দৃষ্টিপাত
প্লেটোর দর্শন আজও প্রেরণার উৎস
ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী
প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ‘দি রিপাবলিক’। এটি বিশ্বে বহুল পঠিত একটি গ্রন্থ। এ গ্রন্থে প্লেটোর মূল দর্শনের উল্লেখ আছে। প্লেটো একটি আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা এবং এর রূপরেখা অঙ্কন করেছেন। সেই কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সেখানে দুটি শ্রেণি থাকবে। এর একটি হচ্ছে, গার্ডিয়ান ক্লাস এবং অন্যটি আর্টিজ্যান ক্লাস। গার্ডিয়ান ক্লাস হচ্ছে শাসক ও যোদ্ধা; এরা অভিভাবক শ্রেণির অন্তর্গত। অবশিষ্ট সবাই যেমন-কৃষক, শ্রমিক, কারিগর-এরা আর্টিজ্যান শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
প্লেটো যে আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন, সে রাষ্ট্রে গার্ডিয়ান শ্রেণির কোনো পরিবার ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকবে না। তার যুক্তি ছিল, পরিবার ও সম্পত্তি না থাকলে শাসকশ্রেণির দুর্নীতিগ্রস্ত ও অসৎ হওয়ার আশঙ্কা কম থাকবে। পরিবার এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রতি মোহ ও পিছুটান না থাকলে শাসকশ্রেণি রাষ্ট্রপরিচালনায় গভীরভাবে মনোযোগী হতে পারবে। তারা সর্বতোভাবেই পরিবার ও সম্পদের মোহমুক্ত থেকে রাষ্ট্রপরিচালনা করবে। মূলত এ কারণেই গার্ডিয়ান বা অভিভাবক শ্রেণির জন্য তিনি পরিবার এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি নিষিদ্ধের কথা বলেছিলেন। অভিভাবক শ্রেণি ব্যারাকে বসবাস করবে এবং তাদের পরিবারের বদলে একদল স্ত্রী থাকবে-যাদের বলা হবে কমিউনিটি অব ওয়াইভস। এর ফলে অভিভাবক শ্রেণি যে সন্তানসন্ততির জন্ম দেবে, তাদের কোনো নির্দিষ্ট পিতৃত্ব পরিচয় থাকবে না। এটা করা হলে কোন পিতার কোন সন্তান, তা চিহ্নিত করা সম্ভব হবে না। ফলে গার্ডিয়ান শ্রেণির কোনো পিতার সন্তানের প্রতি দুর্বলতা ও পক্ষপাত থাকবে না। সন্তান ও পরিবারের প্রতি মোহ শাসকশ্রেণিকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলতে পারে। ব্যক্তি মানুষ মোহগ্রস্ত হয়ে পড়লে সে তখন নিরপেক্ষভাবে রাষ্ট্রের কাজ সম্পন্ন করতে পারে না।
প্লেটোর মতে, শাসকশ্রেণিকে রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে মোহমুক্ত রাখতে হবে। তাহলে শাসকরা জনকল্যাণে অধিকতর মনোযোগী হতে পারবেন। তিনি ন্যায়পরায়ণ এবং সবার প্রতি ন্যায্যতার ভিত্তিতে যৌক্তিক আচরণ করতে পারবেন। তবে আর্টিজ্যান শ্রেণির পরিবার ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকবে। তাদের প্রধান কাজ হবে উৎপাদন এবং সে কাজেই তারা আত্মনিয়োগ করবেন। এ ব্যবস্থাকেই বলা হয় প্লেটোর সাম্যবাদ; মার্কসের সাম্যবাদের সঙ্গে তুলনা করে একে বলা হয় হাফ কমিউনিজম।
প্লেটোর দর্শনের মূল ভিত্তি হচ্ছে তার ন্যায়বিচারের ধারণা। রাষ্ট্র সবার প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে, এটি তার দর্শনের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের যথাযথ পাওনা নিশ্চিত করতে হবে : To give everyman his due is Plato's justice। এ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই তার আদর্শ রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে আছে। ন্যায়সংগত অধিকারপ্রাপ্তি শুধু বিচারের ক্ষেত্রে নয়, রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অর্থাৎ প্রতিটি ক্ষেত্রেই একজন নাগরিকের ন্যায়সংগত অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না। অধিকারবঞ্চিত মানুষ একসময় বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারে।
