Logo
Logo
×

টিউটোরিয়াল

পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা : রচনা

Icon

সবুজ চৌধুরী

প্রকাশ: ২৫ মে ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সহকারী শিক্ষক, সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় মোহাম্মদপুর, ঢাকা

মুক্তিযুদ্ধ

ভূমিকা : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল ১৯৭১ সালে সংঘটিত তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের সশস্ত্র সংগ্রাম, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়লে একটি জনযুদ্ধের আদলে গেরিলাযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা ঘটে। অতপর মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত এবং প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালি জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।

পটভূমি : ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতীয় উপমহাদেশ স্বাধীন হয় এবং ভারত বিভক্ত হয়ে দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান এবং হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় ভারত। নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তান দুই হাজার মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত দুটি প্রদেশের সমন্বয়ে গঠিত হয়- পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তান। ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে যোজন যোজন ব্যবধানে অবস্থিত এ দুটি অংশের মধ্যে মিল ছিল কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মে। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই এর পূর্ব অংশ পশ্চিম অংশের তুলনায় নানাভাবে বঞ্চিত হতে থাকে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩ বছর ছিল পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস।

৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ : ১৯৭১ সালের মার্চের ৩ তারিখ পূর্ব ও পশ্চিম অংশের এই দুই নেতা পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতিকে সঙ্গে নিয়ে দেশের ভাগ্য নির্ধারণে ঢাকায় বৈঠকে মিলিত হন। তবে বৈঠক ফলপ্রসূ হয় না। বঙ্গবন্ধু সারা দেশে ৫ দিনের হরতাল এবং অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। হরতাল শেষে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। এই ভাষণে তিনি ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের আগেই বাস্তবায়নের জন্য চার দফা দাবি পেশ করেন- ১) অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে। ২) সামরিক বাহিনীকে সেনানিবাসে ফিরে যেতে হবে। ৩) নিহত ব্যক্তিদের সঠিক সংখ্যা অনুসন্ধান করতে হবে। ৪) ২৫ মার্চে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের আগে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” তার এই ভাষণ গোটা জাতিকে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় উন্মাতাল করে তোলে।

অপারেশন সার্চলাইট : ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী শুরু করে অপারেশন সার্চলাইট নামের গণহত্যাযজ্ঞ। এশিয়ান টাইমসের ভাষ্য অনুযায়ী, সামরিক বাহিনীর বড় বড় অফিসারদের নিয়ে বৈঠকে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন “তিরিশ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করো, তখন দেখবে বাকিরা আমাদের হাত চেটে খাবে।” সে পরিকল্পনা মতোই ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট আরম্ভ করে যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেওয়া। এরই অংশ হিসাবে সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করে হত্যা করা হয়, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের নিধন করা হয় এবং সারা বাংলাদেশে নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যা করা হয়।

স্বাধীনতার ঘোষণা : টেক্সাসে বসবাসরত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত নথি সংগ্রাহক মাহবুবুর রহমান জালাল বলেন, “বিভিন্ন সূত্র ও দলিল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এই প্রমাণিত হয় যে, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যা ছিল তার বা অন্য কারো হয়ে ঘোষণা দেওয়ার অনেক আগে। ২৫ মার্চে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক ভেঙে গেলে ইয়াহিয়া গোপনে ইসলামাবাদে ফিরে যান। এবং গণহত্যা চালানোর পর পাকিস্তানি সেনারা সেই রাতেই বঙ্গবন্ধুসহ তার পাঁচ বিশ্বস্ত সহকারীকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে যান।

মুক্তিযুদ্ধের সূচনা : ২৫ মার্চের পরিকল্পিত গণহত্যার মুখে সারা দেশে শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধযুদ্ধ। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ, সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্য এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষ দেশকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর কব্জা থেকে স্বাধীন করতে কয়েক মাসের মধ্যে গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে নানাভাবে অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সাহায্য লাভ করে।

পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ ও বাঙালির বিজয় : ডিসেম্বরের শুরুতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে ইতোমধ্যে পর্যুদস্ত ও হতোদ্যম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তারা ৯৩ হাজার সৈন্যসহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। পাকিস্তানি ইস্টার্ন কমান্ডার, লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি, ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনীর পূর্ব রণাঙ্গনের প্রধান কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সামনে আত্মসমর্পণের নির্দশনপত্রে স্বাক্ষর করছেন, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। এরই মাধ্যমে নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান ঘটে; প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালি জাতির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।

বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা : বর্তমানে রাজনৈতিক দ্বিধা বিভক্ত ও আন্তর্জাতিক কুচক্রের প্রভাবে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাটি ঠুনকো হয়ে পড়েছে। ব্যক্তি ও দল তার নিজ স্বার্থ রক্ষায় মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চক্রান্তের ফাঁদে ফেলছে জনগণকে। ফলে জাতিয়তাবাদী চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধ সৃষ্টি হচ্ছে। কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধকে দলীয় স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যবহার করছে আবার কেউ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বদলে দেওয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ফলে বাঙালি জাতি দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ছে। তাই আমাদের উচিত মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তরুণ সমাজের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরা।

উপসংহার : মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাঙালি জাতি তার আত্মপরিচয় খুঁজে পেয়েছিল। বাঙালির চিরকালীন উপেক্ষিত এক আমোঘ শক্তির উৎস্যের সন্ধান পেয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালিকে হার না মানার শিক্ষা দিয়েছিল। প্রকৃত ইচ্ছাশক্তির কাছে কোনো বাধা-ই যেন বাধা হয়ে থাকে না। বাঙালি বুঝতে পেরেছিল বীরত্বের মর্ম। তাই মুক্তিযুদ্ধ জাতির চিরকালীন সব প্রেরণার উৎস্য।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম