বাইফোকাল লেন্স
ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতি
একেএম শামসুদ্দিন
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
১৭ নভেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পতিত শেখ হাসিনাকে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসির রায় ঘোষণা করেছেন। একই রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও ফাঁসির রায় শোনানো হয়েছে। এছাড়া রাজসাক্ষী হিসাবে সাক্ষ্য দেওয়ায় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। রায় ঘোষণার পর দেশে ও বিদেশে এ নিয়ে ব্যাপক পর্যালোচনা চলছে। অনেকে বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন। বাংলাদেশে তো বটেই, ভারতের গণমাধ্যমেও আলোচনার ঝড় চলছে। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী কোনো ক্ষমতাচ্যুত সরকারপ্রধানের বিরুদ্ধে এ ধরনের রায় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে, এটাই স্বাভাবিক। শেখ হাসিনা এবং তার সমর্থকরা এ রায়ে সন্তুষ্ট নন এবং যথারীতি এ রায়কে প্রত্যাখ্যানও করেছেন তারা। তবে হাসিনার বিরুদ্ধে ফাঁসির রায়ে ভারতের সতর্ক প্রতিক্রিয়া আলোচনার খোরাক জুগিয়েছে। কারণ, এ মুহূর্তে হাসিনা তাদের আশ্রয়েই আছেন। অতএব, এ রায়ের পর ভারত কী অবস্থান নেয়, তা জানার কৌতূহল সবারই থাকবে। যদিও রায়ের পর বাংলাদেশের তরফ থেকে হাসিনাকে ফেরত দিতে ভারতের কাছে অনুরোধ গেছে। ভারতের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। এ রায়ের পর হাসিনাকে ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে কিছুটা চাপ বাড়লেও ভারত এ বিষয়ে খুব বেশি গুরুত্ব দেবে বলে মনে হয় না। বিজ্ঞজনদের ধারণা, ভারত কোনো অবস্থাতেই হাসিনাকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করবে না।
হাসিনার বিরুদ্ধে দেওয়া রায়ে সাধারণ মানুষ খুশি হয়েছেন; এমনকি আওয়ামী লীগের অনেক সমর্থকও এ রায়কে মেনে নিয়েছেন। এতদিন শেখ হাসিনা যাদের নিয়ে দল চালিয়েছেন এবং যাদের নিয়ে সরকার গঠন করে যেভাবে রাজত্ব করে গেছেন, তাতে আওয়ামী লীগের সবারই সমর্থন ছিল, তা ঠিক নয়। হাসিনার অনেক কাজেই অনেকে অসন্তুষ্ট ছিলেন। আওয়ামী লীগের এসব ত্যাগী নেতাকর্মীই হাসিনার শাসনামলে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। সে সময়ে শেখ পরিবারসহ দলের অনেকেই বৈষয়িকভাবে প্রচুর লাভবান হলেও এসব নেতাকর্মীর ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তারা বরং লালসার জিহ্বা সংবরণ করে কেবল প্রকৃত আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার চেষ্টা করেছিলেন। ৫ আগস্টের পর হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট মার্কামারা নেতারা বিদেশে পালিয়ে গেলেও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের অনেকেই দেশত্যাগ করেননি। অথচ তারাই এখন সবচেয়ে অস্বস্তিকর অবস্থায় আছেন। হাসিনা দলের প্রকৃত নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করে, যেসব লুটেরাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে দলকে তলানিতে নামিয়ে দিয়ে গেছেন, তাতে হাসিনার বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ থাকাটাই স্বাভাবিক। আজ দলের এ পরিণতির জন্য তারা হাসিনাকেই দায়ী করছেন। পরিচিতদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, এসব কারণেই আওয়ামী লীগের অনেকেই এ রায়কে মেনে নিয়েছেন। তবে রায় মেনে নিলেও যে প্রক্রিয়ায় বিচার হয়েছে, তা নিয়ে তাদের জোরালো আপত্তি আছে।
