Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

দৃষ্টিপাত

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি

অধ্যাপক ড. আনোয়ারউল্লাহ্ চৌধুরী

অধ্যাপক ড. আনোয়ারউল্লাহ্ চৌধুরী

প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি

তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। কোনোভাবেই এ মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা যাচ্ছে না। করোনা-উত্তর বিশ্ব অর্থনীতি যখন উত্তরণের পর্যায়ে ছিল, ঠিক তখনই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইন বিপর্যস্ত হয়। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রবণতা দেখা দেয়। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে নজিরবিহীন অর্থনৈতিক ও সামরিক অবরোধ আরোপ করে। এর পালটা ব্যবস্থা হিসাবে রাশিয়া বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল রপ্তানি বন্ধ করে দেয় অথবা কমিয়ে দেয়। ফলে পণ্য পরিবহণ ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। প্রতিটি দেশই উচ্চ মূল্যস্ফীতির অভিঘাতে জর্জরিত হয়ে পড়ে। এমনকি বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতির হার আগের ৪০ বছরের রেকর্ড অতিক্রম করে ৯ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকা (ফেড) ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ মন্থরতার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও পলিসি রেট (কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বল্পকালীন চাহিদা মেটানোর জন্য শিডিউল ব্যাংকগুলোকে যে ঋণ প্রদান করে, তার ওপর আরোপিত সুদ হার) ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দেয়। পলিসি রেট বৃদ্ধির ফলে ব্যাংক ঋণের সুদের হার (ব্যাংক উদ্যোক্তা ও গ্রাহক পর্যায়ে ঋণদানের সময় যে সুদ আরোপ করে) আনুপাতিক হারে বেড়ে যায়। ফলে গ্রাহকদের মাঝে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের আগ্রহ ও সামর্থ্য হ্রাস পায়। এতে বাজারে অর্থের জোগান কমে যায়। এছাড়া আরও কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এতে মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্তত ৭৭টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি রেট আগে ছিল ৫ শতাংশ। পর্যায়ক্রমে বাড়তে বাড়তে এখন তা ১০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। পলিসি রেট বৃদ্ধির পাশাপাশি আরও কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে অধিকাংশ দেশই তাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতির হার গত আগস্টে ছিল ২ দশমিক ৭০ শতাংশ। এখন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট ২৫ ভিত্তি পয়েন্ট কমিয়ে ৪ শতাংশ থেকে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশে নির্ধারণের উদ্যোগ নিয়েছে। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকার চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, চলতি অক্টোবর এবং আগামী ডিসেম্বরে তারা পলিসি রেট আরও কমানোর উদ্যোগ নেবেন। বছর শেষে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতির হার ২ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা বাড়িয়ে ১ দশমিক ৬ শতাংশ এবং বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশে স্থির রাখা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ১ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৭০ শতাংশে নেমে আসার পেছনে পলিসি রেট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই নয়, পলিসি রেট বৃদ্ধির প্রভাবে অন্যান্য দেশের অর্থনীতিতেও মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সমস্যাগ্রস্ত দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে। কয়েক বছর আগে শ্রীলংকা অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। দেশটি আন্তর্জাতিকভাবে ঋণখেলাপি দেশে পরিণত হয়। শ্রীলংকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে ঢালাওভাবে ঋণ গ্রহণ করেন। একপর্যায়ে দেশটি গৃহীত ঋণের কিস্তি পরিশোধে অপারগ হয়ে পড়ে। শ্রীলংকার ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থা এবং ক্ষমতাসীনদের ব্যাপক লুটপাটের কারণে দেশব্যাপী ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হলে একপর্যায়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। পরবর্তীকালে নতুন প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব গ্রহণের পর অর্থনৈতিক অবস্থা পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দেশটি সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করে। একপর্যায়ে শ্রীলংকার মূল্যস্ফীতি ৭৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। এখন তা ১ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। শ্রীলংকা এ বছর ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশা করছে।

দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্য কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। চীনের মূল্যস্ফীতির হার গত আগস্টে ছিল শূন্য দশমিক ৪১ শতাংশ। আগস্টে অন্যান্য দেশের মধ্যে হংকংয়ের ১ দশমিক ১ শতাংশ, ভারতের ২ দশমিক ০৭ শতাংশ, জাপানের ২ দশমিক ৭ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ২ দশমিক ৩ শতাংশ, ভুটানের ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ, মালদ্বীপের ৪ শতাংশ, ভিয়েতনামের ৩ দশমিক ২৪ শতাংশ, নেপালের ১ দশমিক ৬৮ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ার ১ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ফিলিপাইনের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশে গত আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এর অর্থ হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশই তাদের অর্থনীতিতে সৃষ্ট উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হলেও আমরা এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছি। আমরা উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমাতে পারছি না।

২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে এসে তা ৯ দশমিক ০২ শতাংশে উন্নীত হয়। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে একক মাস হিসাবে সবচেয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রত্যক্ষ করা যায় ২০২৪ সালের জুলাইয়ে। সেই সময় মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে। গত তিন বছর ধরে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এর পাশাপাশি মানুষের মজুরির হার আনুপাতিকভাবে বাড়ছে না। ফলে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি এবং মজুরি বৃদ্ধির প্রবণতা বিপরীতমুখী হওয়ার কারণে মানুষের দুর্ভোগ ক্রমেই বাড়ছে। সবচেয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক উচ্চমূল্য। নির্দিষ্ট আয়ের নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারগুলো উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সবচেয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির অভিঘাত সহ্য করতে না পেরে অনেক পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে বাধ্য হচ্ছে। দীর্ঘকালীন মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী হচ্ছে। পরিবারগুলো তাদের অবস্থান ধরে রাখতে পারছে না। অনেক পরিবারকে ঋণ করে চলতে হচ্ছে। প্রায়ই প্রচারমাধ্যমে প্রত্যক্ষ করা যায়, ব্যাংকিং সেক্টরে আমানতের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। মানুষের হাতে নগদ টাকা বাড়ছে বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে অনেক পরিবারকে তাদের নিত্যদিনের খরচ নির্বাহের জন্য ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থ উত্তোলন করে ব্যয় নির্বাহ করতে হচ্ছে। বাজারে গেলে অনুধাবন করা যায় জিনিসপত্রের দাম কতটা বেড়েছে। দেশে এর আগেও বিভিন্ন সময় উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতা প্রত্যক্ষ করা গেছে। কিন্তু কোনোবারই এত দীর্ঘ সময় ধরে মূল্যস্ফীতি বিরাজমান ছিল না।

বাংলাদেশ বর্তমানে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতা প্রত্যক্ষ করছে, তা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। বিগত সরকারের আমলে এ প্রবণতা শুরু হয়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতা শুরু হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশ সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করে আসছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের সাংঘর্ষিক নীতির কারণে মূল্যস্ফীতি না কমে বরং বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতা রোধে পলিসি রেট বারবার বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু পাশাপাশি ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশে ফিক্সড করে রাখে। ফলে শিডিউল ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আগের তুলনায় বেশি সুদে ঋণ গ্রহণ করলেও সেই ঋণের অর্থ উদ্যোক্তা এবং সাধারণ গ্রাহকদের মাঝে প্রদানের ক্ষেত্রে আগের চেয়ে বেশি সুদ আরোপ করতে পারেনি। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলো ঋণ সংকোচন নীতি গ্রহণ করে; যদিও সরকার সমর্থক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ব্যাংক ব্যবস্থাপনার ওপর চাপ প্রয়োগ করে ঋণ বের করে নেয়। একপর্যায়ে অবস্থা এমন হয় যে, বিরাজমান মূল্যস্ফীতির চেয়ে ব্যাংক ঋণের সুদের হার ছিল তুলনামূলক কম। পলিসি রেট বৃদ্ধির উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে বাজারে অর্থ সরবরাহ কমিয়ে আনা, যাতে ভোক্তারা চাইলেই পণ্য ক্রয়ের জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে না পারে। কিন্তু ব্যাংক ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশে ফিক্সড থাকার সময় সাধারণ গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে প্রত্যাশিত মাত্রায় ঋণ না পেলেও মহলবিশেষ তাদের প্রভাব বিস্তার করে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণের নামে হাতিয়ে নেয়। ফলে বাজারে অর্থ সরবরাহ কমানোর যে প্রচেষ্টা, তা সফল হয়নি।

সেই সময় এক মুদ্রানীতিতে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। বাস্তবে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। অথচ একই সময়ে শিল্পে ব্যবহার্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি ব্যাপকভাবে কমেছিল। কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি ১৪ শতাংশ করে কমেছিল। সংগত কারণেই প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে, তাহলে ব্যক্তি খাতে দেওয়া নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণের অর্থ কোথায় গেল? একশ্রেণির উদ্যোক্তা শিল্প স্থাপনের নামে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে তা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি ব্যাংক ঋণের অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

গত বছর জুলাইয়ে সংঘটিত ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটলে সরাসরি সমর্থনপুষ্ট ব্যবসায়ী গোষ্ঠীও দৃশ্যপট থেকে আড়ালে চলে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন প্রশাসন ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার (৯ শতাংশ) প্রত্যাহার করে তা বাজারভিত্তিক করে। এর ফলে বাজারে অর্থের জোগান কমে যায়। কিন্তু পদক্ষেপটি গ্রহণ করা হয়েছে অনেকটা বিলম্বে। বিগত সরকার আমলে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করা না হলে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করত না। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাজারভিত্তিক করার ফলে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। এ অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মারাত্মক স্থবিরতা নেমে আসতে পারে, যা কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত করবে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে সরকারের দারিদ্র্যবিমোচন কার্যক্রম বিঘ্নিত করবে।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে দ্রুত কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা। কিন্তু বিগত এক বছরেরও বেশি সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এক্ষেত্রে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি। অবশ্য এটা ঠিক, শুধু পলিসি রেট বৃদ্ধি অথবা সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ব্যাংক ঋণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রবণতা রোধ করা যাবে না। এজন্য আরও কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। বাজারব্যবস্থার ওপর সরকারের তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ব্যবসায়ীরা তাদের ইচ্ছামতো যে কোনো সময় পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করে গণদুর্ভোগ সৃষ্টি করতে পারেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কিছু নীতি-আদর্শ মেনে চলতে হয়। অধিকাংশ ব্যবসায়ীর মধ্যে ব্যবসায়িক নীতি-আদর্শ মেনে চলার প্রবণতা লক্ষ করা যায় না। তাদের কাছে অতি মুনাফা অর্জনই মূল লক্ষ্য বলে বিবেচিত হয়। বাজারে শক্তিশালী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট তৎপর রয়েছে। কিন্তু কোনো সরকারই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব স্বীকার করতে চায় না, দমন করা তো দূরের কথা। সরকার পরিবর্তন হলে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট তাদের রাজনৈতিক পরিচয় পালটে ফেলে। ফলে কোনো সরকারই তাদের কিছু বলে না। যারা পণ্য আমদানির সময় ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার করে, তারা যে পণ্য দেশে নিয়ে আসে, তা প্রদর্শিত মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে বিক্রি করে না। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় স্থানীয় বাজারে পণ্যের মূল্য সবসময়ই বেশি থাকে।

অর্থ উপদেষ্টা গত ৩০ সেপ্টেম্বর তার দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, চাঁদাবাজির কারণে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর বিভিন্ন মহল নতুন করে চাঁদাবাজিতে যুক্ত হয়েছে। আগে যারা চাঁদাবাজি করত, তারাও নেপথ্যে থেকে চাঁদাবাজি করছে। রাজনৈতিক সরকার ছাড়া চাঁদাবাজি বন্ধ করা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, আগে যেখানে এক টাকা চাঁদা নেওয়া হতো, এখন সেখানে দেড় টাকা থেকে ২ টাকা চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। আগামী জুনের মধ্যে তা ৭ শতাংশে নেমে আসবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। উল্লেখ্য, সাধারণভাবে বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিতে সাড়ে ৩ থেকে ৪ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় বলা যেতে পারে।

বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নির্ধারণের জন্য শহরের ৪২২টি এবং গ্রামের ৩১৮টি অর্থাৎ মোট ৭৪০টি পণ্যকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। এর মধ্যে বেশকিছু পণ্য আছে, যা সাধারণ মানুষ খুব একটা ব্যবহার করে না। মূল্যস্ফীতি ক্যালকুলেট করার সময় এসব অপ্রয়োজনীয় পণ্য বাদ দিয়ে মূল্যায়ন করা হলে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যেতে পারে।

এ মুহূর্তে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক। কারণ সাধারণ মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে বড়ই অসহায় অবস্থার মধ্যে রয়েছে। মূল্যস্ফীতির চাপে দেশের জনগণ এখন বিপর্যয়ের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।

অধ্যাপক ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম