরের বছরগুলোতে, যখন ইসরাইল গাজা এবং পশ্চিম তীর দখল করে, তখন আবু মোতেইরের মা এবং ভাইয়েরা জর্ডানে চলে যান। তখন বিবাহিত আবু মোতেইর তার সন্তানদের নিয়ে সেখানেই থেকে যান। এরপর ২০২৩ সালে ইসরাইলি সেনারা শহর আক্রমণ করার সময় তার পরিবার রাফাহ থেকে পালিয়ে যায়। তারা এখন খান ইউনিসের বাইরে উপকূলে মুওয়াসির বিস্তৃত তাঁবুর শহরে বাস করে। একটি বিমান হামলায় তার এক ছেলে নিহত হয়। সেই ছেলের তিন মেয়ে, এক ছেলে এবং গর্ভবতী স্ত্রীও ছিল। এছাড়াও হামলায় আবু মোতেইরের তিন নাতি-নাতনিও নিহত হয়েছে। আবু মোতেইর কয়েক দশক ধরে গাজা ছেড়ে যাওয়ার কথা ভেবেছেন।

একবার, তিনি জেরুজালেমে একটি দলগত সফরে গিয়েছিলেন। তাদের বাস যখন ইসরাইলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। তখন চালক তাদের পাশ দিয়ে মুছে ফেলা ফিলিস্তিনি শহরগুলোর মধ্যে তার গ্রামের নাম ওয়াদ হুনায়েন উচ্চারণ করেন। তারা সেখান থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না। তিনি বাস থেকে আর নামেননি। তবে এখনও রাফাহ ফিরে যেতে চান মোতাইর। কিন্তু রাফাহের বেশিরভাগ অংশই ধ্বংস হয়ে গেছে, যার মধ্যে তার পারিবারিক বাড়িও রয়েছে। শেষ বাক্যে মোতাইর বলেন, ‘আমরা কার কাছে ফিরে যাব? ধ্বংসস্তূপের কাছে?’

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম