এইচএসসি পরীক্ষা ২০২৫
উচ্চতর গণিত : অনুশীলনের বিকল্প নেই
ড. মুহাম্মদ খলিলুর রহমান, সহকারী অধ্যাপক, বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা)
প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ফেলো, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন।
উচ্চতর গণিত এইচএসসি পর্যায়ে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অনেকের কাছেই কঠিন বলে বিবেচিত বিষয়। এটি শুধুমাত্র একটি পরীক্ষা পাস করার বিষয় নয়- বরং ভবিষ্যতে গণিত, প্রকৌশল, তথ্যপ্রযুক্তি, পদার্থবিজ্ঞান, অর্থনীতি ইত্যাদি উচ্চতর বিষয় পড়াশোরার জন্য একটি শক্ত ভিত্তি। তবে সঠিক পদ্ধতিতে প্রস্তুতি না নিলে এ বিষয়টি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। উচ্চতর গণিত হলো একটি বিশ্লেষণভিত্তিক ও যুক্তিনির্ভর বিষয়, যা ছাত্রছাত্রীদের যৌক্তিক চিন্তাশক্তি ও সমস্যার সমাধান দক্ষতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। বাংলাদেশে এইচএসসি পর্যায়ে উচ্চতর গণিত কেবল বই পড়া যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন সঠিক কৌশল, ধারাবাহিক অনুশীলন এবং আত্মবিশ্বাস।
পাঠ্যসূচি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখুন
উচ্চতর গণিতের এইচএসসি সিলেবাস বেশ বিস্তৃত এবং এতে রয়েছে :
বীজগণিত (ম্যাট্রিক্স ও নির্ণায়ক, ভেক্টর, বিন্যাস-সমাবেশ)
জ্যামিতি (সরলরেখা ও বৃত্ত)
ত্রিকোণমিতি (ত্রিকোণমিতিক অনুপাত ও সংযুক্ত কোণের ত্রিকোণমিতিক অনুপাত)
ক্যালকুলাস (ফাংশন ও ফাংশনের লেখচিত্র, অন্তরীকরণ ও সমাকলন)
প্রতিটি অধ্যায়ের আলাদা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। তাই সিলেবাসের সবকটি অধ্যায় ভালেভাবে আয়ত্ত করা জরুরি। বোর্ড প্রশ্নপত্র বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় কোন অধ্যায়গুলো থেকে বেশি নম্বরের প্রশ্ন আসে।
অধ্যায়ের ভিত্তিতে প্রস্তুতি কৌশল
ভেক্টর
বিষয়বস্তু সংজ্ঞা স্কেলার ও ভেক্টর পার্থক্য, যোগ-বিয়োগ, ডট ও ক্রস প্রোডাক্ট, কোণ নির্ণয় কৌশল : চিত্র আঁকার অভ্যাস পড়ুন। প্রশ্ন বোঝার যুক্তিসংগতভাবে প্রয়োগ করুন। ভেক্টর প্রক্ষেপ প্রশ্নগুলো বারবার চর্চা করুন।
ম্যাট্রিক্স ও নির্ণায়ক
বিষয়বস্তু : যোগ, গুণ, ইনভার্স, নির্ণায়কের মান নির্ণয়, নির্ণায়কের প্রমাণ, সমীকরণ সমাধান নির্ণয় করতে জানা লাগবে।
কৌশল : প্রতিটি পদ্ধতি আলাদা করে অনুশীলন করুন। ম্যাট্রিক্স ইনভার্স দিয়ে লিনিয়ার সমীকরণ সমাধান আয়ত্ত করতে হবে।
বিন্যাস-সমাবেশ
বিষয়বস্তু : বিভিন্ন সমস্যার বিন্যাস-সমাবেশ হিসাব নিকাশ করা জানতে হবে।
কৌশল : প্রশ্নের ব্যাকরণ বোঝা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভুল প্রয়োগ এড়াতে উদাহরণসহ অনুশীলন করা লাগবে।
ত্রিকোণমিতি
বিষয়বস্তু : ত্রিকোণমিতিক অনুপাতের পরিচয়, ত্রিকোণমিতিক অনুপাতের প্রমাণ, জ্যামিতিক ব্যাখ্যা অনুশীলন করতে হবে।
কৌশল : সব ত্রিকোণমিতিক সূত্র মুখস্থ রাখতে হবে। জটিল সমস্যাগুলোকে ধাপে ধাপে ভেঙে সমাধান করা।
