ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী লুটেরাদের জন্য খারাপ খবর
মুজতবা আহমেদ মুরশেদ
প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করে ইউরোপ বা আমেরিকায় নাগরিকত্ব পাবে, এমন বাংলাদেশিদের স্বপ্ন চুরমার করে দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে ‘নিরাপদ’ রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করে। এ প্রথম এমন বিপত্তি বাধিয়েছে ওরা। কি করে ঘটল? ইতালি আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সদর দপ্তরে জানিয়েছে, তারা আর বাংলাদেশের লোককে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে রাজি না। তাদের বক্তব্য, বাংলাদেশ এখন রাজনৈতিকভাবে নিরাপদ রাষ্ট্র। খবর অনুযায়ী, ইউরোপীয় কমিশনের ১৬ এপ্রিল প্রকাশিত তালিকায় বাংলাদেশ, কসোভো, কম্বোডিয়া, মিসর, ভারত, মরক্কো ও তিউনিশিয়ার নাম অন্তর্ভুক্ত।
মূলত, ইতালির লোকজন ও প্রশাসন বাংলাদেশের মানুষদের নানাবিধ নেতিবাচক আচরণে প্রচণ্ড বিরক্ত। ২০০৪ সালের অক্টোবরে জার্মানি থেকে সুইজারল্যান্ড হয়ে ইতালির রাজধানী রোমে প্রবেশ করে সে অভিজ্ঞতা আমার। আসলে আমাদের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেই এ পথ তারা বেছে নিয়েছে। তবে যে কারণেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকুক, যারা এরই মধ্যে সেখানে পাড়ি দিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছে, তাদের ভবিষ্যৎ জটিল আবর্তে পড়ল।
বিবিসি বাংলার খবরে প্রকাশ, ‘যত দেশ থেকে অভিবাসীরা ইউরোপে পাড়ি দেয়, তার মাঝে প্রথম সারিতে বাংলাদেশ। ২০২৩ ও ২০২৪ সালের সংখ্যার বিবেচনায় বাংলাদেশ ছিল ছয় নম্বর শীর্ষ দেশ, যেখান থেকে অ্যাসাইলাম বা আশ্রয় চাওয়া হয়।
সবচেয়ে বেশিসংখ্যক আশ্রয়প্রার্থী হিসাবে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে শীর্ষ দেশগুলো ছিল যথাক্রমে সিরিয়া, আফগানিস্তান, ভেনিজুয়েলা, তুরস্ক ও কলম্বিয়া। এ তথ্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এজেন্সি ফর অ্যাসাইলামের। তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ৪৩ হাজার ২৩৬ জন বাংলাদেশি আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছে। একই সময়ে পেন্ডিং বা ঝুলে ছিল ৪৭ হাজার ৭৭৮টি আবেদন। যদিও বাংলাদেশিদের আবেদন সফল হওয়ার হার বেশ কম।
আশ্রয়প্রত্যাশীদের মাত্র তিন দশমিক ৯৪ শতাংশের মতো সফল হয়, ৯৬.০৬ শতাংশ ব্যর্থ হয়। অর্থাৎ প্রস্তাবের প্রথম যে দিকে ২০ শতাংশের কম সফলতার হার বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সে হিসাবে বেশ নিচেই রয়েছে বাংলাদেশিরা।’
রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করার ধরনে সাধারণত দেখা যায়, যখনই বাংলাদেশে সরকার বদল হয় বা সরকার বদলে একটা রাজনৈতিক দল আরেকটা রাজনৈতিক দলের কর্মীদের ওপর অত্যাচার করে, তখন সেই অত্যাচারিত দলের সদস্য হিসাবে নিজেকে পরিচয় দিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে। এ ফর্মুলায় বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার লোক নাগরিকত্ব পেয়েছে। কিন্তু নতুন এ সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশসহ তালিকাভুক্ত দেশগুলোর নাগরিকদের রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে এবং সেহেতু তাদের আবেদন প্রক্রিয়া দ্রুত যাচাই-বাছাইয়ের আওতায় আসবে। ইউরোপীয় কমিশনের দিক থেকে বলা হয়েছে, গত বছর সিদ্ধান্ত নেওয়া ‘অভিবাসন ও আশ্রয় চুক্তি’র কিছু দিকের বাস্তবায়ন দ্রুতগতিতে করার প্রস্তাব করা হচ্ছে, যা ২০২৬ সালের জুন মাস থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। এ সাত দেশ থেকে যাওয়া নাগরিকদের আবেদনগুলো ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, এমন ধারণা থেকেই তাদের আবেদন তিন মাসের মধ্যে দ্রুত নিষ্পত্তি করা হবে।
রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের প্রক্রিয়াটি কী? একজন লোক ইউরোপে ঢুকে প্রথমে যা করে, তা হলো, রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে সেই দেশে দরখাস্ত। সেই আবেদনটিকে মামলা হিসাবে ওই দেশ বিবেচনায় নেয়। এ চিত্রের ওপর এবার টাটকা টাটকা শোনা যাচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের এ সিদ্ধান্তকে মানবাধিকার সংস্থাগুলো কঠোর সমালোচনা করেছে। তাদের মতে, প্রতিটি আশ্রয়প্রার্থীর আবেদন তার ব্যক্তিগত পরিস্থিতি অনুযায়ী বিচার করা উচিত; কোনো দেশে ‘নিরাপদ’ বা ‘অসম্পূর্ণ নিরাপদ’ হিসাবে বিবেচনা করে সেই ব্যক্তির আবেদন স্বয়ংক্রিয়ভাবে খারিজ করা ঠিক নয়।
মূলত ওই দেশগুলো তাদের মাটিতে অপরাধী ধরনের লোকদের দ্বারা বিরক্ত। এ প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা না বললেই নয়। ১৭ বছর ঢাকার জার্মান দূতাবাসে রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেছি, সময়কাল ছিল ১৯৯৭ থেকে ২০১৩। সেই সময় আমি বাংলাদেশ থেকে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়া প্রার্থীদের ফাইল পরীক্ষা ও অনুমোদনের চূড়ান্ত দায়িত্বে ছিলাম। নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক আবেদন বাংলাদেশে আইনজীবীর মাধ্যমে যাচাই-বাছাই হয়ে দূতাবাসে পৌঁছত এবং এরপর সেগুলোর আবার পরীক্ষা করা আমার কাজ। আমার দেখা অভিজ্ঞতার বিস্ময় হলো, এ প্রার্থীদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠই জাল দলিল ব্যবহার করে দাবি করত, তারা রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্য এবং দেশে সহিংসতার শিকার। সত্যি বলতে, কিছুজন ব্যতিরেকে, বেশির ভাগ প্রকৃত রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার নয়, বরং সুযোগসন্ধানী।
যাকগে, রাজনৈতিক আশ্রয় সংক্রান্ত এ দৃশ্যের উলটো দিকে ইউরোপের মানবাধিকার সংস্থাগুলো এমন সিদ্ধান্তের নিন্দা করে বলছে, এর ফলে তালিকাভুক্ত দেশগুলো থেকে আসা আশ্রয়প্রার্থীদের আবেদন দ্রুত যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ পাবে ইইউ দেশগুলো। ইইউর অভিবাসনবিষয়ক কমিশনার মাগনুস ব্লুনার বলেন, ‘আশ্রয় আবেদন নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য জটের মুখে পড়েছে অনেক সদস্য দেশ। ফলে আমরা এখন যা করতে পারি, সেটা হলো আশ্রয় ইস্যুতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সমর্থন জানানো, যেটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।’
আসলে, ইউরোপের দেশগুলোতে অতি-ডানপন্থি ও অভিবাসনবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব বেড়েই চলেছে। নির্বাচনেও তারা ভালো ফল করছে বলে অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসন ঠেকাতে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়াদের ডিপোর্টেশন বা ফেরত পাঠানোর চাপে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
কমিশন জানিয়েছে, এটি কিন্তু এমন নয় যে, এ কেবল নিরাপদ দেশ ঘোষণা। সত্যিকারের সংঘাতে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারে বলেও উল্লেখ করেছে কমিশন। উদাহরণস্বরূপ ইউক্রেনের কথা বলা হয়েছে। কমিশন বলেছে, ১৬ এপ্রিল প্রকাশিত তালিকাটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বড় হতে পারে বা পর্যালোচনা করা হতে পারে। বর্তমানে যেসব দেশ থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আশ্রয়প্রার্থী ইউরোপে আসছেন, তাদের বিবেচনায় এ তালিকা তৈরি হয়েছে।
