এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের যুক্তিবিদ্যা প্রথমপত্র
আবদুল কুদ্দুস
প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
প্রভাষক, ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ
মোহাম্মদপুর, ঢাকা
যুক্তিবিদ্যা পরিচিতি : সৃজনশীল নমুনা
উদ্দীপক : শিক্ষক যুক্তিবিদ্যার ক্লাসে যুক্তিবিদ্যার স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রথমে বলেন, বিজ্ঞানী নিউটন আবিষ্কৃত মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। একটি আপেলের মাটিতে পড়ার কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে তিনি এ তত্ত্বটি আবিষ্কার করেন। বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয়ের উদ্ভাবনের মতোই এখানেও ছিল সুশৃঙ্খল পদ্ধতির প্রয়োগ। এর পর তিনি বলেন, চিকিৎসাবিজ্ঞানী ইবনে সিনা অনেক রোগীকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। তার এ কাজ ছিল অত্যন্ত নিখুত ও দক্ষ। তিনি যেমন চিকিৎসাবিদ্যার তত্ত্ব উদ্ভাবন করেছেন তেমনি ব্যবহারিক কাজেও ছিলেন পটু।
ক. যুক্তিবিদ্যা কাকে বলে?
খ. এরিস্টটল কেন যুক্তিবিদ্যাকে জ্ঞানের পদ্ধতি নির্দেশকারী প্রারম্ভিক বিজ্ঞান বলেন? ব্যাখ্যা কর।
গ. শিক্ষকের প্রথম দৃষ্টান্তের যুক্তিবিদ্যার প্রকৃতির কোন বিষয়টির মিল রয়েছে? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. তুমি কি মনে কর, শিক্ষকের দৃষ্টান্ত দুটির মাধ্যমে যুক্তিবিদ্যার স্বরূপ ব্যাখ্যা করা যায়? আলোচনা কর।
উত্তর : ক. বৈধ যুক্তি ও অবৈধ যুক্তির পার্থক্যকারী নিয়ম সংক্রান্ত বিদ্যাকে যুক্তিবিদ্যা বলে।
উত্তর : খ. এরিস্টটল যুক্তিবিদ্যাকে জ্ঞানের পদ্ধতি নির্দেশকারী প্রারম্ভিক বিজ্ঞান বলেছেন। তার মতে যুক্তিবিদ্যার কাজ হলো জ্ঞানের পদ্ধতি নির্দেশ করা। জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা-প্রশাখা সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতির অনুসরণ করে, সেটা কলা কিংবা বিজ্ঞান যাই হোক না কেন। আর যুক্তিবিদ্যা চিন্তার বিজ্ঞান হিসাবে এসবের জন্য নিয়মনীতি সরবরাহ করে। যুক্তিবিদ্যার কাজই হলো একটি চিন্তা বা আলোচনা কীভাবে সঠিক প্রক্রিয়ায় ব্যক্ত করা যায় তা নির্দেশ করা কিংবা কীভাবে উপস্থাপন করলে তাকে বৈধ বা অবৈধ বলা যাবে তা বলে দেওয়া। এ কারণেই এরিস্টটল যুক্তিবিদ্যা প্রসঙ্গে এ মন্তব্য করেন।
উত্তর : গ. উদ্দীপকের প্রথম দৃষ্টান্তে বিজ্ঞানের একটি বিষয় তথা মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা এসেছে। যুক্তিবিদ্যার প্রকৃতির মধ্যে বিজ্ঞান ও কলা উভয়ের উল্লেখ এসেছে আর এ দৃষ্টান্তে যুক্তিবিদ্যার বিজ্ঞান হওয়ার বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
আমরা জানি, জ্ঞানের কোনো একটি শাখাকে বিজ্ঞান হতে হলে এর মধ্যে কমপক্ষে দুটি জিনিস থাকবে। প্রথমত, সেই শাখার নির্দিষ্ট ও সুশৃংখল আলোচ্য বিষয়, দ্বিতীয়ত, আলোচ্য বিষয় ব্যাখ্যার জন্য পর্যাপ্ত ও বিধিবদ্ধ নিয়মনীতি। এ দুটি শর্তের বিবেচনায় পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, ভূগোল প্রভৃতিকে যেভাবে বিজ্ঞান বলা যায় একইভাবে যুক্তিবিদ্যাকেও বিজ্ঞান বলা যায়। কারণ, যুক্তিবিদ্যার সুনির্দিষ্ট আলোচ্য বিষয় আছে; যেমন আরোহ পদ্ধতি, অবরোহ পদ্ধতি। আবার এসব বিষয় ব্যাখ্যার জন্য রয়েছে সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি।
যুক্তিবিদ হ্যামিলটন, ম্যানসেল, টমসন প্রমুখ মনে করেন যুক্তিবিদ্যা কেবলমাত্র একটি বিজ্ঞান। তাদের মতে যুক্তিবিদ্যার কাজ হলো যথার্থ যুক্তি পদ্ধতির নিয়ম সরবরাহ করা। অর্থাৎ চিন্তার মূল সূত্র বা নিয়ম বলে দেওয়াই কেবল যুক্তিবিদ্যার কাজ। কাউকে দক্ষ যুক্তিবিদ বানানো যুক্তিবিদ্যার কাজ নয়। তা ছাড়া যুক্তিবিদ্যা কোনো বস্তু নিয়ে কাজ করে না, বরং বিশুদ্ধ গণিতের মতো আকার বা নিয়ম সরবরাহ করে তাই যুক্তিবিদ্যাকে আকারগত বিজ্ঞান বলা হয়। অতএব বলা যায় উদ্দীপকে যুক্তিবিদ্যার বিজ্ঞান হওয়ার ব্যাপারে যে ইঙ্গিত এসেছে তা যুক্তিযুক্ত।
উত্তর : ঘ. উদ্দীপকের দৃষ্টান্ত দুটি হচ্ছে মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব ও অস্ত্রোপচারবিদ্যা সংক্রান্ত। এখানে প্রথমটি হচ্ছে বিজ্ঞানের দৃষ্টান্ত আর দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে কলাবিদ্যার উদাহরণ। যুক্তিবিদ্যার স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যুক্তিবিদ্যাকে যেমনিভাবে বিজ্ঞান বলা যায় তেমনিভাবে কলাবিদ্যাও বলা যায়, আবার বিজ্ঞান ও কলা উভয়ও বলা যায়। নিচে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হলো।
বিজ্ঞান হিসাবে যুক্তিবিদ্যা
বিজ্ঞান বলতে বোঝায় পরীক্ষা নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণলব্ধ সুশৃঙ্খল নিয়মনীতি নির্ভর জ্ঞানকে। যেহেতু যুক্তিবিদ্যার প্রতিটি বিষয় সুশৃঙ্খল নিয়মনীতি নির্ভর এবং তা যুক্তির বৈধতা নির্ণয়কারী নীতি সরবরাহ করে তাই একে চিন্তা ও ভাষার মৌলিক বিজ্ঞান বলা যায়। যুক্তিবিদ টমসন, হ্যামিলটন, ম্যানসেল প্রমুখ এ মতের পক্ষে মন্তব্য করেন।
কলাবিদ্যা হিসাবে যুক্তিবিদ্যা
কলাবিদ্যা বলতে বোঝায় কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য জ্ঞানকে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগের কৌশলকে। অন্তত দুটি শর্তের ভিত্তিতে একটি বিষয়কে কলাবিদ্যা বলা যায়। প্রথমত, সেই বিদ্যাকে কোনো বিশেষ কর্ম সম্পাদনের কৌশল শিক্ষা দিতে হবে; দ্বিতীয়ত, তাকে কোনো বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। যেমন, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করে অস্ত্রোপচারবিদ্যার জন্ম হয়েছে। এ অর্থে এটি একটি কলাবিদ্যা। আবার যুক্তিবিদ্যা আমাদের চিন্তা ও অনুমানের নিয়ম সরবরাহের মাধ্যমে বাস্তবক্ষেত্রে চিন্তার কলাকৌশল শিক্ষা দেয়, তাই যুক্তিবিদ্যা একটি কলা।
যুক্তিবিদ অলড্রিচ প্রমুখ মনে করেন যুক্তিবিদ্যা শুধু কলা। তারা যুক্তিবিদ্যার ব্যবহারিক দিকটিকে গুরুত্বারোপ করেন।
একই সঙ্গে বিজ্ঞান ও কলা হিসাবে যুক্তিবিদ্যা
যুক্তিবিদ মিল হোয়াইটলি প্রমুখ মনে করেন যুক্তিবিদ্যা কেবল বিজ্ঞান কিংবা কলা নয় বরং বিজ্ঞান ও কলা উভয়ের সমন্বিত রূপ। কারণ তাদের মতে যুক্তিবিদ্যা আমাদের যেমন চিন্তার সাধারণ নিয়ম শিক্ষা দেয় তেমনি বাস্তবক্ষেত্রে সেসব নিয়ম যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে শেখায়। এজন্য এটি একাধারে বিজ্ঞান ও কলা। প্রতিটি কলাবিদ্যার একটি উদ্দেশ্য থাকে যুক্তিবিদ্যারও একটি উদ্দেশ্য আছে আর তা হলো সত্যতা প্রতিষ্ঠা। যুক্তিবিদ কার্ভেথরিড বলেন, ‘এটি একটি বিজ্ঞান কারণ তা কতগুলো সার্বিক নিয়ম প্রকাশ করে আবার কলা এ অর্থে যে, সে নিয়মগুলো একটি লক্ষ্য হিসাবে সত্যকে অর্জন করার জন্য প্রণীত হয়।’ মধ্যযুগের যুক্তিবিদ ডান্স স্কটাস যুক্তিবিদ্যাকে সব বিজ্ঞানের সেরা বিজ্ঞান এবং সব কলার সেরা কলা হিসাবে মন্তব্য করেন।
অতএব বলা যায় এতক্ষণের আলোচনায় উদ্দীপক ও পাঠ্যপুস্তকের আলোকে যুক্তিবিদ্যার প্রকৃত রূপ আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