জ্যামিতি
বিষয়বস্তু : সরলরেখা, বৃত্ত, বিন্দু, কোণ, দূরত্ব
কৌশল : স্পষ্ট চিত্র এঁকে সমস্যার মূলে যেতে হবে। সূত্র ব্যবহার ও বাস্তব ব্যাখ্যার সমন্বয় জরুরি।
ক্যালকুলাস
ডিফারেনশিয়েশন : অন্তরীকরণ সূত্র এবং সূত্রের প্রয়োগ, অন্তরীকরণ সহগ বের করার পদ্ধতি, ম্যাক্সিমাম-মিনিমাম নির্ণয়, স্পর্শক-অভিলম্ব, টেলর-ম্যাকলরিন ধারা জানা জরুরি।
ইন্টিগ্রেশন : মৌলিক সমাকলন সূত্র-সূত্রের প্রয়োগ, সমাকলন সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি, নির্দিষ্ট সমাকলনের মান নির্ণয়, ক্ষেত্রফল নির্ণয় বেশি করে অনুশীলন করতে হবে।
কৌশল : নিয়মভিত্তিক অনুশীলনের পাশাপাশি যুক্তিসংগত বিশ্লেষণ চর্চা কর।
নিয়ম চর্চা ও সময় ব্যবস্থাপনা
গণিত একটি অনুশীলননির্ভর বিষয়। আপনি যত বেশি অনুশীলন করবেন, ততই আত্মবিশ্বাসী হবেন। প্রতিদিন অন্তত ২ ঘণ্টা উচ্চতর গণিত চর্চার জন্য নির্ধারিত রাখুন। প্রতিটি অধ্যায়ের উদাহরণ ও ব্যাখ্যা অংশ ভালোভাবে বুঝে নিন, তারপর বহুনির্বাচনি, সৃজনশীল এবং গাণিতিক সমস্যা অনুশীলন করুন।
সময় ব্যবস্থাপনাও অত্যন্ত জরুরি। পরীক্ষার হলে সময়ের মধ্যে সঠিকভাবে প্রশ্ন সমাধান করতে না পারলে ভালো প্রস্তুতিও কাজে আসবে না। এজন্য বাসায় পরীক্ষার অণুকরণে টাইম সেট করে মডেল টেস্ট দিন।
ভুল থেকে শিক্ষা
অনুশীলনের সময় ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভুলগুলো শুধরে নেওয়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একটি ডায়েরি বা খাতায় আপনার করা ভুলগুলো লিখে রাখুন এবং কেন ভুল হয়েছে তা বিশ্লেষণ করুন। এতে ভবিষ্যতে একই ভুলের পুনারাবৃত্তি হবে না।
প্রশ্নপত্র বিশ্লেষণ ও বোর্ড প্রশ্ন অনুশীলন
গত ১০ বছরের বোর্ড প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করে অধ্যায়ভিত্তিক আলাদা করে অনুশীলন করুন। এতে আপনি বুঝতে পারবেন কোন ধরনের প্রশ্ন বারবার আসছে এবং কোন অধ্যায়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। বিশেষভাবে অনুশীলন করুন :
অধ্যায়ভিত্তিক পড়া : একটি শেষ না করে অন্যটিতে যাওয়া উচিত নয়। প্রতিটি অধ্যায় পড়াশেষে বহুনির্বাচনি, সৃজনশীল ও বোর্ড প্রশ্ন সমাধান করুন।
সূত্র ও নিয়ম মুখস্থ : একটি ছোট খাতা রাখুন যেখানে প্রতিটি অধ্যায়ের সূত্র, সংজ্ঞা ও নিয়ম লেখা থাকবে। প্রতিদিন অন্তত ১০ মিনিট সময় দিন রিভিশনে।
হাতে লিখে অনুশীলন : গণিত যত লিখবে, তত বুঝবে। মাথায় রেখে শুধু পড়লে কিছুই হবে না। প্রতিদিন অন্তত ১০টি প্রশ্ন সমাধানের লক্ষ্য রাখুন।
সময় ব্যবস্থাপনা : প্রতিদিন ২-৩ ঘণ্টা শুধু উচ্চতর গণিতের জন্য বরাদ্দ রাখুন।
প্রশ্নপত্র বিশ্লেষণ কৌশল : বোর্ড প্রশ্ন বিশ্লেষণ করুন অন্তত ১০ বছরের। অধ্যায়ভিত্তিক প্রশ্নগুলো ভাগ করে দেখে নিন কোন অধ্যায় থেকে বেশি আসে।
গাণিতিক দক্ষতা বাড়ান
গণিতে দ্রুত হিসাব করা একটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা। মেন্টাল ম্যাথ বা মুখে মুখে গাণিতিক হিসাব করার অভ্যাস তৈরি করুন। এতে সময় বাঁচে ও ভুল কম হয়। এছাড়া অপ্রয়োজনীয় ধাপে সময় ব্যয় না করে সরাসরি ফলাফল লেখার অভ্যাস গড়ুন (শর্তসাপেক্ষে)।
শিক্ষকের সহায়তা নিন এবং গ্রুপ স্টাডি করুন
যেখানে বুঝতে সমস্যা হয়, সেখানে শিক্ষকের সাহায্য নিন। গণিত শিক্ষকরা সমস্যার সহজ ব্যাখ্যা দিতে পারেন। প্রয়োজনে বন্ধুবান্ধব মিলে গ্রুপ স্টাডি করুন। এতে একজন অন্যজনকে শেখাতেই অনেক বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়।
আত্মবিশ্বাস রাখুন ও মনোযোগ ধরে রাখুন
উচ্চতর গণিত অনেক সময় কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু ধৈর্য ধরে অধ্যয়ন করলে এটি সহজ হয়ে ওঠে। আপনি যত বেশি সমস্যার সমাধান করবেন, ততই আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়বে। পড়ার সময় মনোযোগ ধরে রাখা জরুরি। মোবাইল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে দূরে থেকে একাগ্রতার সঙ্গে চর্চা করুন।
পরীক্ষার আগে রিভিশন কৌশল
পরীক্ষার অন্তত ২ সপ্তাহ আগে থেকে শুধুমাত্র রিভিশনে মন দিন। যে অধ্যায়গুলো আপনি আগে পড়েছেন সেগুলো বারবার রিভিশন দিন এবং ভুল করে থাকলে শুধরে নিন। প্রতিদিন একেকটা অধ্যায় রিভাইজ করার একটি রুটিন তৈরি করুন।
মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখুন
পরীক্ষার আগে মানসিক চাপ না নিয়ে শান্ত থাকার চেষ্টা করুন। উচ্চতর গণিত মানসিক স্থিরতা ও স্পষ্ট চিন্তা চাই। প্রতিদিন পর্যাপ্ত ঘুম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করুন। প্রয়োজনে হালকা ব্যায়াম বা মেডিটেশন করতে পারেন।
উপসংহার
উচ্চতর গণিতে ভালো ফলাফল করার জন্য আপনাকে শুধু কঠোর পরিশ্রম নয়, সঠিক পরিকল্পনামাফিক অধ্যয়ন করতে হবে। নিয়মিত অনুশীলন, ভুল বিশ্লেষণ, সময় ব্যবস্থাপনা ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রস্তুতি নিলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। মনে রাখবেন, গণিত ভয় পাওয়ার বিষয় নয়; বরং এটি বুঝে বুঝে চর্চার বিষয়। আপনি যদি ধৈর্য ও নিষ্ঠার সঙ্গে এগিয়ে যান, তাহলে উচ্চতর গণিতে আপনি অবশ্যই সাফল্য পাবেন। উচ্চতর গণিতে সাফল্যের জন্য প্রয়োজন ধারাবাহিকতা, সঠিক কৌশল, আত্মবিশ্বাস এবং ভুল থেকে শেখার মানসিকতা। এ বিষয়টি ভীতি নয়, বরং সম্মানের চোখে দেখুন। যত বেশি অনুশীলন করবেন, তত এটি আপনার বন্ধু হয়ে উঠবে। মনে রাখবেন- গণিত একটি চর্চার বিষয়।
ভিন্নধর্মী প্রস্তুতির টিপস
কৌশল বিস্তারিত
ভুল বিশ্লেষণ যে প্রশ্নে ভুল হয়েছে, কেন ভুল হয়েছে তা লিখে রাখা।
সূত্র চার্ট বিছানার পাশে, ড্রয়িং বোর্ডে সূত্র টাঙিয়ে রাখুন।
সহপাঠীর সাহায্য যা বুঝেন না তা বন্ধুদের সাহায্যে পরিষ্কার করুন।
পাজল ম্যাথ গণিত-ভিত্তিক পাজল ও গেমে যুক্ত থাকলে মনঃসংযোগ বাড়ে।
মনোভাব পরিবর্তন ‘‘গণিতে আমি দুর্বল”- এই ধারণা বাদ দিন। ছোট ছোট সাফল্য উদযাপন করুন।
মনঃসংযোগ পড়ার আগে মোবাইল দূরে রাখুন। প্রতি ২৫ মিনিটে ৫ মিনিট ব্রেক নিন।
ঘুম ও বিশ্রাম পর্যাপ্ত ঘুম ও স্বাস্থ্যকর খাবার আপনার চিন্তাশক্তিকে বাড়াবে। ক্লান্ত মনে গণিত করতে গিয়ে ভুল হলে সময় নষ্ট হবে।
