‘গাজা রিভিয়েরা’ যে কারণে ব্যর্থ হতে চলেছে
শন ম্যাথিউস
প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গাজাকে দুবাইয়ের মতো একটি এলাকায় পরিণত করার যে ইসরাইলি পরিকল্পনা করা হয়েছে, তা শুধু ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির বিষয়টিকে আড়াল করলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনৈতিকভাবেও শুরু থেকেই এটি অসাধ্য হতে পারে, যদি না বিনিয়োগকারীরা চোখ-কান বুজে টাকা ঢালতে রাজি হন। জাতিসংঘের একটি বিশ্লেষণ বলছে, গাজার প্রায় ৪ কোটি ২০ লাখ টন ধ্বংসাবশেষ সরাতেই ৬০০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে যাবে। এরপর পয়ঃনিষ্কাশন, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ শুরুর আগের যে খরচ, অর্থাৎ যার ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতে ঝলমলে আকাশচুম্বী ভবন নিয়ে শহরটি গড়ে উঠবে, সেটিও কম নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গাজায় ইসরাইলের বোমা হামলার তীব্রতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির নাৎসি জার্মানির ওপর চালানো বোমা হামলার সঙ্গে তুলনা করতে গেলে সম্ভবত তাকেও ছাড়িয়ে গেছে। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির স্থাপত্য ইতিহাসের অধ্যাপক মার্ক জারজমবেক, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন নিয়ে গবেষণা করেছেন, তিনি বলছেন, এ তুলনা সেখানেই থেমে যায়। যেমন, জার্মানিকে মার্শাল প্ল্যানের মাধ্যমে পুনর্গঠন করা হয়েছিল। এ মার্কিনসমর্থিত কর্মসূচির আওতায় যুদ্ধের পর পশ্চিম ইউরোপকে পুনর্গঠনের জন্য ঋণ দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু মার্শাল প্ল্যানের অর্থায়ন মূলত জার্মান রাষ্ট্রের শিল্পভিত্তিক প্রকৃতির ওপর নির্ভর করেছিল। ঋণ শোধ করার জন্য জার্মানি রপ্তানি কেন্দ্র হয়ে ওঠে। যুদ্ধের আগে গাজায় কী ছিল : জলপাই আর মাছ? প্রশ্ন হলো, কোন ধরনের রাষ্ট্রীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান এতে অর্থায়ন করবে?
এ পরিকল্পনার ৩৮ পৃষ্ঠার একটি স্লাইড ডেক প্রথমে দ্য ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত হয়েছিল, এরপর দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করা হয়। এ প্রস্তাবের নেতৃত্বে ছিলেন মাইকেল আইজেনবার্গ, যিনি একজন ইসরাইলি-আমেরিকান ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট এবং লিরান টানকম্যান, যিনি একজন ইসরাইলি প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ও সাবেক সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা। কিছু মানুষ এ প্রস্তাবকে গুরুত্ব সহকারে দেখছেন; কারণ গাজায় তাদের প্রকল্প সফল করার পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ দুজন সেই ইসরাইলি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের একটি অনানুষ্ঠানিক দলের অংশ ছিলেন, যারা ২০২৩ সালের শেষের দিকে এখন ব্যাপকভাবে সমালোচিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ধারণা দিয়েছিলেন।
এ পরিকল্পনাটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি প্রস্তাবের প্রতিধ্বনি, যা নিয়ে তিনি এখন জনসম্মুখে আলোচনা বন্ধ করে দিয়েছেন। সেখানে তিনি ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। প্রস্তাব অনুযায়ী, ফিলিস্তিনিদের ‘স্বেচ্ছায়’ গাজা ছেড়ে একটি সীমিত এলাকায় অস্থায়ী বাসস্থানে চলে যেতে উৎসাহিত করা হবে। জারজমবেক বলেন, এ পরিকল্পনাটি গাজাকে ইসরাইলের একটি ‘ধূলিসাৎ অঞ্চলে’ পরিণত করার নিষ্ঠুরতার আড়াল মাত্র। প্রথমে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা হবে, তারপর তাদের সরানো হবে। কারণ উন্নয়নের নামে, বাস্তুচ্যুত মানুষের দিকে কেউ ফিরেও তাকাবে না।
এমইই এ পরিকল্পনার আরও কল্পিত দিকগুলো তুলে ধরেছিল, যার মধ্যে ইলন মাস্কের একটি স্মার্ট সিটিও রয়েছে। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল, এর ১০০ বিলিয়ন ডলারের মূল্য ট্যাগ। প্রস্তাবকরা বলেছেন, এ পরিকল্পনার জন্য কোনো মার্কিন তহবিলের প্রয়োজন হবে না, বরং এটি ‘সরকারি ও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের’ ওপর নির্ভর করবে। কিছু বিশ্লেষক অবশ্য মনে করেন, খুব বেশি জাঁকজমক না করলেও এ ধরনের একটি শহর তৈরির জন্য এ মূল্য ট্যাগটি বাস্তবসম্মত হতে পারে, যা এ অঞ্চলের অন্যান্য প্রকল্পের ওপর ভিত্তি করে বলা যায়।
উদাহরণস্বরূপ, সংযুক্ত আরব আমিরাত মিসরের ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলের একটি বিশাল অঞ্চলের উন্নয়নের অধিকারের জন্য ৩৫ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। মিসরের নতুন প্রশাসনিক রাজধানী, যা মরুভূমিতে একেবারে নতুন করে তৈরি করা হয়েছে, তার আনুমানিক খরচ ৬০ বিলিয়ন ডলার। রাইস ইউনিভার্সিটির বেকার ইনস্টিটিউটের মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ জিম ক্রেন বলছেন, ইসরাইলি পরিকল্পনাটি স্পষ্টতই তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশগুলোর কাছে তুলে ধরা হচ্ছে, কিন্তু তারা হতাশ হতে পারেন। ক্রেন, যিনি ‘সিটি অব গোল্ড : দুবাই অ্যান্ড দ্য ড্রিম অব ক্যাপিটালিজম’র লেখক, তিনি বলছেন, এখন তেলের দাম যেখানে আছে, সেখানে গাজার পুনর্গঠনের জন্য প্রচুর বিদেশি পুঁজি নেই।
আরব বিশ্বের একমাত্র জি-২০ অর্থনীতির দেশ সৌদি আরব তার ‘ভিশন ২০৩০’ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময়সীমা পূরণে হিমশিম খাচ্ছে, যেখানে তাদের অনেক ভবিষ্যৎমুখী প্রকল্প রয়েছে। দেশটি সেসব প্রকল্প এগিয়ে নেওয়ার জন্য রেকর্ড পরিমাণ ঋণের ওপর নির্ভর করছে, এদিকে অন্যান্য প্রকল্পগুলোও পিছিয়ে যাচ্ছে।
*মিডল ইস্ট আই থেকে অনূদিত
শন ম্যাথিউস : সাংবাদিক, মিডল ইস্ট আই