অবশ্য, বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে ইতোমধ্যে অনেকের গুরুত্বপূর্ণ কিছু পর্যবেক্ষণ ও প্রতিক্রিয়া গণমাধ্যমের বদৌলতে আমরা জেনেছি। একটি হলো, অভিযুক্তদের অনুপস্থিতিতি (যদিও তারা স্বেচ্ছায় পলাতক), অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবীর আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইনে অনভিজ্ঞতা এবং অভিযুক্তদের পক্ষের সাক্ষী না ডাকা। এছাড়া বিচার প্রক্রিয়ায় তাড়াহুড়ো করা বিচারের স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এ ক্ষেত্রে দক্ষ আইনজীবী নিয়োগের মাধ্যমে অপরাধীদের পক্ষে, শক্তিশালী প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার খাতিরেই অপরাধীদের পক্ষে স্বেচ্ছায় যিনি (যতদূর মনে পড়ে অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না) আইনি লড়াই করতে চেয়েছিলেন, তাকে সুযোগ করে দেওয়া যেত। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের যে পরিমাণ শক্ত প্রমাণ আছে, তাতে ওই আইনজীবী খুব বেশি সুবিধা করতে পারতেন বলে মনে হয় না। অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট ও জোরালো প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বিচার প্রক্রিয়ার এরকম কিছু অসংগতির জন্য এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে।
তবে বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠলেই যে হাসিনার বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী অভিযোগ খারিজ হয়ে যাবে, তা নয়। দেশের আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শেখ হাসিনা তার শাসনামলে যে পরিমাণ গুরুতর অপরাধ করেছেন, দেশের কোনো আইনই তাকে রক্ষা করতে পারবে না। তার অপরাধের পাল্লা অনেক ভারি। ক্ষমতার লোভ তার এত প্রবল ছিল, নিজ পরিবার এবং দলীয় স্বার্থ ছাড়া তিনি সবকিছু জলাঞ্জলি দিতেও পিছপা হতেন না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, হাসিনা ছিলেন প্রতিহিংসাপরায়ণ বেপরোয়া একজন স্বৈরশাসক। তার কিছু কিছু কর্মকাণ্ড তাকে হিংস্র মানুষের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করে হত্যার জন্য টেলিফোনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তিনি যেভাবে সরাসরি আদেশ দিয়েছেন, তা শুনলে তার হিংস্রতার পরিচয় পাওয়া যায়। তার সেই নির্দেশনার অডিও রেকর্ড এখনো নেট দুনিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। হাসিনার এ ধরনের কর্মকাণ্ড কেবল বিশ্ব ইতিহাসের কুখ্যাত স্বৈরশাসকদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গেই তুলনা চলে। সাড়ে পনেরো বছরের শাসনামলে হাসিনা তারই অধীন বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে যে রাজনৈতিক গুম ও খুন করিয়েছেন, তা তার হিংস্র স্বভাবের আরও একটি পরিচয় প্রকাশ করে। গুম ও খুন করিয়ে ভিক্টিম পরিবারের সদস্যদের আবার অফিসে ডেকে এনে সহানুভূতি প্রকাশের যে নিখুঁত অভিনয় তিনি করতেন, তা শুধু সাইকোপ্যাথ মানুষের সঙ্গেই তুলনীয়। ভাবলে অবাক লাগে, গুম করে খুন করা হয়েছে জেনেও তিনি কীভাবে একটি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে নির্দ্বিধায় ভিক্টিমকে ফিরিয়ে আনার মিথ্যা আশ্বাস দেওয়ার মতো স্বাভাবিক আচরণ করতেন। মেডিকেল সায়েন্স বলে, সাইকোপ্যাথ হলো এমন একটি ব্যক্তিত্বের ব্যাধি, যার মধ্যে আবেগ, সহানুভূতি ও অনুশোচনার ঘাটতি থাকলেও অন্যদের প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন। এদের ভেতর নিজের স্বার্থে অন্যকে ব্যবহার করার ক্ষমতা থাকে। সাইকোপ্যাথরা সামাজিক হয় এবং কর্মক্ষেত্রেও উজ্জ্বল হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বাস করা হয় সাইকোপ্যাথরা ঠান্ডা মাথার খুনি। তারা তাদের কাজের জন্য অনুতাপ অনুভব করেন না। তারা জেনে-বুঝেই অপকর্ম করে থাকেন। তারা বুদ্ধিমান, অপকর্ম করার পরও তারা স্বাভাবিক ও খুবই আকর্ষণীয় আচরণ করে থাকেন।
