দুই বিপজ্জনক পোকা থেকে সাবধান!
ড. সৈয়দ নূরুল আলম, ড. আবুল কালাম আযাদ ও ড. দেবাশীষ সরকার
প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফল আর্মিওয়ার্ম পোকা ও জায়েন্ট মিলিবাগ। ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ফল আর্মিওয়ার্ম পোকা
ফল আর্মিওয়ার্ম বা সাধারণ কাটুই পোকা, যার বৈজ্ঞানিক নাম Spodoptera frugiperda, পৃথিবীব্যাপী একটি মারাত্মক ক্ষতিকারক ও বিধ্বংসী পোকা হিসেবে পরিচিত। এ পোকাটি মূলত আমেরিকা মহাদেশের। তবে এরা দ্রুত অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে।
২০১৬ সালে এটির প্রথম আক্রমণ আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে পরিলক্ষিত হয় এবং ২০১৭ সালের প্রথমদিকে সে অঞ্চলের বেশ কয়েকটি দেশে ব্যাপক ফসলহানি ঘটে, এমনকি দুর্ভিক্ষেরও সৃষ্টি হয়। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, সম্প্রতি ভারতের কর্নাটক ও তামিলনাড়ু রাজ্যে এ পোকার আক্রমণ দেখা গেছে, যা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এ পোকার আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়নি, তবে যেহেতু পার্শ্ববর্তী দেশে এর আক্রমণ শুরু হয়েছে সুতরাং যে কোনো সময় পোকাটি এ দেশে অনুপ্রবেশ করতে পারে। আর পোকাটির প্রাথমিক আক্রমণের অবস্থান শনাক্ত করা না গেলে দেশে ব্যাপক ফসলহানি, বিশেষত সম্ভাবনাময় ভুট্টা ফসলের মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
ক্ষতির ধরন : এটি ভুট্টা, তুলা, বাদাম, তামাক, ধান, বিভিন্ন ধরনের ফলসহ প্রায় ৮০টি ফসলে আক্রমণ করে থাকে। তবে ভুট্টা ফসলে এর আক্রমণের হার সর্বাধিক। পোকাটি কিড়া অবস্থায় গাছের পাতা ও ফল খেয়ে থাকে। কিড়ার প্রাথমিক অবস্থায় এদের খাদ্য চাহিদা অনেক কম থাকে, তবে শেষ ধাপসমূহে খাদ্য চাহিদা প্রায় ৫০ গুণ বৃদ্ধি পায়।
এ কারণে কিড়ার ৪-৬ ধাপগুলোয় অর্থাৎ কিড়া পূর্ণাঙ্গ হওযার আগে রাক্ষুসে হয়ে ওঠে এবং ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে। এমনকি এক রাতের মধ্যে এরা সব ফসল বিনষ্ট করে ফেলতে পারে।
ফল আর্মিওয়ার্মের জীবনচক্র : পোকাটির জীবনচক্রে চারটি ধাপ রয়েছে: গ্রীষ্মকালে পোকাটি ৩০-৩৫ দিনে এবং শীতকালে ৭০-৮০ দিনে জীবনচক্র সম্পন্ন করে। এর মধ্যে ডিম (৩-৫), কিড়া (১৪-২৮), পুত্তুলি (৭-১৪) এবং পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় (১১-১৪) দিন অতিবাহিত করে। স্ত্রী পোকা সাধারণত পাতার নিচের দিকে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে কিড়া বের হয়ে পাতা বা ফল খাওয়া শুরু করে।
পোকার বিস্তার লাভ প্রক্রিয়া : পোকাটি সংগনিরোধ বালাই হিসেবে পরিচিত এবং ডিম ও পুত্তুলি অবস্থায় বিভিন্ন উদ্ভিদজাত উপাদান যেমন- বীজ, চারা, কলম, কন্দ, চারাসংলগ্ন মাটি ইত্যাদির মাধ্যমে বিস্তার লাভ করতে পারে। পূর্ণাঙ্গ পোকা অনেক দূর পর্যন্ত উড়তে পারে, এমনকি ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে কয়েকশ’ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তার লাভ করতে পারে।
বর্তমানে করণীয় : যদিও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এ পোকার আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়নি, তবে যে কোনো সময় এর আক্রমণ এ দেশে পরিলক্ষিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই পোকাটি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা এবং সরাসরি পোকা খাওয়ার লক্ষণ দেখে বা কিড়া শনাক্ত করে এ পোকার আক্রমণ চিহ্নিত করা অত্যন্ত জরুরি।
বিশেষত সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে ফল আর্মিওয়ার্ম পোকার আক্রমণ পর্যবেক্ষণ করা যায়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং কর্তৃক আমদানিকৃত বিভিন্ন উদ্ভিদজাত উপাদানে পোকাটির বিভিন্ন পর্যায়ের উপস্থিতি পরীক্ষা করা এবং উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং কর্তৃক মাঠপর্যায়ে ফেরোমন ফাঁদের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন।
এ ছাড়া ফল আর্মিওয়ার্মের ফেরোমন ফাঁদে পোকা পাওয়া গেলে বা লক্ষণ মোতাবেক কোনো ফসলে, বিশেষত ভুট্টায় পোকার আক্রমণ দেখা গেলে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট বা বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইন্সটিটিউটকে জরুরি ভিত্তিতে অবহিত করা প্রয়োজন।
সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনা : আক্রান্ত গাছ থেকে ডিম বা দলাবদ্ধ কিড়া চিহ্নিত করে পিষে মেরে ফেলতে হবে বা মাটির নিচে কমপক্ষে এক ফুট পরিমাণ গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে। প্রাথমিক আক্রমণ দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফল আর্মিওয়ার্মের ফেরোমন ফাঁদ (বিঘা প্রতি ৫টি হারে) জমিতে স্থাপন করতে হবে।
এ ছাড়া প্রাথমিক আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে জৈব বালাইনাশক এসএনপিভি (প্রতি লিটার পানিতে ০.২ গ্রাম হিসাবে মিশিয়ে) ১০ দিন পরপর ২-৩ বার জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। রাসায়নিক কীটনাশক এ পোকা দমনে সেরূপ কার্যকরী নয় বিধায় তা প্রয়োগ না করাই উত্তম। সম্ভব হলে উপকারী পোকা ‘ব্রাকন হেবিটর’ আক্রান্ত এলাকায় অবমুক্ত করা যেতে পারে (হেক্টর প্রতি ৮০০-১২০০টি পোকা)।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের কীটতত্ত্ব বিভাগ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সহায়তায় ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে সার্বক্ষণিকভাবে এ পোকার আক্রমণ পর্যবেক্ষণ করছে এবং পর্যবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণসহ কারিগরি সহযোগিতা দেয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
উপরোক্ত লক্ষণ মোতাবেক কোথাও কোনো ফসলে বিশেষত ভুট্টা ফসলে পোকার আক্রমণ দেখা গেলে বিএআরআই’র এসব টেলিফোন বা ফ্যাক্স নম্বরে যোগাযোগ করার জন্য কৃষকদের অনুরোধ জানানো যাচ্ছে : ০২ ৪৯২৭০১২৪, ৪৯২৭০০০১, পিএবিএক্স : ৪৯২৭০০৪১-৮, ফ্যাক্স : ৮৮-০২ ৪৯২৭০২০১।
