Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

আরব আমিরাতের গোপন সুদান যুদ্ধাভিযান

Icon

বাশির মোহাম্মদ কাতো

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আরব আমিরাতের গোপন সুদান যুদ্ধাভিযান

মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি সুদান। ছবি: সংগৃহীত

সোমালিয়ার পন্টল্যান্ড রাজ্যের বসাসো বিমানবন্দর। এখানে বিশাল উড়োজাহাজের অবতরণের গগনভেদী শব্দ বন্দরনগরীজুড়ে প্রতিধ্বনিত হয়। অবতরণের কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিমানটিকে চিহ্নিত করা যায়, এটি একটি সাদা আইএল-৭৬ (IL-76) ভারী সামরিক পণ্যবাহী বিমান, যা দেখতে প্রায় একই রকম অন্য একটি বিমানের পাশে পার্ক করছে। দুই বছর আগে যখন এ ধরনের বিমান বসাসোতে প্রথম নামা শুরু করে, তখন স্থানীয়দের কাছে এর আওয়াজ ছিল এক অস্বাভাবিক ঘটনা; কিন্তু এখন আর তা নয়। কিছুক্ষণ পরেই দেখা যায়, বিমানটি থেকে অঘোষিত ভারী সামরিক সরঞ্জাম খালাস করা হচ্ছে।

বসাসো বিমানবন্দরের একজন সিনিয়র পন্টল্যান্ড মেরিটাইম পুলিশ ফোর্স (PMPF) কমান্ডার, আব্দুল্লাহি (নিরাপত্তাজনিত কারণে ছদ্মনাম) মিডল ইস্ট আই-কে জানান, ‘এগুলো প্রায়ই আসে। আর সরবরাহকৃত পণ্যগুলো দ্রুত অন্য একটি অপেক্ষমাণ উড়োজাহাজে তুলে দেওয়া হয়, যা প্রতিবেশী দেশ হয়ে সুদানের আধাসামরিক বাহিনী র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সের (RSF) উদ্দেশে রওয়ানা দেয়।’ ফ্লাইট ট্র্যাকিং ডেটা, স্যাটেলাইট ছবি, একাধিক স্থানীয় সূত্র এবং মার্কিন ও আঞ্চলিক কূটনীতিকদের মতে, এ বিমান ও তাদের কার্গোর উৎস অত্যন্ত পরিষ্কার : সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE)।

উল্লেখ্য, সুদান ও আরএসএফ ৫০০ দিনেরও বেশি অবরোধের পর চলতি সপ্তাহে উত্তর দারফুর রাজ্যের রাজধানী এল-ফাশের দখল করেছে। এ বিজয়ের পর আধাসামরিক বাহিনীর যোদ্ধারা ভয়াবহ নৃশংসতা চালিয়েছে। তারা পালিয়ে যাওয়া বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যার ভিডিও করেছে। গণহত্যার হাত থেকে রেহাই পায়নি হাসপাতালগুলোও।

ট্র্যাক করে বসাসোতে আসা এ সামরিক পণ্যবাহী বিমানগুলোর মধ্যে একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন লক্ষ করা গেছে। বিমানগুলো বিমানবন্দরে বেশিক্ষণ অবস্থান করত না এবং যখন বিমানবন্দরের ব্যস্ততা কম থাকত, তখনই তারা আসত। এয়ার ট্র্যাফিক ডেটা দেখায়, ইউএই ক্রমবর্ধমানভাবে বসাসো বিমানবন্দর ব্যবহার করছে, এমনকি বিমানের আসার সময়ও তারা ঘন ঘন পরিবর্তন করে। সরঞ্জাম তোলা ও নামানোর সময় এগুলোকে কঠোর পাহারায় রাখা হয়, কারণ এগুলো এমন সংবেদনশীল সামরিক সরঞ্জাম ও রসদ, যা প্রকাশ্যে আনা হয় না। এসব সামরিক সামগ্রী বসাসোর বন্দর দিয়েও এসে থাকে।

