Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বাইফোকাল লেন্স

ভারতও জানে পিলখানা হত্যাকাণ্ডে তাদের অপরাধের মাত্রা

Icon

একেএম শামসুদ্দিন

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভারতও জানে পিলখানা হত্যাকাণ্ডে তাদের অপরাধের মাত্রা

পিলখানায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডবিষয়ক জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের পর দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। মূলধারার গণমাধ্যমসহ নেটদুনিয়ায়ও এ নিয়ে নানারকম বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ইতিহাসের জঘন্যতম এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যচারীদের শনাক্তের জন্য নাগরিকদের পক্ষ থেকে জোর দাবি ওঠে। সরকারও জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে দেয়। কমিশন ১১ মাস ধরে তদন্ত করে একটি রিপোর্ট ৩০ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করে। রিপোর্টে পিলখানা হত্যাকাণ্ডে আওয়ামী লীগ ও ভারতের জড়িত থাকার কথা উল্লেখ আছে।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কোনোকালেই সেনাবাহিনীকে ভালো চোখে দেখেনি। আওয়ামী লীগের এ অবস্থানের সঙ্গে ভারতের অবস্থান হুবহু মিলে যায়। ভারতও কখনো চায়নি বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে একটি পেশাদার ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে উঠুক। অথচ, এ কথা অতিরঞ্জিত হবে না, স্বাধীনতার পর থেকে দেশের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে সেনাবাহিনী জনগণের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। পঁচাত্তরে গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে যখন একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু হয়েছিল, তখন বিয়োগান্তক ঘটনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ খেসারত দিয়েছিল। তবে, ওই ঘটনার পর জনগণ একদলীয় শাসনব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ পেয়েছিল। হাসিনাপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ও একই মনোভাব পোষণ করেন।

২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক দেড় মাস আগে ১৯ নভেম্বর সজীব ওয়াজেদ জয় যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইন্টারন্যাশনাল রিভিউ ম্যাগাজিনে Stemming the Rise of Islamic Extremism in Bangladesh শীর্ষক এক নিবন্ধে দাবি করেন, পূর্বতন জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে প্রায় ৩৫ শতাংশ মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ঢুকানো হয়েছে, যা সেনাবাহিনীর ভেতর উগ্র ইসলামপন্থি প্রাধান্য বাড়িয়েছে। ওই নিবন্ধে জয় সেনাবাহিনীর পাশাপাশি অন্যান্য সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর কথাও উল্লেখ করেন। তিনি নিবন্ধে তাদের নির্মূল করে এসব বাহিনী পুনর্গঠনের সুপারিশ করেন।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের নেতারা প্রতিশোধ নিতে উঠেপড়ে লাগে। এমনকি ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বিচারের জন্য সংসদে প্রবল দাবি ওঠে। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের চাপের মুখে তখন জেনারেল মইন নিজে শেখ হাসিনার সংসদ ভবনের অফিসে গিয়ে দেখা করেন। এরপর শেখ হাসিনা সেনা অফিসারদের বিচারের ব্যাপারে সোচ্চার মখা আলমগীর ও আবদুল জলিলদের ডেকে সেনাবাহিনী সম্পর্কে প্রকাশ্যে কথা বলতে বারণ করেন। তখন শেখ হাসিনা অন্য কোনো পরিকল্পনার কথা তাদের সঙ্গে শেয়ার করেছিলেন কি না জানা যায়নি। তবে সেদিনের পর এ ইস্যু নিয়ে আওয়ামী লীগ ও জোটের নেতাদের আর উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায়নি। এ ঘটনার ঠিক দেড় সপ্তাহের মধ্যেই পিলখানা হত্যাকাণ্ড ঘটে।

পিলখানা হত্যাকাণ্ডে ভারতের জড়িত থাকার বিষয়টি তদন্ত রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে। ২০০১ সালের ‘বরাইবাড়ি যুদ্ধে’ বাংলাদেশের কাছে নাস্তানাবুদ হওয়ার পর লজ্জায় ভারতের যে মাথানত হয়েছিল, পিলখানা হত্যাকাণ্ড তারই প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। ওই যুদ্ধে পরাজয়ের পর থেকেই প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছিল ভারত। বরাইবাড়ির ঘটনার অব্যবহিত পর লোকসভার উত্তপ্ত অধিবেশনে ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জসবন্ত সিং ‘এ ঘটনার বদলা নেওয়া হবে’ বলে জোরগলায় ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার সেই ঘোষণা ভারতীয় গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারও হয়েছিল। ঘোষণা করা হলেও বাংলাদেশে বিএনপি ক্ষমতায় আসায় তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। কারণ, লোকাল সাপোর্ট ছাড়া এত বড় কাজ বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। অতঃপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসায় তাদের সেই সুযোগটি ঘটে। ওদিকে পঁচাত্তরের মর্মান্তিক ঘটনা এবং ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কথিত অত্যাচার; এ দুই মিলে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বদলা নিতে শেখ পরিবারসহ আওয়ামী লীগের নেতারাও ক্ষিপ্ত ছিলেন। এখানেই শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ এবং ভারতের লক্ষ্যের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়।

১/১১-এর পর সেনাবাহিনীর পদাতিক ব্যাটালিয়নের আদলে প্রয়োজনীয় ক্ষুদ্র ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে বিডিআরের প্রতিটি ব্যাটালিয়নকে এমনভাবে গড়ে তোলা হচ্ছিল, যাতে একটি পেশাদার বাহিনীতে পরিণত হয়। লক্ষ্য একটাই, সীমান্তের নিরাপত্তা ছাড়াও ভবিষ্যতে যুদ্ধ বাধলে যেন সেনাবাহিনীর পাশাপাশি শত্রুকে শক্তহাতে মোকাবিলা করতে পারে। এছাড়াও পেশাদার সামরিক অফিসারের কমান্ডে থেকে বিডিআর সদস্যরা যদি যুদ্ধ করে, তাহলে ভারতের ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। সুতরাং, ভারত বাংলাদেশের এ পদক্ষেপকে ভালোভাবে নিতে পারেনি। তারা বাংলাদেশের এ উদ্যোগকে ফোর্স মাল্টিপ্লায়ার হিসাবে দেখেছে। এ কথা চিন্তা করেই বিডিআরের কোমড় ভেঙে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় ভারত। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের উইকলি আউটলুক ম্যাগাজিনে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সাবেক শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা বি-র‌্যামন এক নিবন্ধে বিডিআর সম্পর্কে ভারতের সেই মনোভাবের কথাই বলেছেন। ওই নিবন্ধে তিনি বিডিআরকে একটি ভয়ানক বাহিনী হিসাবে চিহ্নিত করেন। সীমান্ত রক্ষায় বিডিআরের দুর্দান্ত মনোভাবের কথা উল্লেখ করে বিএসএফকে বিভিন্ন সংঘর্ষে নাস্তানাবুদ করার কাহিনিও তুলে ধরেন। বিডিআরকে সামগ্রিকভাবে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের হাতে তাদের কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল থাকায় সীমান্তে বিএসএফকে পাত্তা না দেওয়ার কথাও বলেছেন তার নিবন্ধে। এ প্রসঙ্গে ২০০১ সালের এপ্রিলে বিডিআরের হাতে বরাইবাড়ি যুদ্ধে লজ্জাজনক মার খাওয়ার কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি। র‌্যামন, ইতঃপূর্বে বাংলাদেশে সেনাবাহিনী সম্পর্কেও বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ইসলামিকরণ ঘটছে এবং আফগান ভাইরাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আক্রান্ত। বিস্ময়কর যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পর্কে ‘র’-এর এ কর্মকর্তার মন্তব্যের সঙ্গে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের তিন মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইন্টারন্যাশনাল রিভিউ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সজীব ওয়াজেদ জয়ের মন্তব্যের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় হত্যাকাণ্ড শুরু হওয়ার পর থেকেই শেখ হাসিনা সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেন। মিটিংয়ের নামে তিন বাহিনী প্রধানকে তার অফিসে দিনভর বসিয়ে রেখে সময়ক্ষেপণ করেন। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর ঢাকা স্টেশন প্রধানের পরামর্শেই তিনি এসব করেছেন বলে জানা যায়। তার হুকুম অমান্য করে সেনাবাহিনী যদি হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশনে যায় কিংবা ঘটনার পরপর এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততার কথা জানাজানি হয়ে গেলে সেনাবাহিনী যদি কোনো পদক্ষেপ নেয়, তাহলে ভারত যাতে সামরিক হস্তক্ষেপ করে সে ব্যবস্থাও করে রাখা হয়েছিল।

এ ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক রিডার ও ভারতীয় গবেষক অভিনাস পালিওয়াল তার বই ‘ইন্ডিয়াস নিয়ার ইস্ট: অ্যা নিউ হিস্টোরি-এর একটি নিবন্ধ থেকে উদ্ধৃত করে ভারতের প্রণব মুখার্জিকে হাসিনার অনুরোধ এবং ভারতের সামরিক প্রস্তুতির কথা, তদন্ত কমিশন রিপোর্টে বিস্তারিত উল্লেখ করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ হত্যাকাণ্ডে ভারত যদি জড়িতই না থাকে, তাহলে অবিনাস পালিওয়ালের বক্তব্য অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের কলাইকুণ্ডা, আসামের জরহাট এবং আগরতলায় কেন ভারতীয় টাস্কফোর্স, তিন দিক দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করার নির্দেশের জন্য অপেক্ষায় ছিল?

পিলখানা হত্যাকাণ্ডে ভারত যে জড়িত, তার আরও একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের পর ভারতীয় মিডিয়ার আশ্চর্যজনক নীরবতা দেখে। ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ‘আলু-পেঁয়াজ’ নিয়েও বাংলাদেশ থেকে যদি কোনো মন্তব্য করা হতো, তাহলেও ভারতের মূলধারার গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোরগোল পড়ে যেত। নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে, অশ্রাব্য ভাষায় ড. ইউনূসের সরকার ও বাংলাদেশকে নানাভাবে অপমান করা হতো। অথচ ভারতকে অভিযুক্ত করে তদন্ত কমিশনের যে রিপোর্ট বেরিয়েছে, তা নিয়ে কিছু গণমাধ্যম খবর আকারে প্রকাশ করলেও তীব্র কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। ভারত সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ভারতীয় মিডিয়ার এ বিষয়টি আমি লক্ষ করেছি, যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় স্বাধীনতাসংক্রান্ত মার্কিন কমিশন যখন বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে ভারতের ‘র’-কে নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ করার সময়ও। ভারত বিবৃতির মাধ্যমে একটি প্রতিক্রিয়া জানালেও ভারতের গণমাধ্যমগুলো তখনো বেশি উচ্চবাচ্য করেনি। কারণ তারাও জানে, এসব নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে যেতে পারে। পিলখানা ঘটনার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সম্ভবত, ভারতও জানে, পিলখানা হত্যাকাণ্ডে তাদের অপরাধের মাত্রা। কানাডাসহ আরও কয়েকটি রাষ্ট্রও অনেক আগে থেকেই ‘র-এর বিরুদ্ধে আন্তঃরাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ করে আসছে।

তদন্ত শেষ হয়েছে। এ তদন্ত রিপোর্টের যাচাই-বাছাইও শুরু হয়েছে। পিলখানা ঘটনার আমিও ভুক্তভোগী। সে সময় আমি বিডিআরের একটি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ছিলাম। ভুক্তভোগী হিসাবে আমি নিজেও অন্য অনেকের মতো গত সতের বছর ধরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছি। সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর পিলখানা নিয়ে বেশ কয়েকটি নিবন্ধও লিখেছি। প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে আমার অভিজ্ঞতার আলোকে পিলখানা হত্যাকাণ্ডে ভারতের জড়িত থাকার ইঙ্গিতও ছিল সেসব নিবন্ধে। তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে এখন অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়েছে। সবার মতো আমিও আশা করব, এ রিপোর্ট জমা দেওয়ার মধ্যেই যেন সব শেষ হয়ে না যায়। দেশীয় অপরাধীরা চিহ্নিত হয়েছে। তাদের যথাশিগ্গির বিচারের আওতায় আনতে হবে। এ হত্যাকাণ্ডে ভারতের জড়িত থাকার বিষয়ে বসে না থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। ভারত যদি না মানে, প্রয়োজনে বিশ্বসংস্থার সাহায্য নিয়ে আন্তর্জাতিক তদন্তের মাধ্যমে ভারতকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।

একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, কলাম লেখক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম