Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

চীন-ভারত সম্পর্ক কি ঘনিষ্ঠতার দিকে

Icon

গৌতম দাস

প্রকাশ: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চীন-ভারত সম্পর্ক কি ঘনিষ্ঠতার দিকে

শেষের কথাটা আগেই যদি বলি তবে এই শিরোনাম প্রশ্নের ছোট জবাব হলো, না। সম্পর্ককে গভীর ঘনিষ্ঠতা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া মোদির ভারতের পক্ষে সম্ভব হবে না। মূল কারণ, ভারতের নিজ দোদুল্যমানতা। আর ভারত এমনই থাকতে চায়। যেমন তারা বলে বা মনে করে থাকে যে চীন আর আমেরিকার মাঝে দোল খেয়ে দুদিক থেকেই মাখন খাওয়া যাবে। এটা তো তাদের ২০১৩ সালের সিদ্ধান্ত, যখন ভারত চীনে প্রথম বেল্ট-রোড সম্মেলনে দাওয়াত পেয়েছিল, কিন্তু অংশ না নিয়ে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল; তখন থেকেই ভারত এরকমই দায়দায়িত্বহীন সুবিধা চোষা! ঠিক এ কারণেই এখনকার ট্রাম্পের শুল্ক-বোঝায় পর্যুদস্ত ও মার খাওয়া ভারত এতকিছুতে নাস্তানাবুদ হয়েও আবার ইতোমধ্যেই ওই ট্রাম্পের কোলেই গিয়ে আশ্রয় খোঁজা শুরু করেছে; আর তাতে বলাই বাহুল্য, এই ভারত এখন চীনের আস্থা অর্জন পর্যন্তই উঠতে পারছে না, পারবে না।

এবার আস্তে আস্তে ঘটনাবলির ভিতরে প্রবেশ করা যাক। একদম ঠিক এখন চীন-ভারত সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতা নিয়ে মিডিয়ায় আলোচনা তুঙ্গে। এর একটা অন্যতম কারণ হলো, ঠিক এখনই এবারের বার্ষিক এসসিও (সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন) সম্মেলনের সময়কাল ছিল। ফলে সদ্য আমেরিকার ট্রাম্পের ছুড়ে ফেলে দেওয়া মোদির ভারতকেও চীন এসসিও-তে আন্তরিকভাবে দাওয়াত দিয়ে কাছে ডেকে নিয়েছিল।

পাশাপাশি সেই সঙ্গে এই ট্রাম্পও প্রায় সব দেশের ওপর কঠোর শুল্কনীতি প্রয়োগ করেছেন। শুরুতে তা চীনের ওপর ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি চীনকে শুল্ক-আরোপ করে পর্যুদস্ত করে ফেলার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু তাতে বাস্তবে ফলাফল উল্টা আসায় আর সঙ্গে আমেরিকার নিজস্ব সরকারি বন্ড বিক্রির ক্রেতা সংকট বা বাজারে ক্রেতা উধাও হওয়া শুরু হতেই ট্রাম্পকে পিছে হটতে হয়। তিনি বাধ্য হয়ে গত জুন মাসেই অনেক ইস্যুতে সরাসরি চীনের সঙ্গে এক ধরনের আপস করে ফেলেন।

অনুমান করা যায়, এ ঘটনা থেকেই চীন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবারের এসসিও সম্মেলনটি বিরাট জাঁকজমকপূর্ণ এক সামরিক শো-আপ করে করবেন!

সামরিক শো-আপ কেন

অনেকেই খেয়াল করেছেন যে এই সামরিক শো-আপে সম্ভবত ২৬ দেশের প্রধান ব্যক্তিত্বদের (রাষ্ট্রপ্রধান নয়তো প্রধান নির্বাহী অথবা ন্যূনপক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের) একটি দলকে সঙ্গে নিয়ে চীনা প্রেসিডেন্ট শি হেঁটে যাচ্ছেন, যার দুপাশে হাঁটছেন একদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন আর অন্যদিকে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম-জং-উন!