প্লেটোর মতে, রাষ্ট্রের শাসক হবেন দার্শনিক রাজা (philosopher king)। তখন যেহেতু রাজতন্ত্র ছিল, তাই তিনি রাজার কথাই বলেছেন। রাজতন্ত্রে রাজাই শাসক। কিন্তু এর গূঢ় অর্থ হলো, শাসককে হতে হবে শিক্ষিত-তথা সুশিক্ষিত, তথা জ্ঞানী। প্রাজ্ঞ শাসকের কথাই তিনি বোঝাতে চেয়েছেন। একজন দার্শনিক তথা জ্ঞানী শাসক হয় মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন ও ন্যায়পরায়ণ। ব্যক্তিগত লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি দেশের মানুষের কল্যাণ সাধনে ব্যাপৃত থাকেন। শাসক যদি সৎ এবং ভালো গুণাবলিসম্পন্ন হন, তাহলে তার সুফল পুরো জাতি ভোগ করে। আর শাসক যদি অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত হন, তাহলে সেই জাতির দুর্ভোগের সীমা থাকে না। কোনো রাষ্ট্রে যদি দার্শনিক রাজা অর্থাৎ সুশিক্ষিত শাসকের শাসন কায়েম থাকে, তাহলে সেই রাষ্ট্রে দুর্নীতি-অনিয়মের আশঙ্কা কম থাকবে। সেই রাষ্ট্রের নাগরিক ও সম্পদ অপেক্ষাকৃত নিরাপদ থাকবে।
প্লেটোর চিন্তা ও দর্শনের মূলে ছিল তার শিক্ষক মহামতি সক্রেটিসের করুণ পরিণতি। সক্রেটিস ছিলেন মহাজ্ঞানী দার্শনিক। শাসকশ্রেণি সক্রেটিসকে বিষপানে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। মৃত্যুর আগে হেমলক বিষের পাত্র হাতে নিয়ে শাসকদের উদ্দেশে সক্রেটিস যে বক্তব্য প্রদান করেছিলেন, তা আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। তিনি বলেছিলেন, ‘I to die, you to live, which is better only god knows’. প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যে শাসকরা সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছিল, পৃথিবীর মানুষ তাদের মনে রাখেনি। কিন্তু সক্রেটিসের নাম এখনো পৃথিবীব্যাপী শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করা হয়। পৃথিবী যতদিন থাকবে, সক্রেটিস ঠিক ততদিন মানুষের হৃদয়ে জাগরূক থাকবেন। সক্রেটিস তার অর্জিত জ্ঞান তরুণ সমাজের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এটা অশিক্ষিত শাসকদের কাছে ভালো লাগেনি। তারা জ্ঞান দিয়ে সক্রেটিসকে মোকাবিলা করতে না পেরে তাকে হত্যা করে আপদ বিদায় করতে চেয়েছিলেন। সক্রেটিস বুঝতে পেরেছিলেন, যদি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন করা যায়, তাহলে সাধারণ মানুষের অধিকার সুরক্ষিত হবে। তারা শোষণের শিকার হবে না। কিন্তু তার এ প্রচারণা ছিল প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থার প্রতিকূলে। তাই তিনি শাসকশ্রেণির রোষানলে পতিত হন। সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘knowledge is virtue’ অর্থাৎ জ্ঞানই সৎগুণ। সক্রেটিসের একটি বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে, ‘know thyself’, অর্থাৎ নিজেকে জানো বা নিজেকে চেনো। তিনি মানবজাতির উদ্দেশে এ উক্তি করেছিলেন। অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষের উচিত নিজেকে বুঝতে চেষ্টা করা। নিজের ভালো-মন্দ বিশ্লেষণ করতে শেখা একজন মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তৎকালীন গ্রিক সমাজ সক্রেটিসের এ বক্তব্য সহ্য করতে পারেনি। তারা মনে করেছিল, সক্রেটিস সম্ভবত তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে; তাই শাসকগোষ্ঠী বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। সক্রেটিসের এ নির্মম হত্যাকাণ্ডে প্লেটো নিদারুণভাবে শোকাহত ও ক্ষুব্ধ হন। তিনি তার ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে বারবার উল্লেখ করেছেন, যারা সক্রেটিসকে হত্যা করেছেন, তারা ক্ষমার অযোগ্য। সেই বোধ থেকেই প্লেটো বলেছিলেন, রাষ্ট্রের শাসককে হতে হবে দার্শনিক এবং মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন। একমাত্র দার্শনিক রাজার পক্ষেই প্রজাদের সব সমস্যা অনুধাবন ও সমাধান করা সম্ভব।
সক্রেটিসের এ হত্যাকাণ্ড প্লেটোকে ভীষণভাবে মর্মাহত করে। জ্ঞানের রাজ্যে সক্রেটিস ছিলেন অত্যন্ত উঁচু পর্যায়ের মানুষ। তিনি স্বাধীন ও আধুনিক চিন্তা করতেন। তার এ চিন্তাধারা তৎকালীন গ্রিসের তরুণ সমাজকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। সক্রেটিসের এ প্রভাব শাসকশ্রেণিকে ভাবিয়ে তোলে। সক্রেটিস গ্রিসের যুবকদের বিপথগামী করছে এ অদ্ভুত অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। তিনি জ্ঞানকে জনসাধারণের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসেন। হেমলক বিষপানে সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ কার্যকর করা হয়।
প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রে দুই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের কথা বলেছেন। এর একটি হচ্ছে শারীরিক শিক্ষা, যার মাধ্যমে শরীর গঠিত হবে। অপরটি হচ্ছে মিউজিক, যা একজন মানুষের সুকুমার বৃত্তিকে বিকশিত করবে। শরীর ও মনের বিকাশ সাধনে এ দুই ধরনের শিক্ষার বিশেষ ভূমিকা আছে।
তবে প্লেটোর আইডিয়েল স্টেট বা আদর্শ রাষ্ট্র আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কোথাও বাস্তবায়িত হয়নি। এটি কল্পনাপ্রসূতই রয়ে গেছে। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা থেকে আমরা অনুধাবন করতে পারি কোনো রাষ্ট্রের শাসক যদি শিক্ষিত, জ্ঞানী ও ন্যায়পরায়ণ না হয়, তাহলে সেই দেশের মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আর যদি শাসকশ্রেণি উদার, জ্ঞানী ও ন্যায়পরায়ণ হয়, তাহলে সেই দেশের মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার নিয়ে শান্তিতে বসবাস করতে পারে।
আমরা আজকে কেন বলছি ‘প্লেটোর দর্শন আজও প্রেরণার উৎস?’ মানুষ প্লেটোর দর্শন নিয়ে ভাবছে। এর তাৎপর্য উপলব্ধি করার চেষ্টা করছে। আমরা যদি একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে চিন্তা করি, তাহলে দেখব, যে রাষ্ট্রের শাসক প্রকৃত শিক্ষিত ও উদার, সেই রাষ্ট্রে সাধারণত জনস্বার্থবিরোধী কাজ কম হয়। রাষ্ট্র ভালোভাবে পরিচালিত হয়। মানুষ তার ন্যায়সংগত অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে। স্মর্তব্য, উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেটধারী হলেই একজন মানুষ প্রকৃত শিক্ষিত হয় না। প্রকৃত শিক্ষিত ও জ্ঞানী মানুষ কখনো প্রতারক বা গণবিরোধী হতে পারেন না।
রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রের অবসানে গণতন্ত্রের সূচনা হয়। ফরাসি দার্শনিক রুশো বলেছিলেন, মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন হলেও সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত। মানুষকে এ শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে কে? নিশ্চিতভাবেই অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠী। রুশোর মতে, মানবজাতিকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে হবে। তাই তিনি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা চিন্তা করেছিলেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রুশোর সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে, তিনিই প্রথম জেনারেল উইল বা ‘সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব’ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেছিলেন, সাধারণ মানুষের ইচ্ছাতেই সরকার গঠিত হবে। রুশোর এ ধারণার ওপর ভিত্তি করেই গণতন্ত্রের সূচনা হয়। কিন্তু গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের মধ্যেও নানা ত্রুটি লক্ষ করা যায়। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার যদি প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়, তাহলে স্বৈরাচারের উত্থান ঘটতে পারে। অর্থাৎ রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র কিংবা গণতন্ত্র-সব রাষ্ট্রব্যবস্থায় সুশাসনের জন্য প্রয়োজন প্লেটো কল্পিত শিক্ষিত জ্ঞানী শাসক।
আমরা যদি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখব, আমাদের এখানে তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত অনেকেই রাষ্ট্রপরিচালনা করেছেন; কিন্তু তাদের মধ্যে প্রকৃত শিক্ষিত, সৎ ও জ্ঞানী শাসকের সংখ্যা ছিল খুবই কম। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রে প্রকৃত শিক্ষিত শাসকের প্রচণ্ড অভাব পরিলক্ষিত হয়। যে দেশের রাজা বা শাসক অল্পশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত, সেসব দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পতিত হয়; সেখানে নৈরাজ্য-অনাচার বেশি পরিলক্ষিত হয়। একজন প্রকৃত শিক্ষিত ও জ্ঞানী ব্যক্তি কখনোই স্বৈরাচারী বা গণবিরোধী হতে পারেন না। তিনি আবেগ নয়, বিবেকবোধ দ্বারা পরিচালিত হন। তার মাঝে সবসময় বিবেকবোধ জাগ্রত থাকে। আর সেই বিবেকবোধই তাকে জনস্বার্থবিরোধী কাজ করা থেকে বিরত রাখে। জনগণের জন্য দুর্ভোগ সৃষ্টি করতে পারে এমন আইন বা কাজ করা থেকে তিনি বিরত থাকেন। যদি কোনো দেশে অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত ব্যক্তি রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব পান, তাহলে তার মাঝে এক ধরনের অহমিকা তৈরি হয়। তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করতে থাকেন। তিনি মনে করেন, দেশ তার নিজস্ব সম্পত্তি, কাজেই দেশ শাসনের ব্যাপারে অন্য কারও কথা বলার অধিকার নেই।
বিগত সাড়ে ১৫ বছরে আমরা বাংলাদেশে কী দেখলাম? বিগত সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে দেশে একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরশাসন কায়েম করে। হেন অপরাধ এবং মানবতাবিরোধী কাজ নেই, যা তারা করেনি। ওই সরকার দুঃশাসনের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। ঠিক একইভাবে স্বাধীনতা-উত্তরকালে (১৯৭২-১৯৭৫) তদানীন্তন সরকার বাংলাদেশে দুঃশাসনের ইতিহাস গড়েছিল। বিগত সরকার আমলে রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে অধিকাংশ মন্ত্রী ছিলেন কার্যত অর্ধশিক্ষিত। তারা চাটুকারিতা এবং ব্যক্তি পূজায় এতটাই মগ্ন ছিলেন যে, সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। কোনো ধরনের সমালোচনা তারা সহ্য করতে পারতেন না। উন্নয়নের নামে তারা দেশ থেকে অর্থ লুটে নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন। বাংলাদেশ বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি প্রকৃত শিক্ষিত, সৎ ও জ্ঞানী শাসক পেতাম, তাহলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুযোগ কাজে লাগিয়ে টেকসই জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে পারতাম। কিন্তু শাসকদের অপরিণামদর্শিতার কারণে সেই সুযোগ আমরা হেলায় হারিয়েছি। তারা জাতীয় উন্নয়নের চেয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত সুবিধা অর্জনের প্রতিই ছিলেন বেশি তৎপর।
আমাদের দেশে এমন একজন শাসকের প্রয়োজন, যিনি হবেন প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত, প্রাজ্ঞ, সৎ এবং দার্শনিক চিন্তায় সমৃদ্ধ। তিনি সব ধরনের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্রীয় কল্যাণ কামনা করবেন এবং সে লক্ষ্যে অবিরাম কাজ করে যাবেন। জনগণকে শাসক নির্বাচনের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। মূলত সে কারণেই আমরা বলছি, দার্শনিক প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা এখনো আমাদের পথনির্দেশনা দিতে পারে। মনে রাখতে হবে, শাসক হচ্ছেন জনগণের অধিকার সুরক্ষা প্রদানের আমানতদার মাত্র, কোনোভাবেই রাষ্ট্রের মালিক নন।
অধ্যাপক ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত
