বাংলাদেশে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কতটা দরকারি
ড. শাহ জে মিয়া
প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গত সপ্তাহে আমার লেখায় আমি সমাজব্যবস্থা ৫.০ (Society 5.0)-এর ধারণা নিয়ে বিশদভাবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আলোচনা করেছিলাম। সমাজব্যবস্থা ৫.০ হলো ধারাবাহিকভাবে সামাজিক বিবর্তনের সবচেয়ে আধুনিক পর্যায়, যেখানে সমাজব্যবস্থা ১.০ ছিল পশু শিকারনির্ভর; সমাজব্যবস্থা ২.০ ছিল কৃষিনির্ভর; সমাজব্যবস্থা ৩.০ ছিল শিল্পনির্ভর; এবং সমাজব্যবস্থা ৪.০ হলো তথ্যপ্রযুক্তি বা ইন্টারনেটনির্ভর। অনেক গবেষক বর্তমানে সমাজব্যবস্থা ৫.০কে ‘সুপার-স্মার্ট সোসাইটি’ও বলছেন। যা হোক, সমাজব্যবস্থা ৫.০-এ রূপান্তরকে আমরা ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের’ সঙ্গে তুলনা করতে পারি, কারণ উভয় ধারণাই অর্থনৈতিক বিশ্বে একটি নতুন ধরনের মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। তবে সমাজব্যবস্থা ৫.০ মূলত চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চেয়েও বিস্তৃত একটি ধারণা, যা পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত, কারণ এটি আমাদের এ সময়ের ডিজিটাল জীবনযাত্রায় সম্পূর্ণরূপে প্রভাব ফেলেছে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, যা 4IR বা ইন্ডাস্ট্রি (শিল্প) ৪.০ নামেও পরিচিত, একবিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির প্রতিনিধিত্ব করছে। শিল্পবিপ্লব একটি ধারাবাহিক অগ্রগতির পরিচয় বহন করে। আধুনিক সমাজব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয় ১৭৬০ সালের দিকে প্রথম শিল্পবিপ্লবের হাত ধরে। মূলত ব্রিটেনে স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কার এবং ইঞ্জিনচালিত মেশিন ও টুলস শিল্পবিপ্লবের ধারণার জন্ম দেয়। প্রায় ১০০ বছর ধরে প্রথম শিল্পবিপ্লবের ধারণা চলতে থাকে। ১৮৭০ সালের দিকে বিদ্যুৎচালিত মেশিন একটি নতুন শিল্পবিপ্লব নিয়ে আসে। সেটিই হলো দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের গোড়াপত্তন। এ শিল্পবিপ্লবকে প্রযুক্তিগত বিপ্লবও বলা হয়েছিল। দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবও প্রায় ১০০ বছর স্থায়ী হয়। ১৯৭০ সালের দিকে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের ধারণা আমাদের সামনে আসে। এ শিল্পবিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি ছিল বেশ কয়েকটি আবিষ্কার। তার মধ্যে ট্রানজিস্টর ও ইন্টারনেট (ARPANET নামে পরিচিত ছিল) অন্যতম। ট্রানজিস্টরচালিত মেশিন এবং ইলেকট্রনিক্স টুলস শিল্পে এনে দেয় গতি ও সহজলভ্যতা। সেই সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে ইন্টারনেট পুরো পৃথিবীকে আরও সংযুক্ত করে। তৃতীয় শিল্পবিপ্লবকে ডিজিটাল শিল্পবিপ্লবও বলা হয়েছিল। তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের ধারণা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ২০১০ সাল নাগাদ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ধারণার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের ইতি ঘটে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব একটি বৈপ্লবিক ধারণার জন্ম দেয়, যেখানে সাইবার-ফিজিক্যাল সিস্টেম, ইন্টারনেট-অফ-থিংস, তার সঙ্গে ক্লাউড কম্পিউটিং ভৌত পৃথিবীর সঙ্গে ভার্চুয়াল জগৎকে এমনভাবে সংযুক্ত করেছে-যেখানে মানুষ, যন্ত্র ও ইন্টারনেট একটি অসাধারণ মেলবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে।
আইবিএমের মতে, শিল্প ৪.০ মূলত স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং সম্পর্কে কথা বলে, যা শিল্পব্যবস্থাকে ডিজিটাল রূপান্তরের মাধ্যমে কোম্পানিগুলোকে তাদের পণ্য উৎপাদন, উন্নতি এবং বিতরণের জন্য রিয়েল-টাইম সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদন সুবিধা এবং কার্যক্রমজুড়ে ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT), ক্লাউড কম্পিউটিং বিশ্লেষণ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা মেশিন লার্নিংসহ নতুন প্রযুক্তিগুলোকে একীভূত করছে।
এখানে বলতে হয়, স্মার্ট শিল্পকারখানাগুলো উন্নত সেন্সর, এমবেডেড সফ্টওয়্যার এবং রোবোটিক্স দিয়ে সজ্জিত, যা ডেটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে উন্নত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে। এ ডিজিটাল প্রযুক্তিগুলো শিল্পব্যবস্থায় অটোমেশন থেকে শুরু করে ভবিষ্যদ্বাণীমূলক রক্ষণাবেক্ষণ, মেশিনগুলোর নিজে থেকেই অপ্টিমাইজেশন এবং সর্বোপরি গ্রাহকদের আরও উন্নত সেবা প্রদানের জন্য একটি নতুন স্তর তৈরি করে, যা আগে সম্ভব ছিল না। আইবিএম ইনস্টিটিউট ফর বিজনেস ভ্যালুসের এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং উৎপাদন যন্ত্রের ত্রুটি শনাক্তকরণে ৫০ শতাংশ উন্নতি এবং উৎপাদনে ২০ শতাংশ পর্যন্ত উন্নতি সাধন করতে পারে। মূলত শিল্প ৪.০ ধারণা ও প্রযুক্তিগুলো সব ধরনের শিল্প কোম্পানিতে প্রয়োগ করা যেতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে বিচ্ছিন্ন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, সেই সঙ্গে তেল ও গ্যাস, খনি এবং অন্যান্য শিল্প বিভাগ।
আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, সমসাময়িক একাডেমিক অবদানগুলো শিল্প ৪.০ এবং মূল্য সংযোজনের মধ্যে সংযোগগুলোকে তুলে ধরে; তবে এক্ষেত্রে বিভিন্ন শিল্পের বিষয়ে সীমিত জ্ঞান রয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, উৎপাদনের ওপর জোর দেওয়া হলেও পরিষেবা শিল্পকে উপেক্ষা করা হয়েছে। একটি উল্লেখযোগ্য গবেষণায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, পরিষেবা ক্ষেত্রে শিল্প ৪.০ প্রযুক্তির রূপান্তরিত প্রকৃতি সত্ত্বেও একাডেমিক দিক থেকে এ বিষয়ে সীমিত মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। তদুপরি, কর্মক্ষমতার ক্ষেত্রে শিল্প ৪.০ প্রযুক্তির প্রতিশ্রুতি কীভাবে শিল্পগুলো উপলব্ধি করে, তা খুব কমই জানা যায়। বিশেষ করে উদীয়মান অর্থনীতির ক্ষেত্রে।
আধুনিক প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে তার শক্তিগুলোকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ শিল্প ৪.০-এর ধারণাটি থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে উপকৃত হতে প্রস্তুত। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা ইউনিভার্সিটি জার্নাল অব ম্যানেজমেন্ট (খণ্ড ১৪, নং ১) অনুসারে, দেশের ৩৮.৫২ বিলিয়ন ডলারের পোশাকশিল্প এআই, সেন্সর, ইআরপি, এসএমভি, জিএসডি, বিগ ডেটা, ক্লাউড এবং এম২এম যোগাযোগের মতো প্রযুক্তি গ্রহণ করে শিল্প ৪.০ ধারণা প্রয়োগের জন্য প্রস্তুত। এ পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতার সুযোগ বৃদ্ধি করবে এবং তা প্রযুক্তিচালিত উৎপাদন ও পরিষেবা খাতে দেশের প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখবে।
শিল্প ৪.০ উদ্যোগ বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ উভয়ই উপস্থাপন করে। আমাদের দেশটি শিল্প ৪.০ কৌশল ডিজাইন ও চাহিদা পূরণের জন্য সরঞ্জাম সংগঠিত করার ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হলেও উৎপাদনব্যবস্থাকে অপ্টিমাইজ করে এমন স্মার্ট কারখানা তৈরির সম্ভাবনাও এর রয়েছে। এ পরিবর্তনকে সহজতর করার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অবগতি, সরঞ্জাম সহযোগিতা এবং প্রণোদনা প্রদানে সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শিল্প ৪.০ এজেন্ডার প্রতি বাংলাদেশের অঙ্গীকার স্পষ্টতই কার্বনমুক্তকরণ এবং স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের প্রচেষ্টার মাধ্যমে স্পষ্ট হতে পারে। পণ্যভিত্তিক ব্যবসায়িক মডেল গ্রহণ এবং খাত-নির্দিষ্ট উদ্যোগে বিনিয়োগের মাধ্যমে অটোমেশন এবং আসন্ন শিল্প ৪.০ দ্বারা সৃষ্ট চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার লক্ষ্য নির্ধারণ খুবই জরুরি। এটি একটি ব্যাপক পদ্ধতি, যার লক্ষ্য দেশের শিল্প সক্ষমতা বৃদ্ধি, উৎপাদনশীলতা উন্নত করা এবং টেকসই কর্মসংস্থান তৈরি করা। সর্বোপরি আমি বলতে পারি, যদি শিল্প ৪.০ ধারণা সম্পূর্ণরূপে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়, তাহলে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী এক্ষেত্রে নিজেকে একজন নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।
আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, শিল্প ৪.০ অন্তর্ভুক্তিমূলক জিডিপির নিরবচ্ছিন্ন বৃদ্ধির মাধ্যমে সম্পদ সর্বাধিক করার এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশের মতো সামাজিক উন্নয়ন সূচকগুলোতে উন্নতির বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করবে। টেকসই উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান এবং মজুরি অর্জন, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং মূল্য শৃঙ্খলে গতিশীলতা এবং উন্নয়নশীল দেশের সংস্থাগুলো এটি বাস্তবায়নে যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তা ব্যাপকভাবে পরিচিত। এর মধ্যে রয়েছে-১. নতুন (ঝুঁকিপূর্ণ) প্রযুক্তি কেনার জন্য তহবিল সংগ্রহ, ২. কর্মী ও কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং ৩. আনুভূমিক সম্প্রসারণের জন্য জমিপ্রাপ্তি, বিশেষ করে অবস্থানগত ক্লাস্টারগুলোয়। এ সমস্যাগুলোর পাশাপাশি অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, ইউটিলিটি সরবরাহ এবং নীতিমালার পূর্বাভাসযোগ্যতা রয়েছে এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত সামগ্রিক সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার দরকার হবে। সুশাসনের মাধ্যমে নীতিগত প্রতিক্রিয়া গঠনের সময় এবং বিনিয়োগের অনুশীলন বৃদ্ধির মাধ্যমে এ দ্বিতীয় বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের আধুনিক রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপি দেশের শিল্পবিপ্লবকে শক্তিশালী করার জন্য এ দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রেরণাগুলোকে তাদের ৩১ দফায় একীভূত করতে পারে। এ বিষয়টি এখন একটি সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে, কারণ উপযুক্ত নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন এখন প্রত্যেক নাগরিকেরই প্রত্যাশা।
সবশেষে বলতে চাই, পঞ্চম শিল্পবিপ্লব (৫ আইআর), যা ইন্ডাস্ট্রি ৫.০ নামেও পরিচিত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স এবং নবায়নযোগ্য শক্তির মতো উন্নত প্রযুক্তি এবং মানুষের মধ্যে নতুন প্রযুক্তির সহযোগিতার সুযোগ সৃষ্টির ওপর জোর দেয়। এর লক্ষ্যই হচ্ছে টেকসই, মানবকেন্দ্রিক এবং স্থিতিস্থাপক শিল্প তৈরি করা। এক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং রোবটিক্সের মতো প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে নতুন সুযোগ তৈরি করে চাকরির বাজারে নতুন নতুন পণ্য ও পরিষেবা তৈরি করা, যা রূপান্তরিত ব্যবস্থাপনাকে সামনে নিয়ে আসে। এখানে আরও বলতে পারি, এ বিপ্লব কর্মক্ষেত্রের প্রক্রিয়াগুলোকে উন্নত করার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এবং নিশ্চিত করে যে, প্রযুক্তি মানুষের ক্ষমতা প্রতিস্থাপনের পরিবর্তে তাদের পরিপূরক হবে।
ড. শাহ জে মিয়া : প্রফেসর অব বিজনেস এনালিটিক্স অ্যান্ড অ্যাপ্লাইড এআই, নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটি, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া