এসবের মধ্যে আরেক বৈশিষ্ট্য ছিল প্রেসিডেন্ট শির ‘পোশাক’। তিনি পরেছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির বিশেষ ড্রেস, যেটা মাওকেই সবসময় পরতে দেখা যেত। প্রেসিডেন্ট শি একালে নিয়মিত নরমাল পোশাক পরলেও সেদিন ছিলেন একেবারেই পার্টি ড্রেস-কোডে সজ্জিত! এসব থেকেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল, বিশেষ ‘অর্থ ও প্রতীকের’ মাধ্যমে এবারের এসসিও সম্মেলন পালন করার পরিকল্পনা নিয়েছিল চীন।

গত বিশ বছর চীন সামরিক দিক থেকে কী কী খাতে ব্যাপক অর্থ ব্যয় করে নিজেকে সজ্জিত করে চলছিল তা জনসমক্ষে আনেনি; এদিনটা ছিল আসলে সেটারই প্রদর্শনী ও মহড়া। যে মহড়ায় আবার বেশির ভাগ অস্ত্র-সরঞ্জামই হলো নিউক্লিয়ার এনার্জি-সংশ্লিষ্ট!

এখানে একটা কথা আশা করি অতি-উক্তি হবে না যে, এর ফলে এসসিও পারমাণবিক অস্ত্রের প্রদর্শনীতে পরিণত হলো। কিন্তু এমন কেন? বিশেষ করে অনেকেরই অজানা হয়তো যে চীন-চীন সাগর/দুই কোরিয়ার উপকূল এলাকাকে অ-পারমাণবিক জোন হিসাবে ঘোষণা করা যায় কিনা এরই একক প্রস্তাবক হলো চীন নিজেই!

তাহলে এই চীনা আচরণের ব্যাখ্যা কী

মনে রাখতে হবে, কোনো রাষ্ট্রের অন্য রাষ্ট্রের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ (যেখানে গ্লোবাল নয়া অভিমুখ হলো শুল্ক কমানো, ৮ শতাংশের মধ্যে রাখা) মানেই এটা হলো আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য যেটা আসলে গ্লোবাল বাণিজ্যের বিকাশ অভিমুখকে পাথর চাপা দিয়ে গ্লোবাল বাণিজ্যের আমদানি-রপ্তানির পিঠে সরাসরি ছুরিকাঘাত! যেটা অর্থনৈতিক সংরক্ষণবাদিতা বা অর্থনৈতিক উগ্র-জাতীয়বাদিতা! সর্বোপরি এটা আত্মঘাতী! গত ১৯৮০ সাল থেকে পথচলা শুরু এই বৈশ্বিক বাণিজ্যব্যবস্থায় এখন আর পিছনের দিকে ফেরা যা অর্থনৈতিক উগ্র-জাতীয়বাদিতা সেদিকে গন্তব্য ঠাউরানোর আর সুযোগ নেই। এতে সবার আগে নিজ অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবচেয়ে বেশি!

ট্রাম্পের বাড়তি শুল্কনীতির খাঁড়া-অর্থ এটাই! যদিও ট্রাম্প ভাবছেন, আমেরিকাকে ছাড়িয়ে শীর্ষ উদ্বৃত্ত অর্থনীতির দেশ হিসাবে উঠে আসা চীনের অগ্রগতি এভাবেই ঠেকাতে পারবেন! অথচ তিনি খেয়াল করছেন না, আমেরিকার পিছিয়ে পড়া বা একঘরে হয়ে যাওয়ার পথেই হাঁটছেন তিনি!

আর এ থেকে চীনের অনুমিত ভয় হলো, হেরে গিয়ে শেষে পাগলামি করে না পাগলা ট্রাম্প যুদ্ধ লাগিয়ে দেন; ব্যর্থতা ঢাকার কোন ব্যর্থ চেষ্টায়!

ফলে আমার অনুমান পাগলা ট্রাম্প যেন সেদিকে যেতে প্ররোচিত না হয়ে যান, তাই আগেই চীন নিজ সামরিক প্রস্তুতির প্রদর্শন করে রাখলেন। বিশেষ করে চীন যেন বোঝাতে চাইল, সামরিক দিক দিয়ে ট্রাম্প ও তার সহচররা পরিচালিত হতে যেন উৎসাহী না হয়ে যায়। আর সেটারই একটা কসরত ইনডাইরেক্ট ফ্রি কিক যেন মেরে রাখল চীন! যেমন প্রেসিডেন্ট শি নিজের দুপাশে রাশিয়া আর উত্তর কোরিয়া নিয়ে দলবদ্ধ হাঁটার প্রতীকী অর্থ আমার কাছে এমনই মনে হয়েছে। যারা দুদেশ মূলত পারমাণবিক দিক থেকে খুবই সামরিক সজ্জিত!

এক কথায় এর প্রতীকী সম্ভাব্য উদ্দেশ্য হলো, পাগলা ট্রাম্পকে ডিসকারেজ (নিরুৎসাহিতার প্রভাব) করে ফেলা!

এবার দ্বিতীয় অংশ

অথচ চীন সেই সম্মেলনে ভারতকেও আদর করে ডেকেছিল আর তাতে গলে গিয়ে দীর্ঘ সাত বছর পরে এই ওছিলায় খোদ মোদি এবার চীন সফরে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট শির ওই দলবদ্ধভাবে প্রতীকী হাঁটার মিছিলে শির আশপাশে মোদির স্থান হয়নি।

বরং বিপরীত পর্দায় আমরা দেখেছিলাম মোদির বাণিজ্যমন্ত্রী পীযুষ গোয়েলকে! কী করেছেন তিনি? তিনি আমাদের জানিয়েছেন, ট্রাম্পের সঙ্গেই ভারতের শুল্ক আলাপ নাকি এখনো চলছে। আর তিনি আশা করছেন, মোদির ভারত আবার সেই ট্রাম্পের কোলেই মুখ গোঁজার পরিকল্পনা করছে। আর তাতে তিনি দাবি করেছেন, নভেম্বরের মধ্যেই আমেরিকার সঙ্গেই আবার একটা রফায় পৌঁছাতে পারবেন!

এই হলো ভারতের মোদি! তিনি ট্রাম্পের কোলে উঠে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে চীনের কাছে সুবিধা চাইবেন, আবার পরক্ষণেই চীনের কোলে উঠে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে ট্রাম্পের কাছে সুবিধা ভিক্ষা করবেন। এভাবেই তিনি এখনো চলতে চান, এটাই আসল ভারত! গত ২ সেপ্টেম্বর ভারতের ‘ফরচুন ইন্ডিয়া’ পত্রিকার রিপোর্টের শিরোনাম পীযুষ গোয়েল আশা করছেন, আগামী দুমাস নভেম্বরের মধ্যে ট্রাম্পের সঙ্গে একটা রফাতে নয়া শুল্ক-চুক্তিতে পৌঁছানো যাবে!

কিন্তু বাস্তবতা কি তাই হবে? মনে হচ্ছে না। মূল কারণ এটা ২০১৩ সাল নয়, ২০২৫ সাল! চীন-আমেরিকা দুদিক থেকেই সেকালের মতো মাখন খেয়ে ভারত উপরে উঠে যাবে-সেই তত্ত্ব-এখন আর এত সহজে খাটবে না। এটারই প্রথম প্রতিফলন হলো, প্রেসিডেন্ট শি দুপাশে পুতিন আর কিমকে নিয়ে হাঁটছেন অথচ আশপাশে মোদির কোনো ছায়াও দেখা যাচ্ছে না-এই প্রতীকী দৃশ্যে!

গৌতম দাস : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম