Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বাইফোকাল লেন্স

নেপালের গণ-আন্দোলন এবং ভারত

Icon

একেএম শামসুদ্দিন

প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নেপালের গণ-আন্দোলন এবং ভারত

নেপালে মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টার আন্দোলনে প্রধানমন্ত্রী খড়্গপ্রসাদ (কেপি) শর্মা অলি ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে নানা মহলে নানারকম বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে এই আন্দোলনের ধারা ও প্রকৃতি নিয়ে। অনেকেই ২০২২ সালে শ্রীলংকায় এবং ২০২৪ সালে বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে নেপাল সরকার উৎখাত আন্দোলনের সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছেন। এ ব্যাপারে ভারত সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। শুরু থেকেই তারা এ আন্দোলনের পেছনে বৃহৎ শক্তির ইন্ধন আছে বলে প্রচার শুরু করেছে। বাংলাদেশের ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান’কে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন ছিল তা স্বীকার না করে, এর পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধন ছিল বলে সে দেশের গণমাধ্যমগুলো যেমন জোর প্রচার চালিয়েছে; ঠিক তেমনই নেপালি জনগণের আন্দোলনের পেছনে মার্কিন যোগসূত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে। তারা বলছে, ‘ওলি চীনপন্থি, সুতরাং এ আন্দোলনে চীনের সম্পৃক্ততা থাকার সম্ভাবনা নেই। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। অতএব এই টানাপোড়েনের জের টেনে যুক্তরাষ্ট্রকেই এ আন্দোলনের ইন্ধনদাতা হিসাবে ভারত দাঁড় করার চেষ্টা করছে। অথচ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন অন্য কথা। অলি ভারতের কাছে বরাবরই চীনপন্থি হিসাবে বিবেচিত। শুধু তাই নয়, বিগত কয়েকটি মেয়াদে নেপালের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বিভিন্ন ইস্যুতে নেপাল-ভারত সম্পর্কের যে ঘাটতি ছিল এবং নেপালের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষার্থে ভারতবিরোধী মনোভাবের জন্য অলিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে ভারতও যে থাকতে পারে তা আড়াল করতেই ভারত আগেভাগে এ ধরনের বয়ান নিয়ে মাঠে নেমেছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। সম্প্রতি অলির লেখা একটি চিঠি তারই ইঙ্গিত দেয়।

আত্মগোপন থেকেই দলের সাধারণ সম্পাদক শঙ্কর পোখরেলকে লেখা এক চিঠিতে অলি দাবি করেন, ভারতবিরোধিতার কারণে তাকে ক্ষমতা হারাতে হয়েছে। তিনি বলেন, ২০২০ সালের জুলাইতে ভগবান রামের জন্মভূমি নিয়ে ভারতের দাবির বিরোধিতা করে তিনি দাবি করেছিলেন, ভগবান শ্রী রামের জন্ম ভারতের অযোধ্যায় নয়; নেপালে। রামের আসল জন্মভূমি কাঠমান্ডুর কাছে অবস্থিত ছোট্ট গ্রাম অযোধ্যায়; শাস্ত্রে এমন কথাই বলা আছে। এই অযোধ্যা ভারতের অযোধ্যা নয়। অলির সেই দাবিকে ঘিরে সে সময় নয়াদিল্লি-কাঠমান্ডু টানাপোড়েনের তৈরি হয়েছিল। তার দাবি, সেই বছর আরও একটি ঘটনা ভারতকে ওলির ওপর ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। উল্লেখ্য, ২০২০ সালের জুনে নেপাল পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ‘হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভসে’ সংবিধান সংশোধনী বিলে নেপালের একটি নতুন মানচিত্র অনুমোদিত হয়েছিল। নতুন মানচিত্রে ভারত দখলকৃত নেপালের তিনটি ভূখণ্ড, লিম্পিয়াধুয়া, কালাপানি ও লিপুলেখ এলাকা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিল পাস হওয়ার পরে কাঠমান্ডুর পদক্ষেপকে ভারত ‘অযৌক্তিক, অসমর্থনযোগ্য এবং অ-ঐতিহাসিক’ বলে অভিযোগ করেছিল। ভারতের দাবি, চীন অধিকৃত তিব্বত লাগোয়া ওই তিনটি অঞ্চল সামরিক দৃষ্টিতে ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত মনে করে, নেপালের এ পদক্ষেপের পেছনে চীনের ভূমিকা ছিল। ভারত কথিত বিলটি যাতে পাস না হয় সে জন্য সে সময় জোরালো চেষ্টা করেছিল। ওলি চিঠিতে আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘ভারত দখলকৃত নেপালের ওই ভূখণ্ড’ নিয়ে বাড়াবাড়ি না করলে, সেই সঙ্গে ‘রামের জন্মভূমি’ নিয়ে বিরোধিতা না করলে তিনি এখনো প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতেন।”

উল্লেখিত ভূখণ্ড নিয়ে ভারতের সঙ্গে নেপালের বিরোধিতার একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। নেপালের সঙ্গে ভারতের প্রায় এক হাজার ৮০৮ কিলোমিটার মুক্ত সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে ছয়শ কিলোমিটার সীমানাজুড়ে রয়েছে নদী। ভারত ও নেপালের সীমানা নির্ধারিত হয়েছে মূলত ১৮১৬ সালের ৪ মার্চ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে নেপালের স্বাক্ষরিত ‘সুগাউলি চুক্তির’ মাধ্যমে। চুক্তি অনুসারে মহাকালি নদীই হবে দুই দেশের মধ্যকার সীমানা। তৎকালীন ব্রিটিশরা এ চুক্তিটি জোর করে নেপালের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। ফলে নেপাল তার বেশকিছু ভূখণ্ড হারায়। তবে ভারতের স্বাধীনতার পর ১৯৫০ সালে ভারত ও নেপালের মধ্যে ‘পিস অ্যান্ড ফ্রেন্ডশিপ ট্রিটি’ স্বাক্ষরিত হয়; ওই চুক্তির ৮ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লিখিত শর্তানুসারে ব্রিটিশদের সঙ্গে নেপালের করা সুগাউলি চুক্তি বাতিল হয়ে যায়। ফলে নেপাল সুগাউলি চুক্তির কারণে হারানো লিপুলেখ গিরিপথের দাবিদার হয়। একইসঙ্গে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ লিমপিয়াধুরা ও কালাপানি অঞ্চলকে নিজেদের ভূখণ্ড দাবি করে। মূলত ১৯৬২ সালে ইন্দো-চীন যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর থেকে নেপালের সীমান্তবর্তী ভূখণ্ড দখলে নেওয়া শুরু করে ভারত। যুদ্ধের সময় চীনের সামরিক গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহেরলাল নেহেরুর অনুরোধে নেপাল কালাপানিতে ভারতকে অস্থায়ীভাবে সেনা সমাবেশের অনুমোদন দিয়েছিল। কিন্তু পরে ভারত আর সেখান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করেনি। বরং উলটো কালাপানিকে ভারত নিজেদের ভূখণ্ড হিসাবে দাবি করে বসে।

নেপালের ডিপার্টমেন্ট অব সার্ভের তৈরি এক প্রতিবেদনে, ১৮৫০ ও ১৮৫৬ সালের মানচিত্র তুলে ধরে বলা হয়েছে, সে সময় নেপালি কর্তৃপক্ষকে সঙ্গে নিয়েই ব্রিটিশ-ভারতের সার্ভে অব ইন্ডিয়া মানচিত্র দুটি তৈরি করেছিল। মানচিত্র দুটিতে দেখা যায়, মহাকালি নদীর উৎপত্তি কালাপানি থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমের লিমপিয়াধুরাতে। এর মাধ্যমে প্রমাণ হয় যে, কালাপানি নেপালের ভূখণ্ড। কিন্তু ভারত মানচিত্র দুটি দলিল হিসাবে গ্রহণ করতে রাজি নয়। বরং ২০১৯ সালের নভেম্বরে কালাপানিকে ভারত নিজেদের ভূখণ্ড উল্লেখ করে নতুন করে মানচিত্র প্রকাশ করে। শুধু তাই নয়, ভারত পরের বছর লিপুলেখ থেকে কালাপানি পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি লিংক রোডও নির্মাণ করে; যাতে সহজে তিব্বতের কৈলাস মানস সরোবরে যাতায়াত করা যায়। অথচ আগে সিকিম ঘুরে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে কৈলাস সরোবরে পৌঁছাতে চার থেকে পাঁচ দিন লেগে যেত। এই লিংক রোড উদ্বোধনের পর নেপাল তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তারা দাবি করে, ভারত তাদের ভূখণ্ডের ভেতর দিয়ে সড়ক তৈরি করে নেপালের সার্বভৌমত্বে আঘাত হেনেছে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী তখন কাঠমান্ডুতে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করে তার হাতে প্রতিবাদলিপি ধরিয়ে দেয়। ওলি এখানেই থেমে যাননি, ওই বছরের জুন মাসের মধ্যে নয়াদিল্লির আপত্তি উড়িয়ে দিয়ে নেপাল পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে (প্রতিনিধি সভা) আলোচিত তিনটি অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করে নতুন মানচিত্র প্রকাশের বিলও পাশ করিয়ে নেন। ওলির এই পদক্ষেপ ভারত মোটেই ভালোভাবে নেয়নি। তারপর থেকেই ভারত বরাবরই ওলিকে নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগেছে। সম্ভবত এসব কারণেই অলি তার গদিচ্যুত হওয়ার পেছনে ভারতের হাত আছে বলে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন।

অলির এই অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কারণ, ‘ভারতবন্ধু’ বলে পরিচিত আরও একজন-নেপালের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কারকির অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসাবে নির্বাচিত হওয়া। যদিও আন্দোলনকারীদের একাংশের জোর আপত্তি ছিল তাকে নিয়ে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকেই নির্বাচিত করা হয়। তবে সুশীলাকে নির্বাচিত করার নেপথ্যে ভারতের বড় ভূমিকা ছিল বলে বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন। বিশ্লেষকদের অনুমান যে অমূলক নয় তার প্রতিফলন দেখা যায় ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত উচ্ছ্বসিত সংবাদ পরিবেশনে। তারা বলছে, ‘প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সুশীলার নাম কার্যত নিশ্চিত হওয়ার পরপরই গণমাধ্যম কর্মীদের মুখোমুখি হয়ে নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানান কারকি।’ তাদের ভাষায়, “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রশংসা শোনা গিয়েছে ভারতের বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রাক্তনীর গলায়-‘মোদিকে আমি নমস্কার জানাই। আমি তাকে সম্মান করি। ভারতের প্রতি আমার অপরিসীম শ্রদ্ধা রয়েছে। কারণ, তারা সর্বদা নেপালের পাশে থেকেছে ও সাহায্য করেছে।” সুশীলার ভারতের সঙ্গে আরও একটি যোগসূত্র রয়েছে। তিনি নেপালের ভারতপন্থি রাজনৈতিক দল নেপালি কংগ্রেসের বিশিষ্ট নেতা দুর্গাপ্রসাদ সুবেদীর সহধর্মিণী। বেনারসে অধ্যয়নকালে দুর্গাপ্রসাদের সঙ্গে সুশীলার পরিচয় হয় ।

নেপালের রাজনৈতিক পালাবদলে ভারত যে অখুশি নয় তারই প্রতিফলন দেখি তাদের বক্তব্য ও বিবৃতিতে। ছব্বিশের গণজোয়ারে হাসিনার ক্ষমতা ছেড়ে পলায়নের পর বাংলাদেশের প্রতি ভারতের হিংসাত্মক মনোভাব এবং নেপালে ওলির পতনের পর ভারতে প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়। অলির গদিচ্যুতের ঘটনাকে ভারত বরং স্বাগত জানিয়েছে। দেড় যুগ ধরে ব্যাপক লুটতরাজ, দুর্নীতি-রাহাজানি, গুম-খুন, এমনকি শেষ ৩৬ দিনের আন্দোলনে প্রায় দেড়শ শিশুসহ সহস্রাধিক মানুষকে খুন করে হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ভারত একবারের জন্যও বাংলাদেশের মানুষের প্রতি কোনোপ্রকার সহানুভূতি প্রকাশ করেনি। বরং আন্দোলনের জের হিসাবে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িঘর ভাঙচুরের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে; হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর অত্যাচারের কল্পিত ঘটনা সাজিয়েছে। অথচ নেপালে একজন শিশুসহ ৩৪ জনের মৃত্যুতে ভারত তাৎক্ষণিকভাবে সহানুভূতি প্রকাশ করেছে। নেপালে সংসদভবন ও সর্বোচ্চ বিচারালয়সহ সরকারি প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, সরকারি দলের নেতাকর্মীদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও ধ্বংসযজ্ঞ, মন্ত্রী-এমপিদের প্রকাশ্যে মারধর, এমনকি সাবেক এক প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে তার সহধর্মিণীকে পুড়ে মারার পরও ভারতকে নিন্দা জানাতে দেখা যায়নি। বাংলাদেশের মানুষের রক্তে রঞ্জিত হাসিনাকে যে ভারত সাদরে গ্রহণ করেছে, সে ভারতই অলিকে স্বৈরাচার আখ্যা দিয়েছে। এ সবকিছু বিবেচনায় নিলে কেপি শর্মা অলিকে গদিচ্যুত করার পেছনে ভারতের যে ভূমিকা থাকতে পারে সে বিষয় একটি ধারণা পাওয়া যায়। এতদঞ্চলের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অন্তত তাই মনে করেন।

একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, কলাম লেখক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম