পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা
সবুজ চৌধুরী
প্রকাশ: ১১ আগস্ট ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সহকারী শিক্ষক, সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় মোহাম্মদপুর, ঢাকা
রচনা : আধুনিক জীবনে কম্পিউটারের গুরুত্ব
ভূমিকা : আধুনিক সভ্যতার শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তি হিসাবে খ্যাত কম্পিউটার। এটি বিজ্ঞানের এক বিস্ময়। কম্পিউটার অর্থ গণনাকারী। সাধারণত যে যন্ত্রের সাহায্যে গণনা করা যায় তাকে কম্পিউটার বলে। এটি ছিল কম্পিউটার বিষয়ক প্রথম প্রচলিত ধারণা। কিন্তু শুধু গণনা করা সংক্রান্ত এই ধারণাটি এখন অচল। কম্পিউটার শুধু গণনাই করে না, এটি বর্তমানে মানবজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখছে। কম্পিউটার ছাড়া যেন এখন আধুনিক সভ্যতা অচল।
কম্পিউটার পরিচিতি : কম্পিউটার শব্দটি ইংরেজি হলেও এর উৎপত্তি ল্যাটিন ভাষা থেকে। ল্যাটিন Compute শব্দের অর্থ গণনা করা, আর (Computer) শব্দটির অর্থ গণনাকারী যন্ত্র। এককথায় কম্পিউটার হলো গণকযন্ত্র। তবে আধুনিক কম্পিউটার শুধু গণকযন্ত্র অর্থে ব্যবহার করা সঙ্গত নয়। কারণ এর কর্মপরিধি সর্বব্যাপ্ত হয়েছে। সূচনা পর্বে প্রায়োগিক উপযোগিতার কথা বিবেচনায় এ নামকরণটি গৃহিত হয়েছিল। বস্তুত কম্পিউটার হচ্ছে এমন এক ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস যা একসঙ্গে সল্পতম সময়ে বিশাল সংখ্যায় তথ্য ও উপাত্ত গ্রহণ, সংরক্ষণ, ফলাফল বিশ্লেষণ ও প্রদর্শন করতে সক্ষম।
কম্পিউটার আবিষ্কার : Computer শব্দটি ১৯৬৪ সালে বিখ্যাত অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে অন্তর্ভুক্ত হয়। বিখ্যাত গণিতবিদ ব্লেইজ প্যাসকেল ১৬৬২ সালে সর্বপ্রথম যোগ-বিয়োগ করতে সক্ষম এক ধরনের যান্ত্রিক গণকযন্ত্র উদ্ভাবন করেন। এরপর ১৬৭১ সালে গুণ-ভাগের ক্ষমতাসম্পন্ন গণকযন্ত্র আবিষ্কার করেন গনড্রাইড লেবনিজ। ১৮৩২-৩৪ সালের মধ্যে ক্যাব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক চার্লস ব্যাবেজ আধুনিক ইলেট্রনিক গঠনতন্ত্র প্রস্তুত করেন। এটিই ছিল মূলত আধুনিক কম্পিউটারের মূল ভিত্তি। সেজন্য চার্লস ব্যাবেজকেই কম্পিউটারের জনক বলা হয়। ১৯৪৪ সালে হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও আইবিএম কোম্পানি যৌথভাবে ইলেকট্রোমেকানিক্যাল কম্পিউটার আবিষ্কার করেন। যার ওজন ছিল ৩০ টন। এর দু’বছর পরে আমেরিকার পেনসিলবানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ‘ইনিয়াক’ নামে ইলেকট্রনিক কম্পিউটার আবিষ্কার করেন। ১৯৪৭ সাল থেকে আইবিএম কোম্পানি বাণিজ্যিকভাবে কম্পিউটার তৈরি ও বাজারজাতকরণ শুরু করে।
কম্পিউটারের প্রকারভেদ : প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে কম্পিউটারের দ্রুত বিকাশ ঘটেছে। বর্তমানে কম্পিউটার অনেক ধরনের মিডিয়াতে কাজ করছে। কাজের ধরন ও ব্যবহারে সুবিধা অনুসারে কম্পিউটারের এই প্রকারভেদ সৃষ্টি হয়েছে। আবার গঠনগত ও কার্যকারিতার ভিত্তিতেও কম্পিউটারের শ্রেণিবিভাগ করা হয়। যেমন-বড় ধরনের কম্পিউটার, মাঝারি ধরনের কম্পিউটার ও ছোট কম্পিউটার। কার্যক্ষমতা অনুসারে কম্পিউটার দুই প্রকার। যথা-১. সুপার কম্পিউটার ২. মেইন ফ্রেম কম্পিউটার। কার্যপদ্ধতির সিগন্যাল অনুসারে কম্পিউটার আবার তিন প্রকার। যথা-১. এনালগ কম্পিউটার ২. ডিজিটাল কম্পিউটার ৩. হাইব্রিড কম্পিউটার।
কম্পিউটারের গঠন : আধুনিক কম্পিউটারের রয়েছে প্রধান দুটি অংশ-১. হার্ডওয়ার বা যান্ত্রিক সরঞ্জাম ও ২. সফটওয়ার বা প্রোগ্রাম সরঞ্জাম। কম্পিউটারের যান্ত্রিক সরঞ্জাম একটি সুপ্ত ক্ষমতাসম্পন্ন। এই কর্মক্ষমতাকে কাজে লাগানোর জন্য প্রোগ্রাম দরকার। সফটওয়ারের মাধ্যমে এই কর্মক্ষমতাকে কাজে লাগানো হয় এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ এক নিমিষেই হয়ে যায়। কম্পিউটারের হার্ডওয়ারকে আবার তিনটি অংশে ভাগ করা যায়। যথা-১. ইনপুট ইউনিট, ২. সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট ও ৩. আউটপুট ইউনিট। ইনপুট ইউনিট তথ্য ও নির্দেশ গ্রহণ করে সেন্টাল প্রসেসিং ইউনিটে পাঠায়। সেন্টাল প্রসেসিং ইউনিট তথ্য ও নির্দেশ মোতাবেক ফলাফল তৈরির পর আউটপুটে পাঠায়। আউটপুট অংশ ফলাফল প্রকাশ করে।
বাংলাদেশে কম্পিউটার : বাংলাদেশে সর্বপ্রথম কম্পিউটার ব্যবহৃত হয় ১৯৬৪ সালে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার আণবিক শক্তি কমিশনের জন্য আইবিএম-১৬২০ সিরিজের একটি কম্পিউটার আমদানি করে। তবে কম্পিউটারের বহুল ব্যবহার শুরু হয় মূলত আশির দশকের দিকে। নব্বই দশকের দিকে কম্পিউটার সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এলে তারা ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার শুরু করে। মুদ্রণশিল্পে কম্পিউটার সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৯৮৭ সালে প্রকৌশলী মাইনুল ইসলাম প্রথম বাংলা লিপি ‘মাইনুলিপি’ প্রচলন করেন। ১৯৮৮ সালে বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আনন্দ কম্পিউটার্স অ্যাপল মেকিন্টোস কম্পিউটারে ব্যবহার উপযোগী বাংলা ফ্রন্ট ‘বিজয়’ উদ্ভাবন করেন। বর্তমানে আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের সফটওয়ার প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় সফটওয়ার রপ্তানিতে বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে।
আধুনিক সভ্যতা ও কম্পিউটারের ব্যবহার : আধুনিক সভ্যতার প্রতিটি কাজে এখন কম্পিউটার একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমান যুগ কম্পিউটারের যুগ। যোগাযোগ, পরিবহণ, ব্যবস্থাপনা, ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিক্ষা, ওষুধ, চিকিৎসা বিজ্ঞান, গবেষণা, মহাকাশ গবেষণা, হিসাব নিকাশ ইত্যাদি কম্পিউটার ছাড়া অচল। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও পরীক্ষানিরীক্ষার নিখুঁত ফলাফলের জন্য বর্তমানে কম্পিউটার ব্যবহৃত হচ্ছে। বড় বড় কলকারখানা পর্যন্ত এখন কম্পিউটার পরিচালনা করে থাকে। কম্পিউটারের স্মৃতিতে অনেক তথ্য সঞ্চয় করে রাখা যায়। এগুলো প্রয়োজনমতো ব্যবহারের সুযোগ আছে কম্পিউটারে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণ কম্পিউটার ব্যবহৃত হচ্ছে। মোটকথা বিমান চালনা থেকে শুরু করে এখন চিঠি লেখার কাজে পর্যন্ত কম্পিউটারের ব্যবহার দেখা যায়।
কম্পিউটার শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা : কম্পিউটার শিক্ষা ছাড়া আধুনিক সভ্যতা বিনির্মাণ অসম্ভব। আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে কম্পিউটার শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কম্পিউটার শিক্ষা না থাকলে কর্মক্ষেত্রে অদক্ষ বলেই বিবেচিত হয়। নিচে কম্পিউটার শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার দিকগুলো তুলে ধরা হলো-
১. ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে প্রযুক্তির কল্যাণকর সুবিধা প্রপ্তি। ২. কর্মক্ষেত্রে শ্রম ও ক্লান্তির বোঝা লাঘব। ৩. সামাজিক যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্র বৃদ্ধি। ৪. ই-কমার্সের কারণে অর্থনৈতিক সহজীকরণ ও বাণিজ্যের ক্ষেত্র বৃদ্ধি। ৫. সফটওয়ার বণিজ্যের সম্ভাবনা সৃষ্টি। ৬. তথ্য ও উপাত্ত সংরক্ষণের নিরাপদ ক্ষেত্র ৭. টেলিযোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, টেলিমেডিসিন, প্রোগ্রামিং, পণ্য বিপণন প্রভৃতির বিস্তার সাধন প্রভৃতি।
বাংলাদেশে কম্পিউটার শিক্ষা : বাংলাদেশে প্রথম দিকে বেসরকারি উদ্যোগে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা চালু হয় নব্বইয়ের দশকের দিকে। ১৯৮৪ সালে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) কম্পিউটার বিভাগ চালু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ বিভাগ খোলে ১৯৯২ সালে। পরবর্তীকালে সরকার এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বিআইটি, পলিটেকনিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলোতে কম্পিউটার শিক্ষা চালু করে। ১৯৯১ সালে উচ্চমাধ্যমিকে ও ১৯৯৪ সালে মাধ্যমিকে কম্পিউটার কোর্স পাঠ্যভুক্ত করা হয়। বর্তমানে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর বিভিন্ন মেয়াদে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এ ছাড়া ২২০০টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ দেশে কম্পিউটার শিক্ষার প্রসারে কাজ করে যাচ্ছে।
উপকারিতা : কম্পিউটার আধুনিক বিজ্ঞান জগৎকে নানাভাবে সাহায্য করছে। আধুনিক জগতে খবরাখবর লেন-দেনের মাধ্যম হিসাবে কম্পিউটার ব্যবহার হচ্ছে। রেডিও, টেলিভিশন, টেলিফোন শিল্পে মনিটারিং ব্যবস্থায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে শিক্ষা-দিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসায়সহ যাবতীয় কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তথ্য সংরক্ষণে বিশেষ ভূমিকা রাখছে কম্পিউটার।
অপকারিতা : কম্পিউটার শুধু যে উপকারই করছে তা নয়, এর অপকারিতাও আছে। অনুন্নত দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। তা ছাড়াও অনেক জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক সময় পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করতে ভুল করে ফেলে কম্পিউটার। ফলে অনেক ছাত্রকে ভোগান্তি পোহাতে হয়। তা ছাড়া কম্পিউটারে ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহার তরুণ সমাজকে কুপথে টেনে নেওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে।
উপসংহার : কম্পিউটার আধুনিক যুগের এক বিস্ময়কর সৃষ্টি, এক মহান আশীর্বাদ। কম্পিউটার আবিষ্কার মানবজাতির কাছে এক নতুন দিক খুলে দিয়েছে। কম্পিউটার ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কম্পিউটার মানুষের মেধা ও কায়িক শ্রমকে অনেকাংশে লাঘব করেছে। এর কল্যাণেই অদূর ভবিষ্যতে প্রযুক্তিকে আরও দূর মহাকাশে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে।