বহু বছর ধরে, সংযুক্ত আরব আমিরাত জলদস্যুতা মোকাবিলায় গঠিত একটি আঞ্চলিক বাহিনী পন্টল্যান্ডের PMPF-কে অর্থায়ন করছে। সেখানকার সৈন্যরা বলছেন, পরিবহণ বিমানে আসা সামরিক সামগ্রীর একটি অংশও তাদের ক্যাম্পে আনা হয় না, কারণ এ চালানগুলো তাদের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। ফ্লাইট ট্র্যাকিং ডেটা পরীক্ষা করে মার্কিন গোয়েন্দারা জানিয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত বসাসোতে অস্ত্র সরবরাহ ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে, যার মধ্যে চীনের তৈরি ড্রোনও রয়েছে।

বসাসো বন্দরে গোপন সামরিক রসদ এবং ভাড়াটে যোদ্ধাদের আস্তানা :

বসাসো বন্দরের একজন সিনিয়র ম্যানেজার মিডল ইস্ট আই-এর কাছে প্রথমবারের মতো জানিয়েছেন, গত দুই বছরে আমিরাত বসাসো বন্দরের মাধ্যমে ৫ লাখেরও বেশি সন্দেহজনক কনটেইনার খালাস করেছে। সাধারণ কার্গো বা পণ্যের ক্ষেত্রে উৎপত্তির স্থান ও গন্তব্যের কাগজপত্র থাকলেও আমিরাতের এ চালানগুলোতে কনটেইনারের ভেতরের বস্তু সম্পর্কে কোনো বিবরণ নেই। কনটেইনারগুলো পৌঁছানোমাত্র চরম গোপনীয়তায় দ্রুত বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে প্রস্তুত থাকা বিমানে বোঝাই করা হয়। এতটাই গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়, যখন কোনো জাহাজ ঘাটে ভিড়ে, পন্টল্যান্ড মেরিটাইম পুলিশ ফোর্স পুরো বন্দর ঘিরে ফেলে এবং ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। কেবল কর্তব্যরত কর্মীদেরই প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় এবং পণ্য খালাস ও পরিবহণের সময় তারা যাতে কোনো কিছু রেকর্ড না করে, সে বিষয়ে স্পষ্ট সতর্কবার্তা দেওয়া থাকে। তাদের মতে, এ পণ্যগুলো তাদের দেশের জন্য নয়, আসলে বসাসোকে ট্রানজিট হিসাবে ব্যবহার করা হয়।

মিডল ইস্ট আই সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকার এবং পন্টল্যান্ডের আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিক্রিয়া জানার জন্য যোগাযোগ করলেও কোনো সারা মেলেনি। তবে, সংযুক্ত আরব আমিরাত এর আগে আরএসএফকে পৃষ্ঠপোষকতা করার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

আদেন উপসাগরের দক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত বসাসো বিমানবন্দরে কয়েকটি সুদৃঢ় সামরিক স্থাপনা রয়েছে। এর মধ্যে একটিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কমান্ডার ও নিরাপত্তা কর্মীরা থাকেন, যাদের অনেকেই দক্ষিণ আফ্রিকার বলে মনে করা হয়। বিমানবন্দরের উত্তর দিকে রয়েছে আরেকটি শিবির, যেখানে সুদানের যুদ্ধে জড়িত কলাম্বিয়ান ভাড়াটে যোদ্ধারা থাকে। মিডল ইস্ট আই-এর হাতে আসা বেশকিছু ছবিতে দেখা গেছে, কয়েক ডজন কলাম্বিয়ান পিঠে ব্যাগ নিয়ে বসাসোতে বিমান থেকে নামছে এবং সরাসরি তাদের শিবিরের দিকে যাচ্ছে। বিমানবন্দরের ম্যানেজারও তাদের চিনতে পেরে জানিয়েছেন, কলাম্বিয়ার অনেক ভাড়াটে যোদ্ধা এখানে অবস্থান করছে। এরা মূলত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক ফ্লাইটে বসাসোতে আসার পর আরএসএফ-এর পক্ষে যুদ্ধের জন্য সুদানে চলে যায়। এমনকি এসব ভাড়াটে সেনা তাদের শিবিরের ভেতর একটি নতুন হাসপাতালও তৈরি করেছে, যেখানে সুদান থেকে আহত সৈন্যদের চিকিৎসা করা হয়।

বসাসো হলো আদেন উপসাগর এবং লোহিত সাগরজুড়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত কর্তৃক নির্মিত ও সম্প্রসারিত ঘাঁটিগুলোর একটি শৃঙ্খলের অংশ। এ ঘাঁটিগুলো হলো মায়ুন, আবদ আল-কুরি, সামহা দ্বীপপুঞ্জ, সোমালিল্যান্ডের বেরবেরা বন্দর এবং ইয়েমেনের মোচা বন্দর-যেগুলোর কোনোটিই আনুষ্ঠানিকভাবে ইউএই-এর নিয়ন্ত্রণে নেই, বরং তাদের মিত্রদের নিয়ন্ত্রণে। বসাসোর সৈন্যরাও বলছেন, এলাকায় কলাম্বিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধাদের উপস্থিতি ও কার্যকলাপ ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে, যার ফলে PMPF-এর অনেক সৈন্যই নিজেদের নিরাপদ মনে করছেন না। ২০২৩ সালের এপ্রিলে সুদানের যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে, দেশটি হাজার হাজার সোমালি শিক্ষার্থীকে বৃত্তি প্রদান করত, যার অন্যতম সুবিধাভোগী ছিলেন সোমালিয়ার বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী আহমেদ মোয়াল্লিম ফিকি। পন্টল্যান্ড মেরিটাইম পুলিশ ফোর্সের বেশকিছু সৈন্য স্বীকারও করেছেন, সুদান যুদ্ধে জড়িত বিদেশি সেনাদের সহযোগিতা করতে তারা অস্বস্তিবোধ করছেন এই ভয়ে যে, তাদের কাজ এমন একটি দেশের বিরুদ্ধে গণহত্যায় পরোক্ষভাবে সমর্থন দিতে পারে, যাদের তারা ঘনিষ্ঠ মিত্র মনে করে।

দীর্ঘদিন ধরে, সংযুক্ত আরব আমিরাত মোগাদিশুকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে এবং আল-শাবাবের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীর মোকাবিলা করার জন্য সোমালি সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। কিন্তু এ সম্পর্ক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্যভাবে খারাপ হয়েছে, কারণ ইউএই পন্টল্যান্ড এবং সোমালিল্যান্ডের মতো আঞ্চলিক প্রশাসনগুলোকে সহায়তা এবং উৎসাহিত করেছে, যাদের সোমালিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। মোগাদিশু সোমালিয়ার আকাশপথের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে এবং দেশের অভ্যন্তরে আসা সব বিমানের অনুমোদন দেয়; কিন্তু বসাসো বন্দর ও বিমানবন্দরের ওপর তাদের কোনো কর্তৃত্ব নেই। সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট হাসান শেখ এবং ইউএই’র মোহাম্মদ বিন জায়েদ-এর মধ্যে অস্বস্তিকর সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও মোগাদিশুর সরকার পন্টল্যান্ডে আবুধাবির সামরিক কার্যকলাপ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো বিরোধিতা করেনি।

সেখানকার বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউএই’র ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় প্রস্তুত না থাকায় মোগাদিসু আপত্তি জানাতে অক্ষম। বসাসোতে ইউএই’র কার্যকলাপ গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের আশঙ্কা, এতে সোমালিয়ার আঞ্চলিক শক্তিগুলো বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার শিকার হতে পারে। সুদানের যুদ্ধে ইউএই’র জড়িত থাকার প্রধান চালিকাশক্তি হলো স্বর্ণ আহরণ এবং আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার। পন্টল্যান্ডের ক্ষেত্রে, এর কৌশলগত অবস্থান এবং আপেক্ষিক স্বাধীনতা এটিকে ইউএই’র জন্য একটি আদর্শ অপারেশনাল ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। কারণ, পন্টল্যান্ড বিশ্বের অন্যতম কম জরিপকৃত এবং কম তদারকি করা অঞ্চল হিসাবে রয়ে গেছে। এটি ইউএই’র কাজ চালানোর জন্য যেমন সুবিধাজনক স্থান, তেমনি তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে কেউ কোনো প্রশ্ন করতেও যাচ্ছে না।

* মিডল ইস্ট আই থেকে ভাষান্তরিত

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম