পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা রচনা
সবুজ চৌধুরী
প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সহকারী শিক্ষক, সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় মোহাম্মদপুর, ঢাকা
জাতীয় কবি : কাজী নজরুল ইসলাম
ভ‚মিকা :
“বল বীর চির উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি নত শির
ঐ শিখর হিমাদ্রির।”
বাংলা সাহিত্যে এমন দাম্ভিক বাক্যচয়ন নজরুল ছাড়া আর কে-ই বা করতে পরে। পরাধীনতার বিরুদ্ধে এমন শিহরিত, আলোড়িত শব্দসমষ্টি ও ভাবের সমন্বয়ে নজরুল যা লিখেছেন তা স্বভাবতই বিদ্রোহ। তাই কাজী নজরুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী কবি’ নামে পরিচিত। তার কবিতায়, গানে ও গদ্যে পরাধীন ভারতের নিপীড়িত মেহনতি জনতার মুক্তির বাণী ধ্বনিত হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের জনগণের কবি। তিনি আমাদের জাতীয় কবি। তিনি আমার প্রিয় কবি।
জš§ ও শৈশব :
১৮৯৯ সালের ২৪ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে তিনি জš§গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ফকির আহমেদ ও মাতার নাম জোবেদা খাতুন। শৈশবে মাতা-পিতা তার নাম রেখেছিলেন দুখু মিয়া। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও বেপরোয়া বালক। শৈশবে বাবা মারা গেলে আর্থিক অনটনে তিনি বিভিন্ন পেশায় যোগ দেন। এ সময়ে তিনি ছন্নছাড়াদের মতো বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান। একবার আসানসোলে এক রুটির দোকানে কাজ নেন। সেখানে থেকে জনৈক পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টরের সহানুভ‚তি পেয়ে ময়মনসিংহের দরিরামপুরে আসেন। সেখানে এক হাইস্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু দরিরামপুর হাইস্কুল থেকে তিনি পালিয়ে রানিগঞ্জের শিয়ারসোল হাইস্কুলে ভর্তি হন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছে। নজরুলের রক্তে রণভেরী বেজে উঠল। তিনি পড়া ছেড়ে ৪৯নং বাঙালি পল্টনে যোগ দেন এবং করাচি চলে যান। যুদ্ধ থাকাকালীনই ‘ব্যথার দান’ গ্রন্থটি রচনা করেন।
কবি জীবন :
সৈনিক জীবনেই শুরু হয় তার সাহিত্য সাধনা। করাচি থেকে কলকাতা ফিরে এসে তিনি সাহিত্য সাধানায় ঝুঁকে পড়েন। ১৩২৮ বঙ্গাব্দের ২২ পৌষ ‘সাপ্তাহিক বিজলী’ পত্রিকায় তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে রাতারাতি তার কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ‘অগ্নিবীণা’ থেকে শুরু করে একে একে প্রকাশ পায় ‘বিষের বাঁশি’ ‘ভাঙ্গার গান’ ‘চক্রবাক’, ‘দোলনচাঁপা’, ‘ছায়ানট’ ‘মরুভাস্কর’ প্রভৃতি অমর সৃষ্টি। কবিতায় তিনি মেহনতি কৃষক-শ্রমিকের পক্ষে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন বলে তাকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়। বিশেষত তার ‘বিদ্রোহী’ নামক কবিতাটি তাকে বিদ্রোহী কবি হিসাবে পরিচিতি দেয়। জুলুম ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে নজরুলের কণ্ঠ ছিল সোচ্চার। তার কবিতা ‘মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত, যবে উৎপিড়ীতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না’ ছাড়াও এ ধরনের বহু পঙ্ক্তি এ দেশের পরাধীন মানুষের মধ্যে চেতনার সৃষ্টি করে। এজন্য ব্রিটিশ শাসকের রোষে পড়ে তিনি জেল খেটেছেন। কবিতা ছাড়াও গান, উপন্যাস, নাটকে তিনি অপূর্ব দক্ষতা দেখিয়েছেন। বিশেষ করে তার অবিস্মরণীয় সৃষ্টি হলো প্রায় চার হাজারের মতো গান। গুণগত দিক থেকে গানগুলো শ্রেষ্ঠ।
সাম্যের কবি :
কবি নজরুল ছিলেন সাম্যবাদী কবি। তার কবিতায় তিন ধরনের সাম্যবাদের রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি, যথাÑ ১. নারী-পুরুষের সমতা ২. ধনী-দরিদ্রের সমতা ৩. ধর্ম-বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে মানুষের সমতা। কবি তার ‘নারী’ কবিতায় বলেছেন -
“যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।”
কবি একদিকে যেমন কবিতায় বিদ্রোহের রণভেরী বাজিয়েছেন, অন্যদিকে মানবহৃদয়ের প্রেম ও ভালোবাসার লালিত্যের বাঁশি বাজিয়েছেন। তাই তো তিনি বলেছেন- “মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণ ত‚র্য।”
রোগে আক্রান্ত :
১৯৪২ সালে মাত্র তেতালিশ বছর বয়সে কাজী নজরুল ইসলাম এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে যান। কিন্তু তার এ রোগ আর কোনোদিন সারেনি। অবশ্য সময়মতো তার চিকিৎসাও হয়নি।
মৃত্যু :
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার কবিকে ঢাকায় নিয়ে আসেন এবং তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেন। বাংলাদেশে অবস্থানকালেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি পি.জি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের উত্তর পাশে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
উপসংহার :
কবি নজরুল বাঙালির জাতীয়তাবাদী সত্তার জাগরণের কবি। বাঙালির মধ্যে দেশপ্রেম, বিদ্রোহ, বিপ্লব ও পরাধীনতার থেকে মুক্তির শিক্ষা প্রদানকারী কবি। নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, অবহেলিত মানুষের জন্য তার কণ্ঠ ছিল সোচ্চার। তাই আজও তাকে আমাদের হৃদয় দিয়ে ভালোবাসি। তার লেখা আমাদের মনে অম্লান থাকবে চিরকাল।