শেখ হাসিনা ছিলেন একজন প্রতিশোধপরায়ণ নেত্রী। পঁচাত্তরের আগস্টে তার পিতা-মাতা ও পরিবারের সদস্যদের হত্যার পরপর ঘাতকদের ওপর যে ঘৃণা ও প্রতিশোধের তীব্র স্পৃহা জেগেছিল, তা বহুদিন তুষের আগুনের মতোই তাকে দগ্ধ করেছে। এ হত্যাকাণ্ডের পর শোক প্রকাশ না করায় জনগণের ওপরও তার তীব্র ক্ষোভ ছিল। এ কথা তিনি বিভিন্ন উপলক্ষ্যে প্রকাশও করেছেন। এ ক্ষোভ ও মাত্রাহীন ঘৃণায় তাড়িত হয়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্যই ক্ষমতা লাভের বাসনা তাকে গ্রাস করেছিল। অতঃপর ক্ষমতায় এসে ঘাতকদের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে তিনি তার প্রতিহিংসা মিটিয়েও ছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিবের হত্যার পর শোক প্রকাশ না করার জন্য মানুষের ওপর তার ক্ষোভ ছিল বরাবরই। এ প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলা বিভাগের সাবেক পরিচালক প্রয়াত সিরাজুর রহমান, ২০০২ সালে প্রকাশিত তার লেখা ‘ইতিহাস কথা কয় এবং নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রবন্ধ’ বইয়ের ‘শিকড়’ নামক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন; ১৯৮৩ সালের ১৫ নভেম্বর তিনি যখন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন, তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার সময় শেখ হাসিনা তাকে বলেছিলেন, ‘তার পিতার হত্যার জন্য, তার শোকে অশ্রুর বন্যা বইয়ে না দেওয়ার অকৃতজ্ঞতার জন্য তিনি বাংলাদেশি জাতিকে ক্ষমা করতে পারেন না। তিনি বলেছিলেন, পিতার প্রতিশোধ নিতেই তিনি রাজনীতিতে নেমেছেন।’
শেখ হাসিনার এ প্রবণার প্রতিফলনই ঘটেছে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। ফলে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দলটি। সাধারণ মানুষের ভেতর হাসিনা সম্পর্কে যে হিংস্র ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে, তা কাটতে কতদিন লাগবে বলা মুশকিল। উপরন্তু, এ রায় হাসিনাকে আরও ব্যাকফুটে ফেলে দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ রায়ের পর যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে হাসিনার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ রায়ের রাজনৈতিক তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। শেখ হাসিনার বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা এখন খুবই ক্ষীণ। তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব আঁকড়ে ধরে রাখার যতই চেষ্টা করবেন, দলটির রাজনৈতিক অঙ্গনে ফিরে আসার পথ ততই দীর্ঘায়িত হবে। শুধু সুবিধাভোগী ও হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট অন্ধ অনুসারী ছাড়া আওয়ামী লীগের মঙ্গল চায়, এমন নেতাকর্মীরাও তা-ই মনে করে বলে মনে হয়। শেখ হাসিনা শুধু আইনি আদালতে নয়, জনগণের আদালতেও মানুষ হত্যার হুকুমদাতা হিসাবে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন; আর এমন একজন দাগি আসামিকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলের নেতা হিসাবে জনগণ মেনে নেবে না। অতএব, এসব বিবেচনায় নিয়ে হাসিনার বিকল্প নেতৃত্ব খোঁজার প্রয়োজন আছে কিনা, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের এখন সে চিন্তাই করতে হবে। যতদিন শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে অস্বীকার করবেন, ততদিনই তারা রাজনীতিতে ফেরার পথ তৈরিতে পিছিয়ে পড়বেন।
একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, কলাম লেখক
