পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা রচনা
সবুজ চৌধুরী
প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সহকারী শিক্ষক, সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, মোহাম্মদপুর, ঢাকা
বৃক্ষরোপণ
ভূমিকা : “অন্ধ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান
প্রাণের প্রথম জাগরণে, তুমি বৃক্ষ, আদিপ্রাণ”
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কবিগুরু তার বৃক্ষ-বন্দনায় বৃক্ষকে আদিপ্রাণ বলে সম্বোধন করেছেন। প্রাণদায়ী বৃক্ষরাজি এ বসুন্ধরাকে এক অফুরন্ত সৌন্দর্যের মধুর নিকুঞ্জ করে গড়ে তুলেছে। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে মানবজাতি অরণ্যের স্নিগ্ধ সান্নিধ্যে সুপ্ত পদব্রজে এগিয়ে চলেছে নগর-সভ্যতা বিনির্মাণে। কুঠারের আঘাতে ধ্বংস করেছে পৃথিবীর তপোবন আশ্রিত সেই শান্তি নিকেতনকে। নগর-সভ্যতার নিষ্পেষণে শূন্য হতে চলেছে পৃথিবীর অক্সিজেন ভাণ্ডার। বাতাস হয়ে উঠেছে বিষবাষ্পে পূর্ণ। মানুষ যেন বৃক্ষের সঙ্গে চির আত্মীয়তা ছিন্ন করার মরণ খেলায় মত্ত হয়ে উঠেছে। তাই তো কবি কলেছেন, “দাও ফিরিয়ে সে অরণ্য, লও এ নগর”।
বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা : ওয়ার্ল্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, বর্তমান বিশ্বের বনভূমি উজাড় হতে হতে এখন অর্ধেকে এসে নেমেছে। এর ফলে বিশ্ব পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। অরণ্য বিনাশের মধ্য দিয়ে আজ আমরা যেন মরুভূমিকেই আহ্বান করছি। অরণ্যই পারে এ ধরাকে স্নিগ্ধ, শ্যামল, স্নেহময়ী করতে। মানব জীবনের সঙ্গে বৃক্ষ ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। বৃক্ষহীন পরিবেশে মানুষের টিকে থাকা অসম্ভব। নিচে বৃক্ষের প্রয়োজনের কয়েকটি দিক উল্লেখ করা হলো-
১. বৃক্ষ প্রাণিজগতের খাদ্যের জোগানদাতা। ২. বৃক্ষ আমাদের জ্বালানির কাঠ প্রদান করে। ৩. জীবনদায়ী অতি প্রয়োজনীয় অক্সিজেন আমরা বৃক্ষ থেকে পাই। ৪. বৃক্ষ পরিবেশের বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস শোষণ করে।
৫. আমাদের গৃহ নির্মাণ সামগ্রী ও আসবাবপত্র বৃক্ষের নিকট থেকে পাই। ৬. গাছপালা আবহাওয়া ও জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষা করে। ৭. বৃক্ষ প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে জনজীবনকে সুরক্ষা দেয়। ৮. বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামালে জোগান দেয় বৃক্ষ। ৯. মাটির উর্বরতাশক্তি বৃদ্ধিতে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অসীম।
বাংলাদেশে বনভূমির অবস্থা : প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য কোনো দেশের মোট ভূমির শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে বনভূমি কর্তনের হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৪৭ সালে এদেশের মোট আয়তনের শতকরা ২৪ ভাগ বনভূমি ছিল। ১৯৮০-৮১ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৭.২২ ভাগ। আর বর্তমানে বনভূমি রয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ। এদেশে মাথাপিছু কাঠ ব্যবহারের পরিমাণ ২.৬৮ ঘনফুট। কিন্তু বর্তমানে কাঠের চাহিদার মাত্র ৪৮.৫ শতাংশ নিজস্ব বনভূমি থেকে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। তাই আমাদের দেশে বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম হয়ে পড়েছে।
পরিবেশ রক্ষায় বনায়ন : বর্তমান সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শিল্প-কলকারখানার সম্প্রসারণ, রাসায়নিক তেজস্ক্রিয়তা ও বৃক্ষ নিধনের কারণে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এ বিপর্যয়কে বিজ্ঞানীরা গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া নামে চিহ্নিত করেছেন। যার ফলে পরিবেশে বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, তুষারপাত, ভূমিধসের মতো ভয়াল প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে এসেছে। প্রখ্যাত পরিবেশ বিজ্ঞানী মাইকেল মালিক ফার ইস্টার্ন রিভিউতে একটি মানচিত্রের মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, আগামী শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে এক-দশমাংশ পানিতে তলিয়ে যাবে। ক্রমাগত বৃক্ষনিধনের ফলে ২০৩০ সালে এ দেশে ৮-১০ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। এ বিপর্যয়কে রোধ করতে পারে একমাত্র বনায়ন। তাই আমাদের বনায়ন সম্প্রসারণের প্রতি যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করা উচিত।
বৃক্ষরোপণ অভিযান বা বনায়ন কর্মসূচি : বাংলাদেশ সরকার আমাদের দেশে বৃক্ষরোপণ আভিযানকে একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ব্রিটিশ ভারতে সর্বপ্রথম ১৮৬৯ সালে Imperial Forest Service(IFS)-এর অংশ হিসাবে বন ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম শুরু হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকারিভাবে বনায়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে ও বেসরকারি বনায়নকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ১৯৭১-৮০ এ দশকে ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ১৯৯৪ সাল থেকে বৃক্ষমেলার আয়োজন করা হয়। বেসরকারি উদ্যোগে এদেশে প্রায় ৫ হাজার ৫০০টি নার্সারি গড়ে উঠেছে। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর তৎকালীন সরকার এডিবি-এর সহযোগিতায় ‘উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী প্রকল্প (১৯৯৫-২০০০)’ গ্রহণ করে। এ ছাড়া ব্যক্তি পর্যায়ে বিনামূল্যে বৃক্ষচারা বিতরণ কর্মসূচি, স্বেচ্ছাশ্রমে বৃক্ষরোপণ, বিদ্যালয়ে বৃক্ষরোপণ প্রভৃতি কার্যক্রমের ফলে বনায়নের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বনজসম্পদ উন্নয়নে করণীয়
বৃক্ষরোপণের পাশাপাশি আমাদের দেশে বনজসম্পদ উন্নয়নের অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। বৃক্ষকর্তনের ফলে আমাদের বনভূমি সংকুচিত হয়ে পড়েছে। তাই নিুবর্ণিত উপায়ে বনজসম্পদ উন্নয়ন করা যেতে পারে-
* নির্বিচারে বৃক্ষ কর্তন প্রতিরোধ করা। * নতুন বনভূমি সৃষ্টি করা। * আবাদযোগ্য জমি সৃষ্টি করা। * সরকারি তত্ত্বাবধান জোরদার করা। * বনবিভাগের কর্মচারীদের দুর্নীতি দমন করা। * জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। * বেসরকারি উদ্যোগে বৃক্ষরোপণকে উৎসাহিত করা। * বৃক্ষপ্রেমীদের পুরস্কৃত করা, প্রভৃতি।
বৃক্ষহীনতার অপকারিতা : ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রাজধানী রিও-ডি-জেনেরিওতে পরিবেশ বিষয়ক বিশ্ব শীর্ষ সম্মেলনে ১৭০টি দেশের প্রতিনিধিরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, বিশ্বজুরে যে সর্বনাশা বৃক্ষনিধন চলছে তাতে অতি সন্নিকটেই এ পৃথিবী তার বাসযোগ্যতা হারাবে। বৃক্ষশূন্য পরিবেশ যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তার জলন্ত উদাহারণ উত্তর আফ্রিকা। বৃক্ষ না থাকলে প্রকৃতি পানিশূন্য হয়ে পড়বে। ভয়ানক প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। বাংলাদেশেও এর অশুভ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, মরুকরণ, ঋতুবৈচিত্র্য নষ্ট হওয়া, গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া এ সবই বৃক্ষনিধনের প্রতিক্রিয়া।
উপসংহার : ‘লাগাব বৃক্ষ, তাড়াব দুঃখ’-এ স্লোগানকে সামনে রেখে ব্যক্তিপর্যায়ে বৃক্ষরোপণকে সম্প্রসারিত করতে পারলে হয়তো হৃত গৌরবকে ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে। এই বাংলাকে আবার শস্য-শ্যামলিমায় সুশোভিত করে দোয়েল, কোকিল, শ্যামা শালিকের গানে মুখরিত করে তোলা যাবে। এ জন্য সরকারিভাবে সভা-সেমিনার করে কর্মসূচি বাস্তবায়নে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বৃক্ষ আমাদের অস্তিত্বের ধারক।
