Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

পূর্বাভাসভিত্তিক ধান চাষে বদলে যাবে কৃষি

Icon

নিয়াজ মোহাম্মদ ফারহাত রহমান

প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পূর্বাভাসভিত্তিক ধান চাষে বদলে যাবে কৃষি

ফাইল ছবি

প্রতি মৌসুমেই কৃষক প্রকৃতির কাছে অসহায়। হঠাৎ বৃষ্টিতে ফসলের মাঠ ডুবে যায়, আবার অকাল খরায় মাঠ শুকায়। বছরের পর বছর এ অনিশ্চয়তার মধ্যেই আবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশে কৃষকরা। অথচ তারা যদি দুর্যোগের আগেই জানতেন আগামী সপ্তাহে বৃষ্টি হবে, অথবা বৃষ্টির সময় বিলম্বিত হবে, কিংবা দুই দিনের মধ্যে ঝড় বয়ে যাবে, তাহলে সতর্ক হতে পারতেন। বেঁচে যেত তাদের কষ্টের ফসল, গোয়ালের গবাদি কিংবা পুকুরের মাছ। সময় এসেছে আধুনিক বিজ্ঞানের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দুর্যোগের ঘেরাটোপে থাকা কৃষকদের রক্ষা করার। শুধু সময়োপযোগী ‘আবহাওয়ার পূর্বাভাস’ কৃষকের উৎপাদন বাড়ানোর অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। সময়মতো কৃষকের কাছে পৌঁছাতে পারলে এটি অনিশ্চয়তাকে পরিণত করবে সম্ভাবনায়, কৃষিকে করবে আরও ফলনশীল ও লাভজনক। কৃষিপ্রধান দেশ বাংলাদেশ। কৃষিই আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির চাবিকাঠি। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষি এবং ফসল উপখাতের অবদান প্রায় ১৩.৪৭ ও ৬.৭৭ শতাংশ, যা যৌথভাবে ২০.২৪ শতাংশ। কৃষির মধ্যে ধানই প্রধান ফসল। দেশের মোট ব্যবহৃত খাদ্যের মধ্যে ধানের অবদান ৮০ শতাংশ। এত গুরুত্বপূর্ণ ফসল হওয়া সত্ত্বেও এখনো বেশির ভাগ কৃষক ধান চাষে অভিজ্ঞতালব্ধ পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল। আবহাওয়ার পরিবর্তনের এ অনিয়মিত ধারা কৃষকদের ঐতিহ্যগত অভিজ্ঞতাকে অনেক সময় ব্যর্থ করে দিচ্ছে।

বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (এফএও) জানিয়েছে, প্রতিবছর বৈশ্বিক কৃষি উৎপাদনের প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ ক্ষতি হয় আবহাওয়াজনিত দুর্যোগের কারণে। দক্ষিণ এশিয়ায় এ ক্ষতি মানে কৃষকের ঋণের বোঝা, খাদ্যের দাম বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ দারিদ্র্যচক্রে নতুন মানুষ যুক্ত হওয়া। বাংলাদেশে একটি অকাল বন্যা বা দেরিতে আসা বর্ষা এক মৌসুমের ফসল নষ্ট করে দিতে পারে। ২০১৭ সালে হাওড় অঞ্চলের আগাম বন্যায় কোটি কোটি টাকার বোরো ধান নষ্ট হয়। এ পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানভিত্তিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস বা কৃষি পরামর্শ সেবা প্রযুক্তি ধান উৎপাদনে হয়ে উঠতে পারে কৃষকের নতুন আশ্রয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আবহাওয়াভিত্তিক কৃষি পরামর্শের সফলতার নজির রয়েছে। ভারতের গ্রামীণ কৃষিসেবা এখন লাখ লাখ কৃষকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে এসএমএস, ভয়েস কল, রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদি গণমাধ্যমের মাধ্যমে। তাদের মূল্যায়নে দেখা গেছে, যারা নিয়মিত পূর্বাভাসভিত্তিক পরামর্শ গ্রহণ করেন, তাদের আয় অন্যদের তুলনায় ১০-২৫ শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এগ্রোমেট ল্যাব ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে এ প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে আসছে। ব্রির এগ্রোমেট ল্যাব পরিচালিত গবেষণা ‘Sustaining Agricultural Productivity through Weather Resilient Agricultural Practices’ শীর্ষক প্রবন্ধ হিসাবে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন উইলি প্রকাশনা সংস্থার Journal of the Science of Food and Agriculture-এ ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয়। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষিতে ক্ষয়ক্ষতি ও উৎপাদন ব্যয় ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু আবহাওয়া পূর্বাভাসভিত্তিক কৃষি পরামর্শ সেবা গ্রহণ করলে একদিকে উৎপাদন ব্যয় কমে, অন্যদিকে কৃষকের আয়ও বেড়ে যায়। এ পদ্ধতি ব্যবহার করলে ফলন প্রায় ৭ শতাংশ বেড়ে যায়। উৎপাদন ব্যয় কমে আসে প্রায় ১৩ শতাংশে। এতে সারের ব্যবহার ও সেচের পরিমাণ কমে আসে; সেই সঙ্গে পোকামাকড় ও রোগ-বালাইয়ের ঝুঁকিও কমে, ফলে কীটনাশক-নির্ভরতা হ্রাস পায়। তাছাড়া রাসায়নিক সার ও কীটনাশক কম ব্যবহার হওয়ায় পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতিও কমে যায়।

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, আবহাওয়া পূর্বাভাসভিত্তিক কৃষি পরামর্শ সেবা ব্যবহার করলে ধান চাষে শ্রম, পানি ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমে আসে, আর ফলন ও কৃষকের আয় বেড়ে যায়। ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে প্রতি হেক্টর জমিতে কৃষকদের গড়ে ৮৪০ ঘণ্টা শ্রম দিতে হয়, যেখানে আবহাওয়া পূর্বাভাসভিত্তিক কৃষি পরামর্শ সেবা পদ্ধতিতে প্রয়োজন হয় ৭২০ ঘণ্টা। অর্থাৎ শ্রমঘণ্টা কমে ১২০ ঘণ্টা। একইসঙ্গে সারের ব্যবহার ১৬ শতাংশ, সেচের পানি ২৩ শতাংশ, আগাছানাশক ৫২ শতাংশ, কীটনাশক ৪০ শতাংশ এবং ছত্রাকনাশক ২৬ শতাংশ পর্যন্ত কমে। গবেষণায় অংশ নেওয়া কৃষকরা জানিয়েছেন, আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী সার ও সেচের সময় নির্ধারণ করায় খরচ কমেছে। তাতে করে প্রতি বিঘায় কৃষকের নেট আয় বেড়ে যায় ৩১ শতাংশ। এ প্রযুক্তি ব্যবহার হলে এক হেক্টর জমিতে ২২৯ ডলার (প্রতি ডলার ১২২ টাকা) বা প্রায় ২৮ হাজার টাকা বেশি আয় হয়। তাছাড়া লাভ-খরচ অনুপাত আবহাওয়া পূর্বাভাসভিত্তিক কৃষি পরামর্শ সেবাতে ছিল ২.১৭, যেখানে সনাতন পদ্ধতিতে ছিল ১.৭৫। এ প্রযুক্তি কোনো অতিরিক্ত স্থাপন বা পরিচালনা ব্যয় ছাড়াই কৃষকদের লাভবান করেছে।

পূর্বাভাসভিত্তিক কৃষি পরামর্শ কৃষকদের সময়মতো সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে এবং এর ব্যাপক প্রয়োগ বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও টেকসই কৃষি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাছাড়া বর্তমানে ডেল্টা প্ল্যানের আওতায় দেশের ছয়টি জলবায়ু-সংবেদনশীল হটস্পটে মোট ২৪টি জেলায় পরীক্ষামূলকভাবে এ প্রযুক্তি চালু রয়েছে। সেখানে বৃষ্টি, খরা বা অতিবৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলে কৃষকদের আগেভাগে জানানো হয়, যাতে তারা সঠিক সময়ে সেচ, সার বা কীটনাশক প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

বাংলাদেশে আবহাওয়া অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো এ পদ্ধতির উন্নয়নে এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও গণমাধ্যমের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এ প্রযুক্তির অধিকতর সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এক্ষেত্রে মূল সীমাবদ্ধতাগুলো হলো-অঞ্চলভিত্তিক পূর্বাভাসের অভাব, সহজবোধ্য পূর্বাভাস, তথ্যপ্রবাহে বিলম্ব, আস্থার অভাব এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের ঘাটতি। ফলে বর্তমান ব্যবস্থায় কৃষকরা এখনো সেই পরিমাণ লাভবান হতে পারছেন না, যতটা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এখন দরকার সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ যেমন-প্রথমত, ইউনিয়ন বা উপজেলা পর্যায়ে স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া স্টেশন স্থাপন; স্থানীয় পর্যায়ে তথ্যসংগ্রহ ও পরামর্শ প্রদান; দ্বিতীয়ত, কৃষকের জন্য সহজ ভাষায় ভয়েস কল সার্ভিস ও স্থানীয় প্রচারমাধ্যম ব্যবহার; তৃতীয়ত, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম যেমন-সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ওয়েব বা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে পরামর্শ একত্রে প্রদান। এছাড়া কৃষি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, গণমাধ্যমের সম্পৃক্ততা এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা আরও জোরদার করতে হবে। নীতিগতভাবে বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০, জাতীয় অভিযোজন নীতি ২০২৩ এবং জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এ সেবা বিস্তারের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

কৃষিকে টেকসই, লাভজনক ও জলবায়ু সহনীয় করতে হলে আবহাওয়ার পূর্বাভাসকে কৃষিব্যবস্থার মূল অবকাঠামো হিসাবে দেখতে হবে। এটি এখন কোনো বিলাসিতা নয়, বরং খাদ্য নিরাপত্তার অপরিহার্য শর্ত। নীতি-নির্ধারকদের উচিত এ সেবাকে জাতীয় কৌশল হিসাবে গ্রহণ করা, আর গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি খাতের প্রযুক্তিগত মানোন্নয়ন ও বিস্তারে একসঙ্গে কাজ করা। যদি আমরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রত্যেক কৃষকের হাতে নির্ভরযোগ্য ও সহজ পূর্বাভাস পৌঁছে দিতে পারি, তাহলে বৃষ্টির দিনও হবে পরিকল্পিত, খরার সময়ও হবে নিয়ন্ত্রিত। আবহাওয়ার পূর্বাভাস কেবল আকাশের খবর নয়-এটি আমাদের খাদ্য, জীবিকা ও ভবিষ্যতের নিরাপত্তার প্রতীক।

নিয়াজ মোহাম্মদ ফারহাত রহমান : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন গবেষক), কৃষি পরিসংখ্যান বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)

niaz.sust@gmail.com

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম