Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শিক্ষা না নিলে আরেকটি পিলখানা ঘটতে পারে

Icon

আবু রূশদ

প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষা না নিলে আরেকটি পিলখানা ঘটতে পারে

২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পিলখানায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তা মর্মান্তিকভাবে নিহত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে অবসরপ্রাপ্ত সশস্ত্রবাহিনী অফিসারদের সংগঠন রাওয়া কর্তৃপক্ষ শহীদ কর্মকর্তাদের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের বিশেষ সদস্যপদ প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। দ্রুত ওইসব সদস্যপদ প্রদান করে তিন বাহিনী প্রধানকে দাওয়াত দিয়ে এক অনুষ্ঠান আয়োজনেরও ব্যবস্থা করা হয়। তখন রাওয়া ইসি কমিটির সদস্য মরহুম মেজর ইয়াসিন মোল্লা এজন্য আমার সহায়তা কামনা করেন। যেহেতু শহীদ কর্মকর্তাদের নিয়ে আমার সম্পাদিত বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নালে ইতোমধ্যেই দুটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে, সেজন্য সব শহীদের পরিবারের নাম ও যোগাযোগের মোবাইল বা ল্যান্ড ফোন নম্বর আমার কাছে ছিল। তাই রাওয়া কর্তৃপক্ষ আমাকেই ওই দায়িত্বটি দেয়।

২০০৯ সালের মার্চ সংখ্যাকে বিশেষ বিডিআর সংখ্যা হিসাবে প্রকাশের জন্য আমি সেনা সদরদপ্তরের সহযোগিতা চেয়েছিলাম। সব শহীদ কর্মকর্তার ছবি, শর্ট বায়োডাটাসহ পরিবারের যোগাযোগের ডিটেইলস জোগাড় করা সে সময় সহজ কাজ ছিল না। আমি পুরোদস্তুর আমার জার্নালের প্যাডে চিঠি লিখে সেনা সদরদপ্তরের অনুমোদন গ্রহণ করি এবং সামরিক গোয়েন্দা পরিদপ্তর তার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র প্রদান করে। এরপর সব শহীদ কর্মকর্তার পরিবারবর্গের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের পারিবারিক দুর্লভ ছবি শুধু নয়, হৃদয়ছোঁয়া অনেক পারিবারিক কাহিনিও সংগ্রহ করা হয়।

প্রথম বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের পর বিভিন্ন কর্মকর্তার স্মৃতিচারণমূলক লেখা দিয়ে পরের মাসে আরেকটি বিশেষ সংখ্যা বের করি। সেনা সদরদপ্তর থেকে এম আই ক্লিয়ারেন্স নিয়ে কয়েকজন চাকরিরত কর্মকর্তাও তাতে লেখা পাঠান।

বিস্ময়ের ব্যাপার যে, আমি ও আমার জার্নালের সাংবাদিকরা যখন সেনাবাহিনীর প্রদত্ত ডকুমেন্ট অনুযায়ী শহীদদের পরিবারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলছিলাম, তখন কে বা কারা ডিজিএফআইতে রিপোর্ট করে বসেন যে, আমি নাকি শহীদ পরিবারের সদস্যদের একজোট করে সরকারের বিরুদ্ধে ‘উসকানি’ প্রদান করছি! আমি যখন ওই তথ্য জানতে পারি, তখন চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে আসে, অপরদিকে ভয়ানক ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ি। সেনা গোয়েন্দা পরিচালককে ওই কথা জানালে তিনি ডিজিএফআইতে কথা বলবেন বলে জানান। কিন্তু কে শোনে কার কথা? সেনা সদরদপ্তরের লিখিত অনুমোদনসাপেক্ষে যখন স্মৃতিচারণমূলক সংখ্যা বের করছি, তখন ওই ধরনের গোয়েন্দা রিপোর্টের কথা শুনলে কেমন লাগে? জানিনা তদানীন্তন ডিজিএফআই প্রধান লে. জে. মোল্লা ফজলে আকবর আমার ফাইলে কী নথিভুক্ত করেছিলেন? তবে কয়েকটি সূত্রে জানতে পারি, তিনি নিতান্তই রাজনৈতিক ক্যাডারের মতো আচরণ করছিলেন সেসময়। তার অধীনস্থ কর্মকর্তা যারা তদন্তের কাজে জড়িত ছিলেন তাদের সোজা বলে দেওয়া হয়, তদন্তে যাতে আওয়ামী লীগের কারও নাম না আসে। কয়েকজন অফিসার প্রতিবাদ করলে তাদের শেষমেশ বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়ে দেন জে. মোল্লা আকবর।

যাহোক, রাওয়া কর্তৃপক্ষ সহায়তা চাইলে আমি মেজর ইয়াসিনকে সব কথা খুলে বলি। তিনি রাগান্বিত হয়ে বলেন, আমরা কি গোপনে কিছু করছি? তিন বাহিনী প্রধান স্বয়ং উপস্থিত হয়ে বিশেষ সদস্যপদ প্রদান করবেন বলে কথা দিয়েছেন, এখানে সমস্যা কোথায়? আমি বললাম, স্যার, ডিজিএফআই’কে গিয়ে তা বোঝান। ওরা মোবাইল ফোন মনিটর করে দেখে যে আমরা শহীদ পরিবারের সঙ্গে কথা বলছি। এরপর কর্তারা সেটাকে যা খুশি বানিয়ে দেয়! এ অবস্থায় রাওয়ার ভাইস চেয়ারম্যান কর্নেল শাহজাহান মোল্লাও আমার সঙ্গে কথা বলেন ও জানান, তিনিসহ রাওয়া ইসি অফিশিয়ালি আমাকে দায়িত্ব দিচ্ছেন। তাই ভয়ের

কিছু নেই।

আমরা কাজ শুরু করলাম। মেজর ইয়াসিন এসে আমার অফিসে বসতেন। আমি ও আমার কোর্সমেট অবসরপ্রাপ্ত মেজর খলিল বিন ওয়াহিদ একের পর এক ফোন করছি এবং শহীদ পরিবারের ঠিকানাসহ বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে তা নোটবুকে লিপিবদ্ধ করছি। আমার পুরো অফিস তখন সব কাজ বাদ দিয়ে এই মহতী উদ্যোগে মনোনিবেশ করে। স্পষ্ট মনে আছে, মাত্র চার দিনে আমরা সব তথ্য সংগ্রহ করে তা মেজর ইয়াসিনকে হস্তান্তর করি।

এরপর সদস্যপদ প্রদান অনুষ্ঠানে আমাকে ও ওয়াহিদকে বিশেষভাবে দাওয়াত দেয় রাওয়া কর্তৃপক্ষ। ওই অনুষ্ঠানে নির্দিষ্ট অতিথি ছাড়া কোনো রাওয়া সদস্যকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি। আমি যখন অনুষ্ঠানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তখন সূত্র মারফত জানতে পারলাম যে, আমার বিরুদ্ধে আবারও ‘উসকানি’ দেওয়ার অভিযোগ করা হচ্ছে! মেজাজ গেল খিচড়ে। মেজর ইয়াসিন ও কর্নেল শাহজাহান মোল্লাকে জানিয়ে দিলাম যে আমি যাব না। যাইওনি। অথচ আমার তৈরি করা তালিকা দিয়ে শহীদ পরিবারের সদস্যদের বিশেষ সদস্যপদ প্রদান করেন তিন বাহিনী প্রধান! আর অন্যদিকে ডিজিএফআই তৈরি করে আমার বিরুদ্ধে রিপোর্ট! এই হচ্ছে অবস্থা। সেই কথিত ‘উসকানি’ প্রদান তত্ত্বের পরিণতিতে পরে বহু ঝামেলা ভোগ করতে হয়েছে। আমাদের চমৎকার একটি গোয়েন্দা সংস্থা এভাবেই একটি ধামাধরা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল বিগত সরকারের আমলে, যারা নিজ কমরেডদের বাঁচাতে ব্যর্থ হলেও রাজনৈতিক প্রভুদের রক্ষায় ছিল ভৌতিকভাবে তৎপর।

এদিকে ২০০৯ সালে ডিফেন্স জার্নালের দুটি বিশেষ সংখ্যা বের করার পর ২০১৪ সালে আরও একটি বিশেষ সংখ্যা বের করি বিডিআর শহীদদের স্মরণে। ওই সংখ্যাটি বের করার পরও আমি হেনস্তার শিকার হই। সেনা সদরদপ্তরে কয়েকটি সৌজন্য সংখ্যা পাঠালে তদানীন্তন কর্তৃপক্ষ তা ফেরত পাঠায়। এই ছিল সেই আমলে বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রশাসনের অবস্থান।

দীর্ঘদিন পর বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিশন কোনো ধরনের চাপ বা প্রভাবের বাইরে থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রদান করেছে। এতে সবচেয়ে যে বিষয়টি একাধারে গুরুত্বপূর্ণ ও লজ্জার তা হলো, সে সময় বিভিন্ন পদে আসীন সেনা এবং পুলিশ কর্তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ কারবার বের হয়ে আসা। সেনাবাহিনীর সব সদস্য গত ষোলো বছর ধরে অনেক কিছু জানার পরও বাধ্য হয়ে চুপ থেকেছেন, কয়েকজন কথা বলে চাকরিচ্যুত হয়েছেন, আবার কেউ কেউ সেনা কর্মকর্তা কারাগারে পর্যন্ত গিয়েছেন। পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের ষণ্ডামি পাণ্ডামির মুখে নীরব দর্শক হওয়া ছাড়া হয়তো উপায়ও ছিল না।

আবার দেশের তদানীন্তন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ পিলখানায় অফিসারদের রক্ষার জন্য সেনাবাহিনী অ্যাকশন নিলে ভারত সামরিক আগ্রাসন চালাত বলে তার জবানীতে জানিয়েছেন কমিশনকে। কমিশন আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানিয়েছে, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করা হয়েছে এক বছর ধরে, যাতে দেশীয় একটি রাজনৈতিক দল ও প্রতিবেশী দেশ জড়িত ছিল। অর্থাৎ ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ষড়যন্ত্রকারীরা ভিনদেশের সহায়তায় নাকের ডগায় বসে আমাদের সেনা অফিসার হত্যার ছক এঁটেছে নির্বিঘ্নে।

অনেক কিছুই এখন বেরিয়ে আসছে, যা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল বিগত আমলে। আর ধামাচাপা দেওয়ায়ও লীগ-বিরোধী বিভিন্ন ষড়যন্ত্র আবিষ্কারে কিন্তু অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন শহীদ অফিসারদেরই একসময়ের সহকর্মীরা।

প্রশ্ন হলো, কেন আমাদের কতিপয় সেনা কর্মকর্তা নিজ কমরেডদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে এমন নির্লজ্জ বেহায়াপনা করেছেন বিগত শাসনামলে? কেন দেশের সব পর্যায়ে নাক গলানোয় পারদর্শী ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের মতো গোয়েন্দা সংস্থা এমন একটি পরিকল্পনার কথা জানতে পারল না, যা খোদ রাজধানীতেই জমাট বাঁধছিল এক বছর ধরে?

এই যে বিডিআর হত্যাকাণ্ড ও সেনাপ্রধানের ভারতীয় জুজুর ভয় দেখানো-এসব কিন্তু একদিনে শুরু হয়নি। ২০০৭ সালে চারদিকে আটঘাট বেঁধে ওয়ান-ইলেভেন সংঘটিত করা হয়। তখন জেনারেল মইন ইউ-সহ লে. জেনারেল মাসুদ উদ্দিন গং এমন একটি ধারণা দিতে থাকেন যে, তারা খোলাফায়ে রাশেদিনদের মতো সৎ একটি সমাজ গঠনে নিবেদিত হয়েছেন। মিডিয়াও নেমে পড়েছিল সেই কোরাসে। চারদিকে তখন ধন্য ধন্য রব।

আসলে দেশকে পুরো বিরাজনীতিকরণের পথে পরিচালিত করে মইন ইউ গং। রাজনীতি মানেই খারাপ-এই তত্ত্ব হুজুগে বিশ্বাসী মানুষকে গেলাতে সব মিডিয়াকে ব্যবহার করা হয়। সুশীল শ্রেণির প্রচারণা চলতে থাকে অব্যাহতভাবে। বিশেষ করে একই গ্রুপের একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি দৈনিক ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সব দেশবিরোধী উদ্যোগকে চোখ বুজে সমর্থন জানায়।

আমরা সে সময়কার পরিস্থিতি নিয়ে মোটামুটি যা বলতে পারি তা হলো :

জেনারেল মইন ইউ গং তখন সামরিক কায়দায় দেশ চালাচ্ছেন। ওয়ান-ইলেভেন হওয়ার পর প্রথম দিকেই তিনি নিজেকে ফোর স্টার জেনারেলে উন্নীত করেছেন। ডিজিএফআই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে চারদিকে। যাকে তাকে দুর্নীতির তকমা লাগিয়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, নির্যাতন করছে। দুটি বিশেষ পত্রিকায় প্রতিদিন ঢাউস সব রিপোর্ট বের হচ্ছে। সুশীলদের সে কী উন্মাদনা! দেশে দুধের নহর বইছে! এমন একটা ভাব যে, দেশ ঠিক রেললাইনে উঠে যাচ্ছে সহসাই! খুলনার কোনো এক প্রত্যন্ত উপজেলার কোনো নারী সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার এক হাজার টাকা ঘুস খেয়েছেন তো তাকে হাতকড়া পরিয়ে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে! সেই ছবি দৈনিকে ছাপা হয়েছে বড় করে! আহা! কত দুর্নীতিই না দমন করছে মইন ইউ!

ডিজিএফআই, এনএসআইসহ সব গোয়েন্দা সংস্থা রাতদিন তৎপর, অতি তৎপর হয়ে ওঠে। এদের কর্মকর্তাদের বুকের সিনা বেড়ে শার্টের বোতাম ছিঁড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। তাদের আর কোনো কাজ নেই! ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের ধর। এদের ধরে নিয়ে আসা হচ্ছে, উদ্ধার হচ্ছে কোটি কোটি টাকা! কোনো লোক হ্যারিয়ার গাড়ি ঢাকার রাস্তায় ফেলে গেছে। সেটি উদ্ধার করে সেই কী উল্লাস! বিলাসি গাড়ি পাওয়া গেছে! এসব চলবে না দেশে! সবাই ভারতের তৈরি মারুতির মতো ছোট গাড়িতে চড়বে!

এদিকে যেসব মিডিয়া একটু এদিক-ওদিক রিপোর্ট করছে তাদের চৌদ্দ গোষ্ঠী ডেকে নিয়ে আসা হচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থায়। এভাবে শফিক রেহমান বাধ্য হলেন তার সম্পাদকের পদ ছেড়ে দিতে, আমানুল্লাহ কবিরের সম্পাদনায় চলা আমার দেশ পুড়ে গেল। সেই কী উচ্ছ্বাস! মিডিয়াকে ‘নিরপেক্ষ’ বানানো হচ্ছে, সিকিউরিটি শেখানো হচ্ছে! শুধু ধামাধরা সুশীল সাবেক কমিউনিস্ট দুই সম্পাদকের দুই দৈনিক ঠিক আছে! উঠতি মধ্যবিত্ত আবার এদের খুব ভক্ত। চোখ ঢুলুঢুলু করে এ দুটি পত্রিকা পড়ছে আর রাজনীতির মা-বাপ উদ্ধার করে ঢেঁকুর তুলছে।

এসব করেও শান্তি নেই! মইন ইউ, এটিএম আমিন, মাসুদ উদ্দিন চক্র গুরুতর সব অপরাধ দমনে নেমে গেছে মালকোচা মেরে। চারদিকে বাঘে, মোষে পানি খাচ্ছে একসঙ্গে। সেই কী জোশ! চারদিকে পপুলিজমের জয়জয়কার।

এর মাঝে মইন ইউ গেলেন ভারতে। নিয়ে এলেন দৃষ্টিনন্দন ঘোড়া!

ডিজিএফআইয়ের কাউন্টার টেররিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এটিএম আমিন, যার কাজ ছিল সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তৎপরতার দিকে নজর রাখা, তিনি ছুটলেন প্রতিবেশী দেশের ধেড়ে বাবুদের খুশি করতে। কিভাবে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনা যায়, তার আঞ্জাম দিতে! কথিত আছে, রাতের আঁধারে ডিজিএফআইয়ের কোনো একটি গোপন সেফ হাউজে অতি গোপনে শেখ হাসিনাকে নিয়ে আসা হয় চুক্তি ফাইনাল করতে। সেখানে মইন ইউ হাজির হন এবং হাসিনার পা ধরে কদমবুছি করেন।

এখন জেনারেল ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন বলছে, সেই লীগই নাকি অফিসার হত্যায় জড়িত রাজনৈতিক শক্তি। প্রতিবেশী দেশও তাতে জড়িত। কিন্তু ২০০৮ সালে অফিসার হত্যার ষড়যন্ত্র শুরু হলেও সিভিলিয়ান রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী দমনে ব্যস্ত বাঘা সব গোয়েন্দা সংস্থা এসবের ন্যূনতম আঁচ করতে পারেনি।

আঁচ পাবে কিভাবে? তখন তো মইন ইউর সেই বাঘা অফিসাররা ব্যস্ত, মহাব্যস্ত! বাপরে বাপ! দেশ ঠিক করা প্রকল্প তখন প্রবল বিক্রমে চলমান যে! ভিনদেশি গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা ও তাদের প্রাণের প্রিয় লীগের চক্রান্ত দেখার সময় কোথায় তাদের?

এই যে চতুর্দিকে গোয়েন্দা সংস্থা, হাইপার গোয়েন্দা কর্তাদের এত বাহারি লাফঝাঁপ সেখানে লোকজন দিব্যি নাকের ডগায় বসে পরিকল্পনা করল একটি বাহিনী খেয়ে দেওয়ার? জাহাবাজ সব গোয়েন্দা বাঘেরা কিছুই জানল না!

একদিনে তো আর এমন জটিল পরিকল্পনা করা যায় না। অনেক কিছুই দরকার হয়। অনেক যোগাযোগ প্রয়োজন হয়। কোনো আভাসই পায়নি মইন ইউ অ্যান্ড গং! কেউ টিকিটিরও সন্ধান পায়নি!

পাবে কিভাবে?

সব যে ব্যস্ত এক হাজার টাকার চোর ধরতে, তারেক জিয়াকে হেনস্তা করতে, রাজনীতিশূন্য করে বিরাজনীতিকরণের ভেলা ভাসাতে! সময় কোথায় জাতীয় নিরাপত্তাকে যেখান থেকে আঘাত করা হতে পারে সেদিকে খোঁজ নেওয়ার?

যদি বলি ওয়ান-ইলেভেনে ইন্ধন দিয়ে, তা দিয়ে ওই ষড়যন্ত্রকারী দেশি-বিদেশি শক্তিই সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যস্ত রেখেছিল অযথা সব পেটি ইস্যুতে? আর সেখানে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন জেনারেল মইন ও তার দোসররা? এটা বলা কি ভুল হবে? তারা যদি নাও জানতেন সেটাও তো তাদের অযোগ্যতার প্রমাণ।

যদি বলি পপুলিস্ট সব ইস্যু তৈরি করে, চিহ্নিত মিডিয়া দিয়ে অপপ্রচার করে সাধারণ মানুষ তো বটেই শিক্ষিত মানুষের মাথা নষ্ট করে দিয়েছিল ওই পরিকল্পনাকারীরাই? যাতে সবাইকে ব্যস্ত রেখে আরামসে পরিকল্পনা করতে পারে। করেছেও তো তাই! বীর বাহাদুর ওয়ান-ইলেভেন সরকার পরিচয় দিয়েছে চরম অদক্ষতার।

আবার দায় এড়াতে পারবে না শিক্ষিত মানুষের একটি বড় অংশ যারা সুশীল হওয়ার জন্য পাগলের মতো আচরণ করে, অদ্ভুত সব বিষয় নিয়ে সবার মাথা খারাপ করে দিয়েছিল সেই সময়টাতে। তাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল বিরাজনীতিকরণ, দেশের নিরাপত্তার প্রতি হুমকির সূত্রগুলো ছিল উপেক্ষিত।

দায় এড়াতে পারবে না দেশের নিরাপত্তার জন্য কুরআন নিয়ে শপথ নেওয়া নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্তা বাবুরা।

দোষ দিব না বিদেশি ওই শক্তিকে, দোষ খুঁজব না কোনো রাজনৈতিক দলের চক্রান্তকারীদের। দোষ দিব ওই মইন ইউ গংয়ের, যারা উজবুকের মতো দেশটাকে নিয়ে খেলেছেন মনের মাধুরী মিশিয়ে। দোষ তাদেরই। কারণ এদেশের মানুষ তাদের ওপর নির্ভর করেছিল জাতীয় নিরাপত্তার জন্য, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য।

এ কারণেই তদন্তে যাদের নাম এসেছে, তাদের পাশাপাশি ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় যেসব অফিসার অযথা কাজে নিয়োজিত থেকে দায়িত্ব অবহেলা করেছেন বা তাদের যারা হুকুম দিয়ে তা করতে বাধ্য করেছেন, তাদেরও আইনের আওতায় আনা দরকার। বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার ইতিহাসে এতবড় অঘটন যেহেতু আগে কখনো ঘটেনি, তাই সে সময়কার কর্তারা দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। বাংলাদেশের আপামর মানুষকেও এটা খেয়াল রাখতে হবে, হুজুগে মেতে ওঠা মানেই দেশ ঠিক করা নয়। বরং তা সামগ্রিক নিরাপত্তায় বিশাল ছিদ্রও তৈরি করতে পারে।

এখন যদি আমরা তদন্ত কমিশনে দেওয়া জেনারেল মইন ইউ আহমেদের আরেকটি বক্তব্য বিবেচনায় নেই তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে তাদের ছেলেখেলা বা পুতুল নাচের ইতিকথার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাই। জে. মইন ইউ বলেছেন, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সময় যদি পিলখানায় সেনাবাহিনী অভিযান চালাত, তাহলে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করত।

ভাবা যায়, একটি দেশের চার তারকা এক জেনারেল বলছেন, তার বাহিনীর কর্মকর্তাদের রক্ষা করতে গেলে প্রতিবেশী দেশ সৈন্য নিয়ে ঢুকে পড়বে? এবং তিনি সেনাবাহিনীকে ওইজন্য অফিসারদের রক্ষায় এগিয়ে যেতে দেননি! কারণ, তিনি চার তারকা কাঁধে ঝুলালেও নিজ বাহিনীর সদস্যদের জন্যও কোনো রিস্ক নিতে চাননি! সোজা কথায় তিনি যুদ্ধ করবেন না। দেশের মানুষকে নিয়ে যাচ্ছে তাই করবেন, রাজনীতি নষ্ট করবেন, ভারতের হাতে দেশ তুলে দিবেন, তাও তার কাঁধে চার তারকা থাকতেই হবে!

দেশের সেনাবাহিনীর কাজই তো আগ্রাসন মোকাবিলা করা। কম শক্তি আছে না কম সৈন্য আছে সেটা তো বিবেচ্য নয়। মানসম্মান, দেশের মর্যাদা, সৈনিকের ডিগনিটি তো সবার উপরে। ধরে নিলাম ভারত তখন সৈন্য নিয়ে ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশে। তাতে কী হতো? আমাদের সৈনিকরা, অফিসাররা জীবনপণ যুদ্ধ করত। আমাদের সাধারণ মানুষ পাশে দাঁড়াত। আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশগুলো এগিয়ে আসত। কারণ, আমরা আক্রান্ত হয়েছি। তারপরও যদি আমরা পরাজিত হতাম, হতাম। টিপু সুলতান, রাজা দাহির পরাজিত হয়েছিলেন। তাতে কী? ইতিহাসে তাদের নাম লেখা আছে বীরের কাতারে, সম্মানের সঙ্গে। মইন ইউর নাম লেখা থাকবে কোথায়? বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পটভূমি তৈরিতে সহায়তা, হত্যাকাণ্ডে অফিসারদের ভীতু কাপুরুষের মতো উদ্ধার করতে না পারায় সবার আগে বিচার হওয়া দরকার এ সেনাপতির। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গৌরবকে

হেয় করেছেন।

২০০৯ সালের বিডিআর হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের জন্য যেন আগামীর বড় উদাহরণ হয়ে থাকে। কিভাবে সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাকে ভুল পথে পরিচালিত করে ও ব্যস্ত রেখে ভয়াবহ দেশবিরোধী চক্রান্তের পরিকল্পনা করা যায় তার জ্যান্ত প্রমাণ এ ঘটনা। সশস্ত্র বাহিনীকে তার নিজ কাজ বাদ দিয়ে যদি কেউ ভিন্ন কিছুতে নিয়োজিত করতে চান বা উসকানি দেন তাহলে ধরে নিতে হবে ডাল মে কুচ কালা হ্যায়। সশস্ত্র বাহিনীকে তাদের পেশা নিয়ে থাকতে দিন। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে জাতীয় নিরাপত্তা, বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৎপরতা নিয়ে তৎপর থাকতে দিন। তাদের কাজ দেশের রাজনীতি ঠিক করা নয়। রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের হাতে ছেড়ে দিন। হাজারও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও রাজনীতি দিয়ে দেশ শাসিত হোক। কোনো অ্যাডভেঞ্চার আবারও যে আরেকটি পিলখানা ডেকে আনবে না, তার নিশ্চয়তা কী?

আবু রূশদ : সাবেক সেনা কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নালের প্রধান সম্পাদক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম