জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক
আমাদের চোখের সামনেই মরছে গাজার শিশুরা
দ্বিরাষ্ট্র সমাধানে জাতিসংঘে সম্মেলন: অনাহারে ১০ লাখ নারী ও মেয়েশিশু * নিহতের সংখ্য ৬০ হাজার ছাড়াল
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গাজার ধ্বংসস্তূপ, ধুঁকতে থাকা শিশুদের কঙ্কালসার দেহ, অনাহারে ক্লান্ত মুখগুলো বিশ্ব বিবেকের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে পুরো সভ্যতাকে। গাজার প্রাণহীন এই বাস্তবতাকে এবার বিশ্ববাসীর সামনে নতুনভাবে তুলে ধরেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক। বললেন, ধ্বংসস্তূপে পরিণত গাজা দুঃস্বপ্নের এক বাস্তব চিত্র। যেখানে আমাদের চোখের সামনেই মরছে শিশুরা। রোববার জাতিসংঘে ফিলিস্তিনবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের আগে জেনেভো থেকে এক ভিডিও বার্তায় এ কথা বলেন তুর্ক। এছাড়া গাজায় ইসরাইলের হত্যাযজ্ঞ থামাতে বিশ্বকে এগিয়ে আসার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। ইসরাইল-হামাস সংঘাতের অবসানে ‘কার্যকর দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের’ আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেসও। সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে ফিলিস্তিন-ইসরাইল দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের লক্ষ্যে শুরু হওয়া আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উদ্বোধনী বক্তব্যে এই আহ্বান জানান তিনি। সাধারণ পরিষদের রেজোলিউশন ৭৯/৮১ অনুসারে তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সম্মেলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে ফ্রান্স ও সৌদি আরব। তবে সম্মেলন বয়কট করেছে ইসরাইল ও তার প্রধান মিত্র দেশ যুক্তরাষ্ট্র। আলজাজিরা, বিবিসি।
সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে গুতেরেস বলেছেন, ‘দখলদারিত্বের মাঝে কখনোই নিরাপত্তা থাকতে পারে না। দীর্ঘদিন ধরে আমরা শুধু আলোচনার ভেতরেই ঘুরপাক খাচ্ছি। অথচ বাস্তবে শান্তির কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। বক্তৃতা, প্রতিশ্রুতি, বিবৃতি-এগুলো মানুষের কোনো কাজে আসছে না। তারা দেখছে তাদের ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছে-জমি দখল হয়ে যাচ্ছে।’ তিনি বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আমরা নিখুঁত পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করতে পারি না। আমাদের সমাধানের পথ তৈরি করতে হবে।’ সম্মেলনে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান আল সৌদ ইসরাইল রাষ্ট্রের সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রোডম্যাপ তৈরির লক্ষ্যকে সমর্থন করার আহ্বান জানিয়েছেন। ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জঁ নোয়েল ব্যারো বলেছেন, ‘আমাদের অবশ্যই এমন উপায় বের করতে হবে যার মাধ্যমে গাজার যুদ্ধের অবসান থেকে ইসরাইল-হামাস সংঘাতের অবসান ঘটে। এছাড়া জাতিসংঘের এই অধিবেশনে, ফ্রান্স ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণভাবে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত এবং আমরা তা সেপ্টেম্বর মাসেই করব বলে ঘোষণা দিয়েছেন ফ্রান্সের ইউরোপ ও পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী জঁ-নোয়েল ব্যারো। পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার তার বক্তব্যে বলেন, গাজা আজ ‘আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবিক নীতি-আদর্শের কবরস্থান। ত্রাণ অবরোধ এবং ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক অবকাঠামো লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে ইসরাইল ‘আইন ও মানবতার’ প্রতিটি রেডলাইন অতিক্রম করেছে। দখলদারিত্বের অবসান এবং দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন ফিলিন্তিনি প্রশ্ন-‘জাতিসংঘ এবং বিশ্বের জন্য একটি বড় পরীক্ষা’।
এদিকে আলোচনার মধ্যেই গাজায় হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরাইলি বাহিনী। মঙ্গলবার পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় গাজাজুড়ে ১১৩ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে গাজায় নিহতের সংখ্যা ৬০ হাজার ৩৪ জনে পৌঁছেছে। আহত হয়েছেন আরও এক লাখ ৪৫ হাজার ৮৭০ জন। এদিকে ইসরাইলের টানা অবরোধে দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে গাজা। সম্প্রতি গাজায় ত্রাণের ট্রাক ঢুকলেও তা একেবারেই সীমিত। এই পরিস্থিতিতে গাজার ১০ লাখ নারী ও শিশু অনাহারে ঝুঁকিতে আছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক বার্তায় জাতিসংঘের নারীবিষয়ক নির্বাহী পরিচালক সিমা বাহৌস বলেছেন, ‘এই বিভীষিকা অবশ্যই শেষ হতে হবে।’ ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মুস্তাফা বলেন-সুরক্ষা ও সহায়তার জন্য অস্থায়ী আন্তর্জাতিক বাহিনীকে আমন্ত্রণ জানাতে ফিলিস্তিন প্রস্তুত।
‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রকৃত আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করছি যা আমাদের ফিলিস্তিনি প্রশ্নের শান্তিপূর্ণ, ন্যায়সঙ্গত এবং ব্যাপক সমাধানের দিকে পরিচালিত করবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন : আজকের এ সময়টার অপেক্ষায় আমরা অনেক হারিয়েছি। প্রচণ্ড কষ্ট ভোগ করছি।’ তাই তিনি এই সম্মেলনকে একটি অভূতপূর্ব ঘোষণার মাধ্যমে ইসরাইলি দখলদারিত্বের অবসান ও গণহত্যা বন্ধের একটি সন্ধিক্ষণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিশ্বকে আগ্রাসন, অনাহার এবং বাস্তুচ্যুতি বন্ধ করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে এবং একটি স্পষ্ট বার্তা পাঠাতে হবে ‘অনেক অবহেলিত হয়েছে ফিলিস্তিনিরা-ফিলিস্তিনিরাও মানুষ’।
এক টুকরো রুটিতেই খুশি
দুই হাতেই রুটির টুকরো। শরীরটা শুকিয়ে গেছে। ছোট্ট মেয়েটিকে কোলে নিয়ে তার দিকেই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন বাবা। মুখে মৃদু হাসি। হয়তো মেয়ের হাতে এক টুকরো রুটি দিতে পেরেই সন্তুষ্ট এই বাবা। যেখানে খাবার পাওয়া দুরূহ, সেখানে এই টুকুতেই হয়তো খুশি তারা। এই শিশুরা এক নিষ্ঠুর মৃত্যুকূপে আটকে পড়েছে। তাদের হাতে নেই কোনো বিকল্প। নেই বেঁচে থাকার ন্যূনতম উপকরণও নেই। মানবিক সহায়তা কর্মীরা জানিয়েছেন, অনাহারে ৮৮ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এই মৃত্যু কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নয়, বরং এক নিষ্ঠুর ও অবহেলাপূর্ণ বিশ্বের নীরব সম্মতির ফল এএফপি
ছোট্ট হৃদয়ে বড় ক্ষত
কঙ্কালসার দেহ নিয়ে শুয়ে আছে ১০ বছর বয়সি উবাইদা আল-কারার। একেবারে নিস্তেজ শরীর। অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে নিঃশব্দে। একসময় নির্ভয়ে খেলার আনন্দে ভরপুর ছোট্ট এই শিশুটি আজ বুকভর্তি ক্ষত নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। অপুষ্টির কষ্ট তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। একই সঙ্গে ত্বকের জটিল রোগ তার প্রতিদিনের বেঁচে থাকার লড়াইকে আরও নির্মম করে তুলেছে। গাজার হাজার হাজার শিশুর মতো উবাইদা এখন জীবন-সম্বলহীন। তাদের দুর্দশার গল্প ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি জমে উঠছে হাসপাতালের কোণে। ধ্বংসস্তূপের মাঝে এএফপি
অনাহারে মৃত্যুঝুঁকিতে ৪০ হাজার নবজাতক
তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা ২ বছরের শিশু ইয়াজানকে কোলে নিয়ে বসে আছেন মা নাইমা। ক্ষুধায় একেবারে কাতর সে। শরীরে শক্তি নেই। পাশেই কঙ্কালসার দেহ নিয়ে শুয়ে আছে আরেকটি শিশু। ব্যাপক দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ছে গাজায়। খাবার নেই, পানি নেই, চিকিৎসার সারঞ্জাম নেই। উপত্যকাটিতে না খেয়েই মরছে শিশুরা। এরই মধ্যে ১৪৭ জন মানুষ অপুষ্টিতে প্রাণ হারিয়েছে এর মধ্যে ৮৮ জনই শিশু। গাজার সরকারি গণমাধ্যম অফিস সতর্ক করেছে যে, দুই বছরের কম বয়সি এক লাখেরও বেশি শিশু, যার মধ্যে ৪০ হাজার নবজাতক মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছে -এএফপি
