সীমান্ত ভূমিতে রক্তলাল নদী বহমান
মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন টিটো
প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সীমান্তের সেই অদৃশ্য রেখা, যা দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের সেতু হওয়ার কথা ছিল, তা কখনো কখনো রক্তাক্ত নদীর মতো বইতে থাকে। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বাংলাদেশ সীমান্তে ঘটমান বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডগুলো শুধু সংখ্যার খেলা নয়, বরং অসংখ্য পরিবারের অশ্রুসিক্ত কাহিনী।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর ৪ ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত এ রক্তপাতের মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক অসমতা, চোরাচালান এবং অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ‘ট্রিগার হ্যাপি’ মানসিকতা। কুলাউড়া উপজেলার সুখিরাম উরাং-এর মতো সাম্প্রতিক হত্যা এ চক্রকে আরও জ্বালাময়ী করে তুলেছে। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে সুখিরাম উরাং (২৫) নামের বাংলাদেশি এক তরুণ নিহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের মুরইছড়া সীমান্তে এ ঘটনা ঘটে। নিহত সুখিরামের বাড়ি কর্মধার মুরইছড়া বস্তি এলাকায়।
স্থানীয় লোকজনের বরাতে কুলাউড়া থানা-পুলিশ জানায়, সুখিরাম বেলা দেড়টার দিকে মুরইছড়া সীমান্তের ১ হাজার ৮৪৪ ও ১ হাজার ৮৪৫ নম্বর মূল সীমান্ত খুঁটি এলাকায় গরু চরাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে বিএসএফ তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এতে তার পিঠে গুলি লাগলে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। খবর পেয়ে পুলিশের একটি দল হাসপাতালে গিয়ে তার লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। এ রক্তের নদীকে শান্তির স্রোতে রূপান্তরিত করতে সত্যিকারের সংলাপ অপরিহার্য।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত প্রায় ৪,০৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ, যা ভারতের পাঁচটি রাজ্য-পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামের সঙ্গে বিস্তৃত। এ সীমান্ত নদী, পাহাড় ও সমতল ভূমির সমন্বয়ে গঠিত একটি জটিল রেখা। মানচিত্রের মাধ্যমে এ সীমান্ত অঞ্চলটি ভালোভাবে বোঝা যায়, যেখানে পশ্চিমবঙ্গ প্রায় ২,২১৭ কিমি. ত্রিপুরা ৮৫৬ কিমি. মিজোরাম ৩১৮ কিমি. মেঘালয় ৪৪৩ কিমি. এবং আসাম ২৬২ কিমি. সীমান্ত ভাগ করে নিয়েছে। এ সীমান্তটি একদিকে যেমন অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের কেন্দ্র, তেমনই কিছু বিতর্কিত এলাকাও রয়েছে, যেমন সাতক্ষীরা জেলার হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনায় অবস্থিত দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ। লালবৃত্ত দ্বারা চিহ্নিত সীমান্তবর্তী জেলাগুলো উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ।
উল্লেখযোগ্য হত্যাকাণ্ডের বছরভিত্তিক তালিকা
২০১১ সালে ফেলানি খাতুন (১৫ বছর কিশোরী), কুড়িগ্রাম সীমান্তে গুলিবিদ্ধ হয়ে দেহ কাঁটাতারে ঝুলে থাকে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। ২০২৪ সালে স্বর্ণা দাস (১৩ বছর), ত্রিপুরায় নিহত, যা আইসিসি-তে মামলার দাবি ডেকেছে। ২০২৫ সালে আব্দুর রহমান (সিলেট, সেপ্টেম্বর), ত্রিপুরায় ৩ জন (অক্টোবর); পাশুরাম সীমান্তে ২ জন (জুলাই); চুয়াডাঙ্গায় কৃষক (জুলাই); মৌলভীবাজার কাসবায় মোহাম্মদ আল-আমিন (ফেব্রুয়ারি); সুখিরাম উরাং (কুলাউড়া, ০৪ ডিসেম্বর) অধিকাংশই অস্ত্রহীন।
সীমান্ত চুক্তি এবং তাদের ব্যর্থতা
১৯৭৫ : যৌথ সীমান্ত নির্দেশিকা, অ-মারাত্মক অস্ত্রের প্রতিশ্রুতি কিন্তু লিথাল ফোর্স অব্যাহত।
২০১১ : কো-অর্ডিনেটেড বর্ডার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান (সিবিএমপি), যৌথ পাহারা এবং ‘জিরো কিলিং’ লক্ষ্য ব্যর্থতা : তথ্য আদান-প্রদান দুর্বল।
২০১৫ : ল্যান্ড বাউন্ডারি অ্যাগ্রিমেন্ট (এলবিএ), এনক্লেভ বিনিময় সীমান্ত সরল হলেও হত্যা অব্যাহত।
২০১৮ : অ-মারাত্মক অস্ত্র চুক্তি, লিথাল ফোর্স কমানোর প্রতিশ্রুতি ব্যর্থতা কোনো বিএসএফ সদস্যকে বিচার করা হয়নি, যা দায়মুক্তি সৃষ্টি করে।
বিএসএফের মারমুখী আচরণ এবং মদ্যপানের ঘটনা, বিএসএফের ‘ট্রিগার হ্যাপি’ মানসিকতা এবং ‘শুট-টু-কিল’ নীতি পিঠে গুলি করে পালানোদের হত্যা করে। মদ্যপান অবস্থায় কর্তব্যের ঘটনা (যেমন-২০২৪-এ লালমনিরহাটে একটি হত্যায়) অতিরিক্ত বলপ্রয়োগকে আরও ভয়াবহ করে। এইচআরডব্লিউয়ের রিপোর্টে বলা হয়েছে, এগুলো এক্সট্রাজুডিশিয়াল কিলিং।
ভারত সরকারের উদাসীনতা এবং চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া, ভারত সরকার এগুলোকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে উড়িয়ে দেয়, কিন্তু তদন্ত করে না। দায়মুক্তি আইন সুরক্ষা দেয়, যা হত্যা অব্যাহত রাখে। চুক্তিগুলোর বাস্তবায়ন দুর্বল, যেমন ২০১৮ চুক্তির পরও হত্যা বেড়েছে।
বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫৬তম সীমান্ত সম্মেলন, ঢাকার যৌথ আলোচনার দলিল স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের ৪ দিনব্যাপী (২৫-২৮ আগস্ট ২০২৫) ৫৬তম সীমান্ত সম্মেলন শেষ হয়।
সম্মেলনের আলোচ্য বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে এ বিষয়গুলোর ওপর উভয়পক্ষ সম্মত হয় : ক. বিজিবি মহাপরিচালক সীমান্তে বিএসএফ ও ভারতীয় নাগরিক কর্তৃক নিরীহ বাংলাদেশি নাগরিকদে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা ও আহতের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। জবাবে বিএসএফ মহাপরিচালক সীমান্তে অতিরিক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় রাতের বেলায় টহল জোরদার করে সীমান্ত হত্যার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে, সে ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি পূনর্ব্যক্ত করেন। উভয় পক্ষ যৌথভাবে সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ, সীমান্তের অলঙ্ঘনীয়তা সম্পর্কে প্রেষণা প্রদান এবং অপরাধীদের আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম প্রতিরোধের মাধ্যমে এ ধরনের আক্রমণ, নির্যাতন ও হামলার ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনার বিষয়ে উভয়পক্ষ সম্মত হয়।
খ. বিজিবি মহাপরিচালক বিএসএফ কর্তৃক অবৈধভাবে বিভিন্ন ব্যক্তি, ভারতীয় নাগরিক ও বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিক (FDMN) বাংলাদেশে পুশইনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণের আহ্বান জানান। বিএসএফ মহাপরিচালক ভারতে অবৈধভাবে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকদেরকে পারস্পরিকভাবে সম্মত প্রক্রিয়া অনুযায়ী ফেরত পাঠানোর আশ্বাস দেন।
গ. সীমান্ত দিয়ে মাদক, অস্ত্র-গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক দ্রব্য, স্বর্ণ, জাল মুদ্রা নোট এবং অন্য চোরাচালান প্রতিরোধে ‘সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার’ গুরুত্ব তুলে ধরে উভয় পক্ষ পাচার ও পাচারকারীদের রিয়েল-টাইম তথ্য শেয়ার এবং অধিক সতর্কতার মাধ্যমে এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে সতর্ক ও দৃঢ় থাকার বিষয়ে একমত হয়।
ঘ. উভয় পক্ষ সীমান্তবর্তী জনগণকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে অবৈধ অনুপ্রবেশ, চোরাচালান, মানব পাচার, সীমান্ত স্তম্ভ উপড়ে ফেলা ও অন্য আন্তঃসীমান্ত অপরাধ থেকে বিরত রাখার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে একমত হয়। সার্বিকভাবে উভয় পক্ষ সীমান্তের অলঙ্ঘনীয়তা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে।
সম্মেলন, কাগজের চুক্তি, দলিল স্বাক্ষর সবকিছু হলেও বিএসএফ তার পূর্বের রূপে ফিরে গিয়েছে। কোনোকিছুই তাদের মানুষ হত্যা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। বিএসএফ পূর্বের ন্যায় আবারও সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশিদের গুলি করে হত্যা করছে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমাধান, আইসিজে, জাতিসংঘ, ফোরামের মাধ্যমে,বাংলাদেশ আইসিজে (আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত) মামলা দায়ের করতে পারে, যেমন-ফেলানির ক্ষেত্রে দাবি উঠেছে। জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলে অভিযোগ দায়ের করে স্বাধীন তদন্ত দাবি করা যায়, ২০০+ নাগরিক ২০২৪-এ এমন আহ্বান করেছে। এইচআরডব্লিউ এবং অ্যামনেস্টির মতো সংস্থার সঙ্গে যৌথ প্রচারণা চালিয়ে চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব। এটি ভারতের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াবে এবং তদন্ত নিশ্চিত করবে। বাংলাদেশ এ রক্তপাত থেকে মুক্তি পেতে ডিপ্লোম্যাটিক চাপ, জনপ্রতিবাদ এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে অভিযোগ দায়ের করতে পারে। সরকার প্রতিবাদ নোট পাঠাতে পারে, যেমন ২০২৫-এ ত্রিপুরা হত্যায় করা হয়েছে। জনগণ ক্যাম্পেইন চালাতে পারে, এবং বিজিবি যৌথ পাহারা শক্তিশালী করতে পারে। আইসিজে মামলা এবং জাতিসংঘে তদন্ত দাবি করে চাপ বাড়ানো যায়।
এ রক্তলাল নদীকে শান্তির স্রোতে রূপান্তরিত করতে বাংলাদেশের সাহসী কূটনীতি এবং জনগণের ঐক্য প্রয়োজন। সুখিরামের মতো নিরপরাধ প্রাণ আর না যাক, এটি আমাদের যৌথ দায়িত্ব।
মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন টিটো : অনুসন্ধানী সাংবাদিক