এখন প্রশ্ন উঠছে, যারা ইতোমধ্যেই ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে। তালিকাভুক্ত ‘নিরাপদ’ দেশের কারণে তাদের আবেদন প্রক্রিয়া কঠোরভাবে যাচাইয়ের মুখে পড়বে যেমন, তেমনি এটি সবসময় সম্পূর্ণ বাধ্যতামূলক নয়। ইউরোপীয় কমিশন প্রতিটি আবেদন ব্যক্তিগতভাবে যাচাই করার কথা বলছে। মূলত, ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশেই অভিবাসন প্রত্যাশীরা নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। যদিও এর মাঝে বড় একটা অংশের আবেদন নাকচ হয়ে যায়। এখন সেই বিষয়টি আরও দ্রুত গতিতে হবে এবং আবেদন নাকচ হলে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে। সুতরাং, এ নতুন পরিস্থিতিতে যারা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিপুল অর্থসহ আশ্রয় নিয়েছে, এদের অনেকেই বিপাকে পড়বে বলে মনে হচ্ছে। এর ফলে ওই দেশে তাদের জমাকৃত অর্থ ও সম্পদের জন্য বিশেষ ঝুঁকি তো তৈরি হবে বলেই ধারণা।
এই নীতির আরেকটি বিষয় অতি গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো, বাংলাদেশের অসংখ্য তরুণ, যারা বিদেশে প্রবেশ করতে দালালদের মাধ্যমে ঝুঁকি নিচ্ছিল, তারা এবার সতর্ক হবে। হাজার হাজার তরুণ উন্নত জীবনের আশায় বিপুল অর্থ খরচ করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশ করে কেউ জেলে পচে, কেউ কেউ বছরের পর বছর রাজনৈতিক আশ্রয় মামলার সুরাহায় থেকে সেই দেশে মানবেতর জীবনযাপন করে। এমনও হয়, কেউ কেউ বিপজ্জনক পথে জীবন হারায়। নতুন নিয়মের কারণে, এ তরুণরা শুরুতেই বাধার মুখে পড়বে এবং সম্ভাব্য ঝুঁকি এড়াতে দেশের মধ্যে থেকেই নিরাপদ জীবন কাটাতে সিদ্ধান্ত নেবে।
রেকর্ড ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে এ সংক্রান্ত চুক্তি হয়েছিল, যেটি ২০২৬ সালের জুন মাস থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। কিন্তু ইইউ জানিয়েছে, তারা প্রক্রিয়ার কাজ দ্রুত করার জন্য দুটি মূল নিয়ম আগেই পাশ করতে চায়। ইউরোপীয় কমিশন এ প্রস্তাব দিয়েছে ‘যাতে করে যেসব আশ্রয় আবেদন সম্ভবত অমূলক (ভিত্তিহীন) হবে, সেগুলো দ্রুত ও দক্ষভাবে নিষ্পত্তি করতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে সহায়তা করা যায়।’ এর একটা কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অভিবাসন প্রত্যাশীদের মধ্যে যাদের দেশে ফেরত যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়, তাদের মাত্র ২০ শতাংশেরও কমসংখ্যক মানুষকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়।
পরিশেষে বলা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘নিরাপদ’ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি, এদেশে দল করা অনেক লুটেরা নেতা-পাতিনেতার রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়াকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল। এ বাস্তবতায় যারা যথার্থই সহিংসতার শিকার, তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা যেমন সৃষ্টি হলো, তেমনি করে দেশের সম্পদ লুট করে ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়া লোকজনদের ‘আশার গুড়ে’ পড়ল ‘বালি’।
মুজতবা আহমেদ মুরশেদ : রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কবি ও কথাসাহিত্যিক
