অন্যমত
জাতীয় সংস্কার ও অর্থনীতির ভবিষ্যৎ
আবু আহমেদ
প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে দেশের অর্থনীতি যে তিলে তিলে বিধ্বস্ত হয়েছে, সেটা ৫ আগস্ট ২০২৪-এর আগে কেউ হয়তো বুঝতে পারেনি। যতই দিন গেছে, ততই অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, সেটা সবার কাছে এখন পরিষ্কার। যা হোক, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়েছে। স্বেচ্ছাচারিতার হাত থেকে জাতি মুক্তি পেয়েছে। হতাশার গ্লানি থেকে মুক্ত হওয়া এ জাতিকে সামনে এগিয়ে নিতে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। অনেক সংস্কার কার্যক্রম তারা হাতে নিয়েছেন। এ সরকারের এক বছরেরও অধিক কাল অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। প্রশ্ন আসতে পারে, এ সরকার কী কী সংস্কার বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছে? হ্যাঁ, আপাতদৃষ্টিতে সংস্কার দৃশ্যমান না হলেও কিছু কিছু জায়গায় সংস্কার হয়েছে, বলাই বাহুল্য। আসলে হুট করেই সবকিছু হয়ে যায় না, যে কোনো কাজ এগিয়ে নিতে হলে সময়ের প্রয়োজন। সংস্কার প্রস্তাবগুলো দেওয়া হয়েছে, এগুলোর ইমপ্লিমেন্টেশনের ব্যাপার আছে।
ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা ৫ আগস্ট পেয়েছি। সুতরাং জুলাই সনদকে একটা আইনি স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। কারণ জুলাই সনদের যদি আইনি ভিত্তি না থাকে, তাহালে এর কোনো মূল্য থাকে না। এটা শাসনতন্ত্রের একটা অংশে জায়গা পেলে সবচেয়ে ভালো হতো। এ ব্যাপারে রাজনীতিকদের একমত হওয়া উচিত। কিন্তু তারা একমত হতে পারছে না। কেন পারছেন না, সেটা আমার জ্ঞানের সীমায় নেই। জুলাই সনদ একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। সুতরাং দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসাবে এ ব্যাপারে বিএনপির উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল।
অর্থনীতির কিছু কিছু জায়গায় সংস্কার হয়েছে। অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় সংস্কার হতো যদি কয়েকটি দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা যেত। ব্যাংক একীভূত করার কার্যক্রমটি বেশ ধীরে এগোচ্ছে। এটা কবে কখন বাস্তবে রূপ নেবে, সেটা আমাদের অজানা। তবে এদেশে ব্যাংক একীভূতকরণের উদাহরণ খুব একটা নেই বললেই চলে। আরেকটি পথ আছে সেটা হলো, না চলতে পারা দুর্বল ব্যাংকগুলো বন্ধ করে দেওয়া। ব্যাংক ও অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যাদের নিজেদের চলার সক্ষমতা নেই, তাদের জোর করে চালানোর কোনো দরকার নেই। এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া উচিত। সারা বিশ্বে শত শত লিজিং কোম্পানি, ব্যাংকিং কোম্পানি, বিমা কোম্পানি সক্ষমতা না থাকার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের দেশে কোনোটিই বন্ধ হতে দেওয়া হবে না, এটা তো ঠিক নয়। এগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হওয়া উচিত। যারা তাদের ব্যবসায় ফেল করেছে, তাদের নিজেদেরই সেটা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। আসলে এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেওয়ার আগে কতগুলো পলিসি ঠিক করা উচিত ছিল। যেমন, কোনো কারণে যদি ব্যাংক, বিমা ও লিজিং কোম্পানির মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়, তাহলে যারা এসব প্রতিষ্ঠানের স্পন্সর তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ক্রোক করা যাবে। আমি জানি না এ ব্যাপারে এ ধরনের আইন আছে কিনা। আসলে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা অনেকেই ব্যাংক-বিমা খোলার জন্য খুব সহজেই অনুমতি পেয়ে যায়। আর এ সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে অনেকে সাইনবোর্ড টানিয়ে নামসর্বস্ব আর্থিক প্রতিষ্ঠান খুলে প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অনেকে আবার এ টাকা বিদেশেও পাচার করে দিয়েছে। এটা ব্যাংক খাতেও হয়েছে, বিমা খাতেও হয়েছে এবং লিজিং কোম্পানি খাতেও হয়েছে। বাংলাদেশ এ ধরনের প্রতারকচক্রে ভরে গেছে। সুতরাং আমাদের নীতিনির্ধারকদের এ ব্যাপারে আরও সাবধান হতে হবে। এখন এ ব্যাপারে কী ধরনের সংস্কার আসবে আমি জানি না। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়গুলোকে দেখভাল করছে, তবে ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পাহাড় জমেছে। এগুলোকে সামাল দেওয়া খুব একটা সহজ কাজ নয়। অবশ্য অর্থনীতির গতি মন্থর হলে খেলাপি ঋণ বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক।
যা হোক, দেশে চুরি-চামারি অনেকটাই বন্ধ হয়েছে। অবশ্যই এটা একটা ভালো দিক। অর্থাৎ আগের মতো পুকুরচুরি আর হচ্ছে না। ব্যাংক খাত, বিমা খাত ও লিজিং প্রতিষ্ঠানগুলোতে লুটপাটতন্ত্র অনেকটাই বন্ধ হয়েছে। বলতে গেলে একটা বড় সংস্কার হয়েছে এখানে। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব বিষয় দেখভাল করছে। আর বর্তমান সময়ে কেউ লুটপাট করার সাহসও করবে না। কারণ, আগে যে লুটপাট হয়েছে সেটা রাজনৈতিক আশ্রয়ে হয়েছে। অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে কোনো ব্যক্তি বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান জনগণের টাকা সহজে মেরে দিতে পারে না। গত ১৫ বছরে সরকারের আশীর্বাদের বলয়ের মধ্যে থেকেই এ ধরনের অকাজগুলো হয়েছে। কোনো বড় ব্যবসা সরকারের আশীর্বাদ ছাড়া এদেশে কেউ করতে পারেনি। সেটা কমোডিটি মার্কেটে হোক, ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে হোক, বিদ্যুৎ খাতে হোক বা ব্যাংক খাতেই হোক। কোনো দেশেই এমন পরিস্থিতি হওয়া উচিত নয়। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা হয়েছে। সরকারপ্রধানকে তোয়াজ করে ব্যবসা করতে হবে, বা সরকারপ্রধানের আশপাশে যারা থাকে, তাদের সন্তুষ্ট করে ব্যবসা করতে হবে, এটা কখনোই কাম্য হতে পারে না। এগুলো এখন আমাদের কালচার হয়ে গেছে। এগুলোতে আমরা সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সুতরাং সরকারের পলিসিতে থেকে এ ধরনের বলয় বৃত্ত ভেঙে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। সরকারকে এ ব্যাপারে নিউট্রাল হতে হবে। তা না হলে আগামীর বাংলাদেশ ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংক তার দায়িত্ব যথারীতি পালন করে যাচ্ছে। আশার কথা হচ্ছে, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা বাড়ছে। রিজার্ভ এখন ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ডলারের বিনিময় হার অনেকটাই স্থিতিশীল আছে। নিশ্চয়ই এগুলো আমাদের অর্জন। তবে ব্যাংক খাতে দুর্বলতা এখনো কাটেনি। নীতিনির্ধারকরা যদি মনে করেন, কয়েকটি দুর্বল ব্যাংককে সবলের সঙ্গে একীভূত করতে পারলে এর সমাধান হবে, তাহলে করুন। তবে সেখানে মূলধনের যে ঘাটতি থাকবে, সেটা আবার সরকারকেই দিতে হবে। বিদেশে যারা ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে বা যারা ফাইন্যান্সিয়াল সাপোর্ট করে, তারা প্রতিষ্ঠান চালাতে না পারলে ডিপোজিটররা ঠকে যায়। হয়তো ডিপোজিটরদের জন্য কিছুটা ইন্স্যুরেন্স কাভারেজ থাকে ওখানে। তাই তারা ইন্স্যুরেন্স থেকে কিছুটা ক্ষতি হয়তো পুষিয়ে নিতে পারে। আমাদের এখানে তো ইন্স্যুরেন্স কাভারেজ নেই। আমাদের ইন্স্যুরেন্স সেক্টর নিজেই সংকটকবলিত। সুতরাং এখানে সে সুযোগ নেই।
যা হোক, এখন অনলাইনের বদৌলতে প্রায় সবকিছুই সবার নজরে এসে যাচ্ছে। এখন কোনো কিছুই আর লুকানো যাচ্ছে না। আমি মনে করি, যারা বর্তমানে ক্ষমতায় আছেন, তারা দেশের কল্যাণের জন্য যেভাবে দরকার সেভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে রাজনৈতিক সরকার এলে হয়তো কিছু পলিসিগত পরিবর্তন আসবে। এ পরিবর্তন যেন জনকল্যাণমুখী হয়, আমরা সেই প্রত্যাশাই করি।
শেয়ারবাজারে আগের মতো জুয়া খেলার সিন্ডিকেটগুলো আর নেই। এখন মার্জিন লোনও খুব কড়াকড়ি। কোনো শেয়ারের দাম যদি অযাচিত বা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বৃদ্ধি পায়, তাহলে সেটা নিজেদের রিস্কেই হচ্ছে। বিনিয়োগকারীরাই এটার রিস্ক নেবে। কারণ মার্জিন লোনকে একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বি গ্রুপ আর জেড গ্রুপ কোনো মার্জিন লোনই এখন আর নেই। এগুলো নিঃসন্দেহে ভালো পদক্ষেপ। নতুন আইপিও আসেনি। তবে সরকারি শেয়ারগুলো বিক্রি করার জন্য বা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করার জন্য অনেক আগেই সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। এগুলো নিয়ে কিছুটা অগ্রগতিও হয়েছে। কিন্তু এগুলো বিক্রির বিষয়টি অনেক আগেই শুরু হওয়া উচিত ছিল। এ বিষয়গুলো সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও জানে, অর্থ মন্ত্রণালয়ও জানে। সুতরাং তাদের থেকে এ ব্যাপারে একটা ভালো পদক্ষেপ আমরা আশা করি। শীর্ষ পর্যায় থেকে যে ৫ থেকে ৭টি নির্দেশনা এসেছে, সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবে রূপ নিক, আমরা সেটাই কামনা করি। শেয়ারবাজার এখন যে পর্যায়ে আছে, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, কোয়ালিটি স্টক সাপ্লাই যদি না দেওয়া হয়, তাহলে এর ব্যাপ্তি ঘটানো সম্ভব হবে না। অথবা লাভের জন্য বা শেয়ারবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের জন্য যেমন মার্কেট দরকার, সেটা হবে না। গত সাড়ে ১৫ বছরে লিজিং সেক্টর বলি, ব্যাংকিং সেক্টর বলি-এগুলোর মধ্যে অনেকই ছিল ফেক ইন্ডাস্ট্রি। যেমন বিমা খাতে ভালো কোনো কোম্পানির আবির্ভাব হয়নি। যেগুলো হয়েছে, সব ফেক হয়েছে। বর্তমান কমিশন অবশ্য এ বিষয়গুলো সঠিকভাবে তদারকি করছে। সামনে পাবলিক ইস্যু আইপিও রিলেটেড একটা নীতিমালাও আসবে। তবে এগুলো আসছে ধীরে ধীরে। এখন শেয়ারবাজারের বিষয়টি উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সবাই জানে। এটা একটা ভালো দিক। কারণ কোথায় সমস্যা হচ্ছে, কেন হচ্ছে, শেয়ারবাজার কেন এগোচ্ছে না, কী করা দরকার-এগুলোর ব্যাপারে এখন সবার কাছেই তথ্য আছে। এগুলো এনবিআরও জানে, অর্থ মন্ত্রণালয়ও জানে এবং আমাদের প্রধান উপদেষ্টা মহোদয়ের দপ্তরও জানে। সুতরাং ইচ্ছা করলেই কোনো কিছু লুকানো সম্ভব নয়। এটা আমাদের অর্থনীতির জন্য অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। (অনুলিখন : জাকির হোসেন সরকার)
আবু আহমেদ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ; চেয়ারম্যান, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ
