দেশবাসীর মানবাধিকার সুনিশ্চিত হোক
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রতিবছরের মতো এ বছরও বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালিত হচ্ছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে : ‘Our Everyday Essentials’। প্রতিবছর বাংলাদেশে মানবাধিকার দিবস পালিত হলেও দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হচ্ছে না। বরং এখানে মানবাধিকারের চিত্র ভয়াবহ; যার প্রমাণ পাওয়া যায় মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ৪০ জন; আইনি হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর শিকার হয়েছেন ২৮ জন; মব ভায়োলেন্সের শিকার হয়ে মারা গেছেন ১৬৫ জন। প্রতিবেদনেগুলোয় ২০২৪-এর আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রায় ৮ হাজার রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে; যেসব ঘটনায় মারা গেছেন ২৮১ জন। অধিকারের পরিসংখ্যানে ২০০৯ থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার উচ্চ প্রবণতা প্রকাশ পেয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ১৪ হাজার ৮৩টি ধর্ষণের ঘটনা এবং ৪ হাজার ৪৮৯টি যৌতুক-সম্পর্কিত সহিংসতার ঘটনা। আর সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, সাংবাদিকরা উল্লেখযোগ্যভাবে হয়রানির সম্মুখীন হয়েছেন। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৩৫১টি ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে, যার মধ্যে ১০৯টি শারীরিক আক্রমণের ঘটনা রয়েছে। গত বছর অধিকারের অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ২০০৯-২০২৩ সাল পর্যন্ত শাসনামলে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ২ হাজার ৬৯৯ জন, গুম হন ৬৭৭ জন, কারাগারে মারা যান ১ হাজার ৪৮ জন। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের তালিকাসহ ২০২৪ সালের ঘটনা যুক্ত করলে নিহতের সংখ্যা হবে ৩ হাজার। অধিকারের পরিসংখ্যান বলছে, আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার বছর ২০০৯ সালে হত্যার শিকার হন ১৫৪ জন। এছাড়া ২০১০ সালে ১২৭, ২০১১ সালে ৮৪, ২০১২ সালে ৭০ জনকে হত্যা করা হয়। নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩২৯-এ। আর নির্বাচনের বছর ২০১৪ সালে ১৭২, ২০১৫ সালে ১৮৬, ২০১৬ সালে ১৭৮, ২০১৭ সালে ১৫৫ জনকে হত্যা করা হয়। ২০১৮ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর বিচারবহির্ভূত হত্যা করা হয় ৪৬৬ জনকে। ২০১৯ সালে ৩৯১, ২০২০ সালে ২২৫ জনকে হত্যা করা হয়। ২০২১ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারির পর তা কমে ১০৭ জন, ২০২২ সালে ৩১ এবং ২০২৩ সালে ২৪ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন।
শুধু অধিকারের প্রতিবেদনই নয়, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিভিন্ন সময়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। বলা বাহুল্য, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যতম ঘৃণিত ও জঘন্য ঘটনাগুলোর অন্যতম ছিল ‘আয়নাঘর’। ‘আয়নাঘর’ বলতে সাধারণ অর্থে আয়না নির্মিত ঘর মনে হলেও মূলত আয়নাঘর হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের গোয়েন্দা সংস্থা ডাইরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই) এবং কাউন্টার টেরোরিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) দ্বারা পরিচালিত গোপন আটককেন্দ্র, এক গোপন বন্দিশালা। ‘সরকারবিরোধী চক্রান্তে জড়িত’ রয়েছে-এমন সন্দেহভাজনদের আয়নাঘরে আটক রাখা হতো, যা আইন ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
বাংলাদেশে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সরকারি বাহিনীর হাতে গুম, বিনা বিচারে আটক, নির্বিচারে অবৈধভাবে আটক, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও নির্যাতন, খুন, সন্ত্রাস, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ইত্যাদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো থেমে থাকেনি কোনো সরকারের আমলেই। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ এসব ঘটনার জন্য জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার রক্ষাকারী সংস্থা যেমন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকারকে নিন্দা প্রস্তাব জানালেও তাতে তার সরকার মোটেও কর্ণপাত করেননি। অথচ বিনা বিচারে কাউকে আটক বা বন্দি রাখা বা গুম করা সম্পূর্ণরূপে বেআইনি এবং একই সঙ্গে তা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনসহ মানবতা ও মানবাধিকারের পরিপন্থি। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এটিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন, বিশেষ করে মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন বলে বিবেচনা করে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদে গ্রেফতার ও আটক থেকে রক্ষাকবচ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘গ্রেফতারকৃত কোনো ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেফতারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাহার দ্বারা আত্মপক্ষ-সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না।’ সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়েছে, ‘গ্রেফতারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে গ্রেফতারের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে (গ্রেফতারের স্থান হইতে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আনয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ব্যতিরেকে) হাজির করা হইবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাহাকে তদতিরিক্তকাল প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না।’ সংবিধান ছাড়াও জাতিসংঘ ঘোষিত মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র, ১৯৪৮-এর ৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কাউকে নির্যাতন করা যাবে না; কিংবা কারও প্রতি নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ করা যাবে না অথবা কাউকে এহেন শাস্তি দেওয়া যাবে না।’ মানবাধিকারের সর্বজনীন ওই ঘোষণাপত্রের ৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘কাউকেই খেয়ালখুশিমতো গ্রেফতার বা অন্তরীণ করা কিংবা নির্বাসন দেওয়া যাইবে না।’ দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে এবং জাতিসংঘের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে বিনা বিচারে আটক, গ্রেফতার সম্পর্কে উপরিউক্ত বিষয় বলা হলেও বিগত শেখ হাসিনার সরকার কিংবা বাংলাদেশের কোনো সরকারের আমলেই তা সঠিকভাবে মানা হয়নি। আর এ কারণেই দেশে তৈরি হয়েছে অসংখ্য ‘আয়নাঘর’; হয়েছে এবং হচ্ছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ গুম-খুন; চলেছে এবং চলছে নির্যাতন ইত্যাদি। আর এসব ঘটনার মধ্য দিয়েই দেশে প্রতিনিয়ত ভূলুণ্ঠিত হয়েছে মানবাধিকার।
ভবিষ্যতে আর কোনো সরকারের আমলেই যেন দেশে কোনো ‘আয়নাঘরের’ জন্ম না হয়, গুম-খুন, নির্যাতন, হয়রানি তথা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা না ঘটে, তা সুনিশ্চিত করার উপযুক্ত সময় এখনই। আর বর্তমান সরকারকে এটা সুনিশ্চিত করতে হবে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই। পাশাপাশি আয়নাঘরসহ বিগত বিভিন্ন সময়ে গুম-খুন, নির্যাতন, হয়রানিসহ নানা ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করাও এখন সময়ের দাবি। মনে রাখতে হবে, কেবল মানব পরিবারের সব সদস্যের সমান ও অবিচ্ছেদ্য অধিকারগুলো এবং মর্যাদার স্বীকৃতিই পারে বিশ্বে শান্তি, স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার আর মর্যাদার ভিত্তি গড়ে তুলতে। আর মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকা আমার, আপনার, সবার মৌলিক অধিকার, যা মানবাধিকারের সঙ্গে জড়িত।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : অধ্যাপক, আইন বিভাগ ও সহযোগী ডিন, মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য
kekbabu@yahoo.com
