Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

তারেক রহমানের সাক্ষাৎকারের নতুন আলোকপাত

শায়রুল কবির খান

শায়রুল কবির খান

প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তারেক রহমানের সাক্ষাৎকারের নতুন আলোকপাত

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ছবি: বিবিসি বাংলা

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ষড়যন্ত্রমূলক রায়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড হওয়ার পর কার্যত দলের শীর্ষ নেতৃত্বে আসীন হন তারেক রহমান। রাজনীতিতে তারেক রহমান বরাবরই ভিন্ন আলোয় উজ্জ্বল। বিশেষ করে পিতা মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সমরসৈনিক, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্বপ্নচারী রাষ্ট্রকল্পনা এবং মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ‘আপসহীন রাজনীতির’ সমন্বয় এনেছেন তিনি।

১৯৮৮ সালে বগুড়া জেলা গাবতলী উপজেলা বিএনপির সাধারণ সদস্য পদ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবন শুরু করা তারেক রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিগত দুই যুগ ধরে আলোচিত এ অধ্যায়ের নাম। যিনি রাজনীতির প্রধান চরিত্র হিসাবে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত। এ প্রতিষ্ঠার পেছনে তার সংগ্রাম, ত্যাগ ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দিকটিই বেশি প্রাসঙ্গিক। পাশাপাশি রয়েছে রাজনীতিতে নতুন নৈতিকতার অনুসন্ধানও।

বিশেষত, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর থেকে যেভাবে বিএনপিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, জনগণের সামনে হাজির করছেন নতুন নতুন পরিবর্তনের চিন্তা, যার সূত্রটি গ্রন্থিত ছিল ২০২২ সালে। ২০১৭ সালে বেগম খালেদা জিয়ার ভিশন-২০৩০ পথ ধরে ২০২২ সালে তিনি বাংলাদেশ পরিবর্তনে জাতির সামনে উপস্থাপন করেন ২৭ দফা; যার মূল অঙ্গীকার রাষ্ট্র ও দেশকে নতুন একটি দিগন্তের প্রান্তে নিয়ে যাওয়া।

সবশেষ ২০২৩ সালের জুলাইতে তিনি অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও দীর্ঘ মতবিনিময়ের পর রাখলেন আলোচিত ৩১ দফা।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি বাংলা ও ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে সোম ও মঙ্গলবার দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি দেখালেন ভবিষ্যৎ রাজনীতির একটি রূপরেখাও। সহনশীল, দৃঢ় এক রাজনীতিকের ভাষ্য উঠে এসেছে সাক্ষাৎকারে। পুরোনো দিনের সমালোচনার গৎবাঁধা যে রূপ, তা যেন তিনি অপরিচিত করে দিলেন।

সাক্ষাৎকার দুটিতে তিনি বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিরতার সংকট, এর থেকে উত্তরণের উপায়, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া, না-হওয়াসহ নানামাত্রিক বার্তা দিয়েছেন। গত মাসে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বিজয়ীদের অভিবাদন জানানোর মধ্য দিয়ে তরুণদের সামনে যে উদাহরণ রাখলেন, তা নিশ্চিতভাবে দেশের ছাত্ররাজনীতিতে পাথেয় হিসাবে কাজ করবে।

তারেক রহমানের রাজনৈতিক উদারতা ও নৈতিকতার আরেক নিদর্শনও দেখা গেল তার বক্তব্যে। বিবিসি বাংলার সম্পাদক সাব্বির আহমেদ ও সিনিয়র সাংবাদিক কাদের কল্লোলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ডাকসু নির্বাচনের প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতে পড়বে কিনা প্রসঙ্গে তিনি নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নার কথা উল্লেখ করেন। তার ভাষ্যে, ‘যেটা দেখলাম, বিভিন্ন মিডিয়াতে কিছু ব্যক্তি, যেমন-মান্না ভাই, উনি তো বোধহয় দুবার ভিপি ছিলেন। আমার থেকে অনেক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ। আমরা যদি উনার বক্তব্য শুনে থাকি বা ধরে থাকি, তাহলে তো আমি মনে করি না, কোনো কারণ আছে। ছাত্ররাজনীতি ছাত্ররাজনীতির জায়গায়, জাতীয় রাজনীতি জাতীয় রাজনীতির জায়গায়।’

২০২২ সালে যখন যুগপৎ আন্দোলনের মাঠ তৈরিতে ব্যস্ত বিএনপির সিনিয়র নেতারা, তখনই দলের শীর্ষনেতা তারেক রহমানের অঙ্গীকার ছিল, ভবিষ্যতে তিনি জাতীয় সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে পরিচালিত করার স্বপ্ন দেখেন। সাক্ষাৎকারে তিনি এ যুগপৎসঙ্গীদেরও তুলে ধরলেন এ ভাষায়, ‘প্রায় ৬৪টি রাজনৈতিক দল বিগত স্বৈরাচারের সময় যার যার অবস্থান থেকে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। আমরা চেষ্টা করেছিলাম কম-বেশি একসঙ্গে কাজ করার জন্য।’

উপমহাদেশের ইতিহাসে এত বেশি দিন নির্বাসিত জীবনযাপন করে একটি জনপ্রিয় দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার যে ঐতিহাসিক চরিত্র, তারেক রহমান তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। নেলসন ম্যান্ডেলা ২৭ বছর নির্বাসিত ছিলেন; গ্রিসের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জর্জ পাপান্দ্রেউ নির্বাসিত ছিলেন কয়েক বছর; আমাদের প্রতিবেশী ভারতের রাহুল গান্ধী ছিলেন কিছু সময় নির্বাসনে; পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টো ছিলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ২০১৩-২০১৮ নির্বাসনে ছিলেন। অতিসম্প্রতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফও ছিলেন লন্ডনে নির্বাসিত। নির্বাসনে ছিলেন ইরানের জাতীয় নেতা মরহুম খোমেনিও।

বিএনপির শীর্ষনেতা ১৭ বছর ধরে নির্বাসনে। কিন্তু তার সবসময় অতিবাহিত হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে, রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্মাণের কার্যক্রমে। সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই উল্লেখ করেন, ‘শারীরিকভাবে হয়তো ব্রিটেনে আছি, কিন্তু মনমানসিকতা সবকিছু মিলিয়ে আমি ১৭ বছর ধরে বাংলাদেশেই রয়েছি।’

তারেক রহমান দলের ভেতরে দুর্নীতি ও অনৈতিকতার বিরুদ্ধে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি শিগ্গির দেশে ফিরে আসবেন এবং দলের সংস্কার করবেন। সাক্ষাৎকারের একটি চিত্র তিনি নিজেই জানিয়েছেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারাই মনোনয়ন পাবেন, প্রাধান্য পাবেন, যাদের সম্পর্ক মানুষের সঙ্গে, যারা স্ব স্ব এলাকার উন্নয়নের জন্য নিবেদিত। স্পষ্ট, তারেক রহমান পুরো রাজনীতিতে একটি নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টির প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন।

নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, দেশের জনগণ তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। অপেক্ষা তার নিজেরও। বিবিসি বাংলার সাক্ষাৎকারে জানালেন, যত দ্রুত সম্ভব তিনি দেশে ফিরবেন। অংশ নেবেন ভোটেও।

বলা যায়, বিগত ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পলায়নপরতার পর নানাধর্মী রাজনৈতিক লিপ্সা সমাজের মধ্যে প্রচলন হলেও তারেক রহমান গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার ফেরানোর দীর্ঘদিনের স্বপ্নের বাস্তবে রূপান্তর ঘটাতে অঙ্গীকারবদ্ধ। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সংবাদপত্র, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নেও জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার উদার রাজনীতিচর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখবেন তিনি; এ বিষয়টিও জোরালোভাবে জানিয়েছেন।

৭ অক্টোবর বিবিসি বাংলার প্রশ্ন ছিল, আপনারা যদি ক্ষমতায় আসেন, সে ক্ষেত্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদ বা সংবাদ মাধ্যমের ওপর দমনপীড়নের বিষয়গুলো যে আর হবে না, সেই নিশ্চয়তা কি আপনি দিতে পারেন? প্রশ্নে দেশের ভবিষ্যৎ নেতা তারেক রহমানের জবাব, ‘জ্বি, পারি। একদম দিতে পারি। আপনি ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত পত্রপত্রিকা খুলুন। আমি কারও নাম উল্লেখ করব না, কোনো পত্রিকার কথা উল্লেখ করব না। শুধু খুলে দেখুন কীভাবে অনেক খবর ছাপা হয়েছিল। যার সত্যতা কিন্তু ছিল না, অপপ্রচার ছিল। কিন্তু অপপ্রচারটা সংবাদ হিসাবে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল।’

শায়রুল কবির খান : সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মী

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম