ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সম্প্র্রতি নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি অলির পদত্যাগের পর দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি নতুন দিকে মোড় নিয়েছে। রাজতন্ত্রের অন্ধকার থেকে গণতন্ত্রের উজ্জ্বল আলোর দিকে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন অলি। কিন্তু তিনি দুর্নীতি, অভ্যন্তরীণ কোন্দল সংসদীয় সংকট সামাল দিতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। এর মাধ্যমে আশাহত করেছেন দেশটির জনগণকে। মানুষের ক্ষোভ এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে, দেশের বড় বড় শহরে নতুন করে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠেছে। কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর কড়াকড়ি আরোপের কারণে এমন বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে, মনে করলে বড় ধরনের ভুল করা হবে। দীর্ঘদিনের অপ্রাপ্তির ক্ষোভই এমন ক্রোধে পরিণত হয়ে বিস্ফোরিত হয়েছে।
অবশ্য নেপালের এই সংকটকে গভীরভাবে বুঝতে গেলে হিসাবের কিছু গন্ডগোল তো হয়েই যায়। দেখা যাচ্ছে, তরুণদের এই বিক্ষোভের মধ্যে কেবল বামপন্থি শক্তিগুলোই নয়, বরং রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবিতে আন্দোলনকারী চরম ডানপন্থি হিন্দুত্ববাদীরাও সক্রিয়।
দেশজুড়ে সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সম্পূর্ণরূপে বন্ধের জের ধরে নেপালের উদ্ভূত পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কল্যাণে নজর কেড়েছে বিশ্ববাসীর। অনেকের মনেই প্রশ্নের জন্ম দেয়, সদা শান্ত নেপালের এই সংকটের মূল কারণ কী? নেপালের তথাকথিত কমিউনিস্ট এবং কংগ্রেস নেতারা ব্যাপক জনসমর্থন পেলেও আজ কেন তাদের এ হাল? কেপি অলির পদত্যাগের মধ্য দিয়ে কি দেশটিতে শান্তি ফিরবে, নাকি এটি দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতার সূচনা মাত্র? ক্ষুব্ধ, বিরক্ত, বিশ্বাসভঙ্গে আশাহত নেপালের মানুষ যেমন হিসাব মেলাতে এখন চাইছেন; এই একই কাজে ব্যস্ত অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকও।
আদতে রাজনীতির ব্যর্থতা আর তাতে জনগণের বিশ্বাসভঙ্গ এবং জনগণের প্রত্যাশা ও রাজনৈতিক নেতাদের কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে তা কবর রচনার ভেতর রয়েছে বিশাল ব্যবধান। দেশটির পরিবর্তিত রাজনীতির হালের টাইমলাইন বলছে, নেপালের কমিউনিস্ট এবং কংগ্রেস নেতারা ব্যাপক জনসমর্থন পেলেও পরে ক্রমেই দুর্নীতির জালে জড়িয়ে পড়েছেন আষ্টেপৃষ্ঠে। হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে রাজতন্ত্রের অবসান হলেও ভূমি সংস্কার বা শিল্পের জাতীয়করণের মতো কোনো মৌলিক পরিবর্তন দেশটিতে হয়নি। এর পরিবর্তে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধোঁকা দিতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা নিজেদের মধ্যে একটি ক্ষমতাকেন্দ্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন, যেখানে ক্ষমতার খেলায় কেবলই জোট গঠন ও ভাঙা হয়। বিশ্বাসভঙ্গের এই যন্ত্রণা কেমন, মাওবাদী যেসব কর্মী তাদের দল থেকে যোজন যোজন দূরে-জীবনের ক্ষয়ে যাওয়া সময়ের হিসাব মেলাতে ব্যস্ত, তাদের মুখ থেকে বের হয়ে গণমাধ্যমের পাতায় উঠেও এসেছে কখনো কখনো। যখন সাবেক কোনো কর্মী বলেন, ‘আমার নেতা বদলে গেছেন। আমার দলও বদলে গেছে। তাই আমিও আর আগের মতো নেই।’ এমন কথা যখন নানাভাবে ঘুরেফিরে একাধিক সক্রিয় কর্মীর মুখ থেকে বের হয়, বুঝতে কষ্ট হয় না, এটি কেবল মুষ্টিমেয় ব্যক্তির কথা নয়, এটি পুরো নেপালের সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্নের অপমৃত্যু এবং বিশ্বাসের কবর রচনা করার এক করুণ প্রতিচ্ছবি।
রাজতন্ত্র কি তবে বিকল্প হতে পারে?
নেপালে চলমান পরিস্থিতির মধ্যে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার যে চেষ্টা চলতে দেখা যাচ্ছে, তা বিপজ্জনক পদক্ষেপ হিসাবে দেখছেন কেউ কেউ। অবশ্য দেখার অনেক কারণও আছে। দুনিয়াজুড়ে শাসনব্যবস্থার যে পরিবর্তন হয়েছে, তাতে দেশটিতে রাজতন্ত্র কোনোভাবেই বিকল্প শাসনব্যবস্থা হতে পারে না। যদিও এটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন, এই চেষ্টা সফল হবে কি না, তবে এমন বিশ্বাসও কেউ কেউ করছেন যে, নেপালে এখনো এমন লড়াকু কমিউনিস্টরা আছেন, যারা এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন।
ভূরাজনীতি এবং স্বপ্নের অপমৃত্যু
আবারও বলতে হচ্ছে, নেপালের সংকট কেবল অভ্যন্তরীণ নয়, বরং ভূরাজনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। দুটি বৃহৎ বৈদেশিক শক্তির (চীন ও ভারত) কাছে নেপালের নতজানু হয়ে থাকার প্রবণতা দেশের সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করেছে। তবে ভূরাজনীতির চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো রাজনৈতিক নেতাদের কারণে জনগণের স্বপ্নের অপমৃত্যু এবং বিশ্বাসের কবর রচনা। নেপাল একটি ছোট দেশ হলেও যারা সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন, তাদের জন্য নেপালের এই রাজনৈতিক শিক্ষাটি একটি বিরাট পাথেয় হয়ে থাকবে নিশ্চয়ই।
তরুণ প্রজন্মের বার্তা
নেপালের বর্তমান পরিস্থিতি অনেকের মনেই এক গভীর প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গিয়েছে : যখন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের বিশ্বাস হারায়, তখন সেখানে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা থাকে কি? আর তরুণ প্রজন্ম আমাদের যে বার্তা দিয়ে গেল, তা হলো, দিন যতই যাক, দুর্নীতি করলে তাদের হাত থেকে রেহাই নেই। বাংলাদেশ, শ্রীলংকা ও নেপাল-এ তিন দেশেই সরকারের বিরুদ্ধে জেন-জির প্রধান অভিযোগ ছিল দুর্নীতি। জেন-জি এই দুর্নীতির বিরুদ্ধেই সবচেয়ে সোচ্চার। তাই স্বৈরাচার হোক কিংবা নির্বাচিত-জনগণের কথা তাদের মনে রাখতেই হবে। দুর্নীতিকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। যদি তা হয়, তবে প্রতিবাদে ফুঁসে উঠবে তরুণ প্রজন্ম। দুর্নীতির শক্ত ভিত গুঁড়িয়ে দিতে এতটুকু কালক্ষেপণ তারা করবে না। যাই হোক, নেপালের এই সংকটের মধ্যে জনগণের হারানো বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে নতুন কোনো নেতৃত্ব উঠে আসবে কি না, তা জানতে আমাদের কৌতূহলী মন হয়তো আরও কিছুদিন অপেক্ষায় থাকবে।
খালিদ বিন আনিস : সাংবাদিক

