গাণিতিক ধ্রুবক পাই-এর গুরুত্ব অপরিসীম
মো. বদরুল ইসলাম
প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সিনিয়র শিক্ষক, গভর্নমেন্ট সায়েন্স হাইস্কুল তেজগাঁও, ঢাকা
পাই (Pi) হচ্ছে একটি গাণিতিক ধ্রুবক (Mathematical Constant)। পাই (Pi)-এর প্রতীক । এটি একটি গ্রিক শব্দ যাকে গ্রিক ভাষায় পি বলে। এটিকে বৃত্তীয় ধ্রুবক বা আর্কিমিডিস ধ্রুবকও বলা হয়। এর আন্তর্জাতিক মান প্রায় ৩.১৪১৫৯। ১৭০৬ সালে উইলিয়াম জোনস প্রথম এটি ব্যবহার করেন। পরে লিওনার্দ অয়লার এটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন। ইউক্লিডীয় জ্যামিতিতে বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাতকে π বলে। কোনো বৃত্তের ব্যাস ১ একক হলে ওই বৃত্তের পরিধিই হবে π।
ব্যবিলনীয়নরা খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ বছর আগে থেকেই π সম্পর্কে জানত। খ্রিষ্টপূর্ব ১৯০০-১৬৮০ সালের মাঝে নির্মিত একটা ব্যবিলনীয় ফলক পাওয়া যায় যেখানে π এর মান ৩.১২৫ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব ১৬৫০ সালে প্রাচীন মিশরের এক বিখ্যাত গাণিতিক নথি Rhind Mathematical Papyrus থেকে পাওয়া যায় π এর মান ৩.১৬০৫। বাইবেলেও π এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
বৃত্তের ক্ষেত্রফল নির্ণয়ের প্রচেষ্টা থেকেই মূলত π আবিষ্কারের পথ উন্মুক্ত হয়। ব্যাবিলীয়নরা বৃত্তের ব্যাসার্ধের বর্গকে ৩ দ্বারা গুণ করে বৃত্তের ক্ষেত্রফল নির্ণয় করতেন এবং সেখান থেকে জানা যায় π এর মান ৩.১২৫। সে সময়ের হিসাবে π এর মান এত কাছাকাছি পাওয়া অবাক হওয়ার মতো।
π এর সবচেয়ে পুরোনো গণনার কথা জানা যায় খ্রিষ্টপূর্ব ১৯০০ সালে। এর মধ্যে ব্যাবলনীয় (25/8 ) ও মিসরীয়দের (256/81 ) মান প্রকৃত মানের 1 শতাংশের মধ্যে। ১৮৪৪ সালে Martin Zacharias Dase নামে একজন মানব কম্পিউটার π এর মান মুখে মুখে ২০০ ঘর পর্যন্ত বের করেছিলেন। ১৮২৪ সালে উইলিয়াম রাদারফোর্ড নামে একজন গণিতবিদ π এর মান ২০৮ ঘর পর্যন্ত বের করেছিলেন যা ১৫৩ ঘরের পরে ভুল ছিল। ভারতীয় পুস্তক Shatapatha Brahmana -এ π এর মান 339/108 = ৩.৩১৯ উল্লেখ আছে। খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ সালে প্রকাশিত বুকস অব কিং এ π এর মান ৩ হিসাবে প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যাবিলনীয় এবং হিব্রুরা π এর মান ৩ ধরে হিসাব করতেন। মিসরীয়রা π এর মান ব্যবহার করতেন ৩.১৬। আর্কিমিডিস ৯৬ বাহুবিশিষ্ট বহুভুজ এঁকে দেখান π এর মান 223/71≤π≤ 22/7+ ৪৮০ সালে এক চীনা গণিতজ্ঞ π এর আসন্ন মান বের করেন 355/113 এবং প্রমাণ করেন ৩.১৪১৫৯২৬ ≤π≤ ৩.১৪১৫৯২৭, যা প্রায় ৯০০ বছর পর্যন্ত সঠিক ছিল। ভারতীয় গণিতজ্ঞ মাধব π এর মান ৩.১৪১৫৯২৬৫৩৫৯ পর্যন্ত বের করেন যা ১১ ঘর পর্যন্ত সঠিক। ১৪২৪ সালে ইরানের জোতির্বিদ জামশিদ আল কশি π এর মান ১৬ ঘর পর্যন্ত বের করে মাধবের রেকর্ড ভাঙেন। ১৮৮২ সালে লিন্ডম্যান নামে একজন গণিতবিদ প্রমাণ করে দেখেছেন যে π এর মান নিখুঁতভাবে বের করা সম্ভব না।
স্যার আইজ্যাক নিউটন পাই-এর জন্য ধারা লিখেছেন এবং ১৫ ঘর পর্যন্ত মান বের করেছেন। জন মাচিন হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি কী না ১০০ ঘর পর্যন্ত পাই-এর মান বের করেন। ১৯ শতকে সবচেয়ে ভালো সাফল্য অর্জন করেছিলেন উইলিয়াম শাঙ্ক। যিনি পাই-এর মান দশমিকের পর ৭০৭ ঘর পর্যন্ত গণনা করেন যা কিনা ৫২৭ ঘর পর্যন্ত সঠিক ছিল। জার্মান গণিতজ্ঞ লুডলফ ভন চিউলেন π এর মান দশমিকের পরে ৩২ ঘর পর্যন্ত বের করেন। এতে তিনি এতটাই আনন্দিত হয়েছিলেন যে-মৃত্যুর পরে তার সমাধিতে সেটা উৎকীর্ণ করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। অবশ্য সেটা করাও হয়েছিল।
পৃথিবীর বহু গণিতবিদ π এর মান নির্ভুলভাবে নির্ণয়ের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। গণিতবিদরা π এর মান দশমিকের পরে বহু সংখ্যা পর্যন্ত বের করেছেন যা দিন দিন বেড়েই চলছে। ইন্টারনেট π এর মান দশমিক বিন্দুর পরে প্রায় আড়াইশ কোটি সংখ্যা বসিয়েছে। π এর মান যত ঘর পর্যন্তই বের হোক না কেন তা শুধু গণিতবিদদের কৌতূহলের কারণেই। দশমিকের পর ট্রিলিয়নের (১০১২) বেশি ঘর পর্যন্ত পাই-এর মান বের করা হলেও মূলতঃ বাস্তবিক পক্ষে দশমিকের পর π এর মান ১২ ঘরের বেশি তেমন প্রয়োজন হয় না। সারা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বৃত্তের পরিধি গণনার জন্য ৩৯ ঘরের মান প্রয়োজন।
১৭৬১ সালে জোহান হেনরিক ল্যাম্বার্ট প্রমাণ করেন π কে দুটি পূর্ণ সংখ্যার ভগ্নাংশ আকারে প্রকাশ করা যায় না। অর্থাৎ π একটি অমূলদ সংখ্যা (Irrational Number). এটিকে দশমিক আকারে সম্পূর্ণ প্রকাশ করা যায় না। দশমিকের পরের অঙ্কগুলো দৈবভাবে আসতে থাকে। ১৮৮২ সালে ফার্দিনান্ড ভন লিনডেম্যান প্রমাণ করেন π একটি তুরীয় সংখ্যা (Transcendental Number)। অর্থাৎ এটিকে কোনো বহুপদী সমীকরণের মূল হিসাবে গণনা করা যায় না। ১৭৯৪ সালে আর্দ্র্রে-মারি লেজেন্ড আরও একধাপ অগ্রসর হয়ে আবিষ্কার করলেন যে, π²ও একটি অমূলদ সংখ্যা।
π নিয়ে যত ভাবনা তা যে শুধু গণিতবিদদের তা নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা স্টেটসের E.I. গুডউইন নামক একজন ডাক্তার ১৮৯৭ সালে ইন্ডিয়ান স্টেটসের পার্লামেন্টে π = 4 পাশ করিয়ে ফেললেন যা নিয়ে পার্লামেন্টের মেম্বারদের খুশির সীমা ছিল না। π এর মান দশমিক সংখ্যার পরে ৭ ঘর পর্যন্ত May I have a large container of coffe এই ইংরেজি বাক্যটি দ্বারা সহজেই মনে রাখা যায়। বাক্যটির প্রতিটি শব্দে বর্ণ (Letter) সংখ্যা পাই-এর মানের সমান। অর্থাৎ ১ম শব্দে বর্ণ সংখ্যা ৩টি, পরে ১টি, ৪টি, ১টি, ৫টি, ৯টি, ২টি, ৬টি। যা পাই-এর মান ৩.১৪১৫৯২৬ এর সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।
π কে মূলত আর্কিমিডিসের ধ্রুবক বলা হয়। আর্কিমিডিস বলেন, কোনো বৃত্তের অন্তর্লিখিত বা পরিলিখিত বহুভুজের বাহুর সংখ্যা যত বাড়ানো যায় তত সেটা বৃত্তের কাছাকাছি চলে যায়। আরও আমরা জানি একক ব্যাসের বৃত্তের পরিধি হলো π। এখন যদি একক ব্যাসের কোনো বৃত্তের অন্তর্লিখিত এবং পরিলিখিত বহুভুজের পরিসীমা নির্ণয় করা হয় তবে π এর চেয়ে একটু ছোট আর একটু বড় দুটো আসন্ন মানই পাওয়া যাবে। এভাবে আর্কিমিডিস π এর মান নির্ণয়ের জন্য ৯৬ ভুজ ব্যবহার করে ২ ঘর পর্যন্ত মান সঠিকভাবে বের করতে সক্ষম হন।
π এর মান বের করার অনেক পদ্ধতি আছে। সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো-বৃত্তাকার কোনো বস্তু নিয়ে সেটা খাতায় এঁকে সুতা মেপে পরিধি আর ব্যাসের অনুপাত বের করা, যা হলো π এর মান। তবে π এর মান বের করার আদর্শ পদ্ধতি হলো ধারা ব্যবহার করে। বিশেষ করে ম্যাকলরিনের ধারা, লিনাকস্থের ধারা, রামানুজনের ধারা, চাদনোভস্কির সূত্র। আর্কিমিডিস বর্গক্ষেত্র, অষ্টভুজ, ষোলভুজ, বত্রিশভুজ, চৌষট্টিভুজ, এভাবে বহুভুজ নিয়ে তার পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত দিয়ে π এর নিখুঁত মান বের করেছিলেন।
বিংশ শতকে কম্পিউটারের উদ্ভাবনের পর π গণনায় নতুন মাত্রা যোগ হয়। জন ভন নিউম্যান ১৯৪৯ সালে এনিয়াক কম্পিউটারের মাধ্যমে পাই-এর মান ২০৩৭ ঘর পর্যন্ত গণনা করেন। এ গণনায় সময় লেগেছিল ৭০ ঘণ্টা। বিংশ শতকে ভারতের গণিতবিদ শ্রীনিবাসা রামানুজন অয়েংগার π গণনার বেশ কয়েকটি সূত্র বের করেন।
কম্পিউটারে পাই গণনার বহু আগে থেকেই পাই-এর মান মুখস্থ করা কিছু কিছু মানুষের নেশার মতো ছিল। ২০০৬ সালে আকিরা হারাগুচি নামে এক অবসরপ্রাপ্ত জাপানি প্রকৌশলী দাবি করেন, তিনি এক লাখ ঘর পর্যন্ত পাই-এর মান বলতে পারেন। অবশ্য এ দাবি পরীক্ষিত নয়। চীনের ২৪ বছর বয়স্ক স্নাতক ছাত্র লু চাও ২৪ ঘণ্টা ৪ মিনিটে ৬৭ হাজার ৮৯০ ঘর পর্যন্ত পাই-এর মান মুখস্থ বলতে পারতেন যা গিনেস বুক অব রেকর্ডসে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত।
প্রতি বছর মার্চ মাসের ১৪ তারিখ মূলত পাই দিবস (Pi Day) উদযাপন করা হয়। ১৪ মার্চকে পাই দিবস হিসাবে পালন করার মূল কারণ হচ্ছে এ দিনটিকে অঙ্কে প্রকাশ করলে পাই-এর মান পাওয়া যায় অর্থাৎ ৩/১৪ পাওয়া যায়। সারা পৃথিবী জুড়ে এ দিনটিকে পাই দিবস হিসাবে গণ্য করা হয়। মজার ব্যাপার হলো, আইনস্টাইনের জন্ম তারিখ হচ্ছে ১৪ মার্চ। শুধু তাই না স্টিফেন হকিংয়ের মৃত্যু দিনও এটি। এ কারণে পৃথিবী জুড়ে পাই-এর স্মরণে এ দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে।
বৃত্ত সম্পর্কিত সব হিসাব-নিকাশে পাই-এর গুরুত্ব অনেক। বৃত্তের ক্ষেত্রফল থেকে শুরু করে বৃত্তের পরিধি নির্ণয় পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে এটি প্রয়োজন। এমনকি পদার্থ বিজ্ঞানের বিভিন্ন সূত্র উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে পাই-এর ব্যবহার করা হয়। যেহেতু পাই জ্যামিতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তাই বিভিন্ন স্থাপত্য শিল্প তৈরি করার ক্ষেত্রে, ভবনের সঠিক আকৃতি, স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার জন্য পাই (π) এর গুরুত্ব অপরিসীম।