জায়েন্ট মিলিবাগ
সম্প্রতি দেশে জায়েন্ট মিলিবাগ বিভিন্ন ফলজ ও বনজ গাছে মারাত্মক ক্ষতিকারক পোকা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ পোকা কেবল বাংলাদেশে নয়, এদের বিস্তৃতি ভারতের সুদূর পাঞ্জাব থেকে আসাম অঞ্চল পর্যন্ত। তবে ইদানীং বিদেশ থেকে, বিশেষত আফ্রিকা মহাদেশ থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে এ পোকা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করায় এদের আক্রমণ বেড়েছে। এটি বিভিন্ন ফলদ উদ্ভিদ যেমন- কাঁঠাল, আম, লেবু, নারকেল এবং বনজ বৃক্ষ যেমন- রেইনট্রি, কড়ই, পাহাড়ি তুলা ইত্যাদি গাছে আক্রমণ করে থাকে।
ক্ষতির ধরন : এ পোকা গাছের বাড়ন্ত ডগা ও মুকুল থেকে রস চুষে খায়। এতে করে কচি ডগা ও মুকুল শুকিয়ে যায়। ফলে ফল ধারণ করে না বা করলেও পরবর্তী সময়ে ঝরে পড়ে। সাধারণত এরা দলবদ্ধভাবে থাকে এবং ডগা ও মুকুলের বোঁটায় এমনভাবে গাদাগাদি করে থাকে যে আক্রান্ত ডগাটিই আর দেখতে পাওয়া যায় না।
আক্রমণ মারাত্মক হলে এদের নিঃসৃত মধুরসে স্যুটিমোল্ড রোগ হয়। ফলে পাতা কালো হয়ে যায় এবং ঠিকমতো খাদ্য তৈরি হয় না। আক্রান্ত গাছ অত্যন্ত দুর্বল প্রকৃতির হয় এবং ফলন অত্যন্ত কমে যায়। এদের আক্রমণের ফলে ফসলের ক্ষতি ছাড়াও মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার হতে পারে।
বিশেষত এপ্রিল-মে মাসে স্ত্রী পোকাগুলো ডিম পাড়ার জন্য গাছ থেকে দলে দলে নেমে এসে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে; এমনকি বসতবাড়ির আঙ্গিনায় এদের দেখা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে ভয় পাওয়ার কারণ নেই। কারণ এ পোকাটি অত্যন্ত নিরীহ প্রকৃতির। মানুষের শরীরে ক্ষতিসাধিত হয় এরকম কোনো উপাদান এ পোকার মধ্যে নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ পোকার আক্রমণ মাত্রা ব্যাপক পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছায় না।
তবে অনুকূল আবহাওয়া (শুকনা, উষ্ণ এবং বেশকিছু দিন বৃষ্টিপাতবিহীন আবহাওয়া) পেলে এদের ব্যাপক আক্রমণ হতে পারে। বিশেষত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়কালে যদি আবহাওয়া শুকনো এবং বৃষ্টিপাতবিহীন থাকে তবে এ পোকার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়।
জীবনচক্র : এদের জীবনচক্রে তিনটি ধাপ দেখা যায়। ধাপগুলো হল ডিম, অপ্রাপ্ত অবস্থা বা নিম্ফ ও পূর্ণাঙ্গ। অপ্রাপ্ত অবস্থায় (নিম্ফ দশা) স্ত্রী পোকা ফসলের ক্ষতি করে থাকে। ডিম অবস্থায় প্রায় ৬ মাস এবং বাকি ৬ মাস (নভেম্বর থেকে মে) নিম্ফ ও পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় সক্রিয় থাকে।
মার্চ-এপ্রিল মাসে স্ত্রী পোকা গাছ থেকে নেমে আসে এবং মাটির ৫-১৫ সেন্টিমিটার গভীরতায় গুচ্ছাকারে ৩০০-৫০০টি ডিম পাড়ে। রেশমি থলেতে ডিমগুলো আবৃত থাকে। ডিম ১ মিমি লম্বা এবং ০.৭ মিমি চওড়া হয়ে থাকে।
সদ্য পাড়া ডিম দেখতে ডিম্বাকার ও উজ্জ্বল গোলাপি রঙের, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা ধূসর বর্ণ ধারণ করে। অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ডিম ফুটে নিম্ফ বের হয়ে আসে এবং হেঁটে হেঁটে খাদ্যের সন্ধানে পোষক গাছে উঠতে শুরু করে।
চেনার উপায় : স্ত্রী পোকা প্রায় ১৫ মিলিমিটার লম্বা। এদের শরীর ডিম্বাকার, নরম, রসালো ও চ্যাপ্টা প্রকৃতির। এদের রং কিছুটা লালচে হলেও বহিরাবরণ সাদা পাউডারজাতীয় পদার্থ দ্বারা আবৃত থাকায় সাদা মনে হয়। পুরুষ পোকা এক জোড়া পাখাযুক্ত হলেও স্ত্রী পোকা পাখাবিহীন।
দমনের উপায় : সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ববর্তী বছরে আক্রান্ত গাছগুলোর আশপাশের জমি চাষ দিলে মাটিতে থাকা ডিমগুলো উপরে উঠে আসে ও বিনষ্ট হয়। তবে সাধারণত আক্রমণের সময়ানুযায়ী নিম্নোক্ত দুটি পদ্ধতিতে এ পোকা দমন করা যায় :
১. নভেম্বর মাসে সদ্য ফোটা নিম্ফ ধ্বংস করে : পূর্ববর্তী বছরে এ পোকা আক্রান্ত গাছসহ আশপাশের গাছে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই নিম্ফগুলো গাছ বেয়ে উপরে ওঠে। তাই সেসময় গাছের গোড়া থেকে ১ মিটার উঁচুতে ৩-৪ ইঞ্চি চওড়া পিচ্ছিল র্যাপিং টেপ দিয়ে কাণ্ডের চতুর্দিকে আবৃত করে দিলে এরা আর উঠতে পারে না এবং পিচ্ছিল টেপের নিচের অংশে জমা হয়।
এ অবস্থায় এদের একসঙ্গে করে মারা সম্ভব অথবা জমাকৃত পোকার ওপর সংস্পর্শ কীটনাশক যেমন কার্বারিল (সেভিন) ৮৫ এসপি প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৫-৬ দিন অন্তর ২-৩ বার ভালোভাবে স্প্রে করলে এ পোকা সম্পূর্ণভাবে দমন করা যায়।
২. মার্চ-এপ্রিল মাসে পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী পোকা ধ্বংস করে : আক্রান্ত গাছগুলো ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই গোড়ার মাটি থেকে ১ মিটার উঁচুতে ৩-৪ ইঞ্চি চওড়া পিচ্ছিল র্যাপিং টেপ গাছের চতুর্দিকে আবৃত করে দিলে পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী পোকা ডিম পাড়ার জন্য গাছের ওপর থেকে নেমে আসতে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং র্যাপিং টেপের ওপরের অংশে জমা হয়। এ অবস্থায় এদের একসঙ্গে করে মারা সম্ভব অথবা জমাকৃত পোকার ওপর জৈব বালাইনাশক পটাশিয়াম সল্ট অব ফ্যাটি এসিড (ফাইটোক্লিন, প্রতি লিটার পানিতে ৮-১০ মিলি. হারে ১০ দিন অন্তর ২-৩ বার) বা সংস্পর্শ কীটনাশক ক্লোরপাইরিফস (প্রতি লিটার পানিতে ৩ মিলি. হারে ৭-৮ দিন পরপর ২-৩ বার) বা কার্বারাইল (প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে ৭-৮ দিন পরপর ২-৩ বার) স্প্রে করে দমন করা যায়।
গাছে আক্রমণকালীন যে কোনো সময় উল্লিখিত জৈব বালাইনাশক, ফাইটোক্লিন দিয়ে পোকাটি দমন করা যায়। জৈব বালাইনাশকের পরিমাণ কমানোর জন্য কেবল ওই পোকার শরীরে জৈব বালাইনাশক স্প্রে করা বাঞ্ছনীয়।
ড. সৈয়দ নূরুল আলম, ড. আবুল কালাম আযাদ ও ড. দেবাশীষ সরকার : গবেষক, কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট, গাজীপুর
cso.ento@bari.gov.bd
