Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

মওলানা ভাসানী এবং বিশ্বশান্তি

Icon

ড. মো. ফোরকান মিয়া

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মওলানা ভাসানী এবং বিশ্বশান্তি

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি জীবনভর একটি শোষণ ও নির্যাতনমুক্ত সমাজ কায়েম করার জন্য সংগ্রাম করেছেন। তাই বিশ্বশান্তি সম্পর্কে তার দর্শন অত্যন্ত স্পষ্ট। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ ও যুদ্ধজোটবিরোধী আন্দোলনে এবং উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্বাধীনতা ও জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের সমর্থনে গড়ে ওঠা বিশ্বশান্তি আন্দোলনে তার অবস্থান ছিল বিশ্ব নেতাদের পর্যায়ে।

ভাসানীর মতে, জাতি গঠনের জন্য দরকার শান্তির। কিন্তু শান্তি শুধু সুসংগঠিত দেশ থাকলে হয় না। বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হয়। কারণ যুদ্ধবিগ্রহ শুধু কোনো একটি দেশে বা মহাদেশে সীমাবদ্ধ থাকে না। তা সারা বিশ্বে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নাড়া দেয়। তার মতে, নতুন বা দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে দেশ গঠনের জন্য বিশ্বশান্তি খুবই জরুরি। শক্তিশালী দেশগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত। এর কল্যাণে তারা তাদের ক্ষমতা খুব সহজেই পুষিয়ে নিতে পারে। কিন্তু দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে তা সম্ভব নয়। তাই একমাত্র বিশ্বশান্তিই দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে দেশ গঠনের গ্যারান্টি। আর বিশ্বশান্তির গ্যারান্টি হচ্ছে মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে সৌভ্রাতৃত্ব ও সহনশীলতা।

তার মতে, যুদ্ধের মাধ্যমে কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। দুটি বিশ্বযুদ্ধ থেকে এ সত্য প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু পৃথিবীতে বিভিন্ন সামরিক চুক্তি ও সামরিক জোট যুদ্ধের আশঙ্কা বৃদ্ধি করছে ও শান্তির পথকে সংকুচিত করছে। তার মতে, ‘এতসব [এইরূপ] সামরিক চুক্তি হইয়াছে-যত দিন উপদলগুলো বিভক্ত হইয়াছে ততদিনই বিশ্বের অমঙ্গল নিশ্চিত হইবে।’ বিভিন্ন সামরিক জোট গঠনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মওলানা ভাসানীর একটা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তার মতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণনীতি ও রণকৌশল ভিন্ন ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষভাবে উভয়পক্ষের অনেক লোকজন ও আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে উভয়পক্ষই যুদ্ধের আয়তন ও পরিধি বৃদ্ধি করে এবং এ পৃথিবীর প্রায় সব দেশকে সে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য শক্তিশালী দেশগুলোর প্রস্তুতির ধরন দেখে মনে হয়, এবার তাদের রণকৌশল ও বাস্তবায়ন নীতি আরও পরিবর্তিত হবে। বিশেষ করে অন্যের মাটিতে এবং অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে যুদ্ধ পরিচালনার যে পরীক্ষামূলক নীতি তারা বিভিন্ন সামরিক চুক্তির মাধ্যমে গ্রহণ করেছে তা থেকে মনে হচ্ছে, এবার তারা নিজেদের সীমানাকে যুদ্ধ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করবে। এ কারণেই বিভিন্ন দেশকে বিভিন্ন নামে সামরিক জোটবদ্ধ করার চেষ্টা চলছে। এ তিনি বলেন, ‘আমি কোনো ধরনের যুদ্ধজোটের পক্ষপাতী না। বিশ্বশান্তি পরিপন্থি [এইরূপ] যে কোনো ধরনের যুদ্ধজোট মানবতা ও মুক্তির পথে বাধা।’

মওলানা ভাসানী সামরিক জোট বা চুক্তিকে বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি মনে করলেও আঞ্চলিক শান্তি ও সহযোগিতাকে বিশ্বশান্তির সহায়ক মনে করতেন। পাকিস্তান আমলে তিনি জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের একজন অবিচল সমর্থক ছিলেন। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা পণ্ডিত নেহেরুর বৈদেশিক নীতির তিনি ছিলেন সমর্থক, যদিও ভারতের অনেক অভ্যন্তরীণ নীতির তিনি সমালোচনা করেছেন। পাকিস্তানের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ঘেঁষা নীতির জন্য সব সরকারের সঙ্গেই তার মতবিরোধ ঘটেছে।

বিশ্বশান্তির ব্যাপারে মওলানা কতটা আন্তরিক ছিলেন তা উপলব্ধি করা যায়, তার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য থেকেও। তিনি তার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেটার হেডে লিখেছিলেন ‘জ্ঞান, বিশ্বশান্তি ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের জন্য।’ তিনি মনে করতেন, শান্তি এমনিতেই আসে না, অর্জন করতে হয়। সেজন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করতে হয়। তার মতে, সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিশ্বশান্তির পরিপন্থি। সাম্রাজ্যবাদেরই একটি দেশীয় রূপ হলো সামন্তবাদ। সামন্তবাদ শোষণের মাধ্যমে নানা কৌশলে অভ্যন্তরীণ শান্তি বিনষ্ট করে আর সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের প্রস্তুতি চালিয়ে শান্তি বিঘ্নিত করে। তাই বন্ধুত্ব ও প্রতিজ্ঞার জন্য বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের হুমকি বন্ধ করতে হবে।

ভাসানীর মতো পৃথিবীর আরও অনেক মনীষী ও বিশ্বশান্তি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন। তাদের মধ্যে দার্শনিক লর্ড রাসেল অন্যতম। তিনি সভ্যতা রক্ষার জন্য জাতিগুলোর চেয়েও অধিকতর ক্ষমতাশালী এক বিশ্ব সরকার সম্পর্কে বিবেচনা করেছিলেন। মূলত বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিগুলোর দৃশ্যমান ব্যর্থতা থেকেই এ ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠার চিন্তা এসেছিল। রাসেল এ ব্যাপারে মওলানা ভাসানীর মতামত জানতে চেয়েছিলেন। বিশ্ব সরকার প্রসঙ্গে রাসেলের প্রস্তাবকে স্বাগত জানালেও মওলানা ব্যাপারটি সম্ভব বলে মনে করেননি। বিভিন্ন দেশের সরকারের মধ্যে আদর্শগত ঐক্যের অভাবকে এ পথে বাধা বলে মনে করতেন।

শান্তির প্রতি মওলানা ভাসানীর এ আকর্ষণের উৎস তার ধর্ম বিশ্বাস-ইসলাম। ইসলাম তার কাছে ধর্ম-দর্শন সাধনা। বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করতেন। সারা পৃথিবীর মানুষই যুদ্ধের বিপক্ষে। তারা শান্তি চায়। কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠা হয় না কেন? তার মতে, মানুষের স্বার্থগত বাহ্যিক চিন্তাই এ ক্ষেত্রে বাধা হিসাবে কাজ করে। প্রত্যেক দেশ শান্তি চাইলেও নিজের মতো করে, নিজ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। তারা শান্তি চায়, কিন্তু আত্মস্বার্থ ত্যাগ না করে। অর্থাৎ বাহ্যিক স্বার্থরক্ষা করতে রাষ্ট্রগুলো পরিচালিত হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাধা সৃষ্টি করছে। তাই ব্যক্তিগত বা দেশগত স্বার্থকে ত্যাগ করে যদি পালনীয় নীতিকে গ্রহণ করা যায়, তাহলে হয়তো শান্তি প্রতিষ্ঠা অসম্ভব হবে না।

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে মওলানা ভাসানী আশাবাদী ছিলেন। তার মতে, কতগুলো মৌলিক ধারণাকে যদি বাস্তবে রূপ দেওয়া যায়, তাহলে ভবিষ্যতে পৃথিবীতে শান্তিময় পরিবেশ বিরাজ করবে। পৃথিবীর সব মানুষকে যদি একই ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হিসাবে বিবেচনা করা যায়, যদি বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতি সব পৃথিবীব্যাপী সব দেশের মধ্যে উপভোগ্য করে তোলা যায়, রাষ্ট্রের তথা সমাজের উপাদান হিসাবে যদি নৈতিক উপাদানকে কার্যকরী করা যায়, তথা অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক শোষণ বন্ধ করা যায় এবং প্রথমের যথাযথ মূল্য দেওয়া যায়, তাহলে পৃথিবীতে শান্তি আসবে এবং বিশ্বব্যাপী ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। তবে সে সমাজে যে একেবারে সংঘাত হবে না তা নয়। সংঘাত যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে সংহতি। বস্তুত সে সমাজকে যে সংঘাতমুক্ত ও সংহতিপূর্ণ পথ পরিযাত্রায়। ভাসানী এ সমাজের নাম দিয়েছেন ‘ইসলাম’। এ ইসলাম কোনো ‘রাজা বাদশাহের পালিত ইসলাম নয়’, ‘নবীজি প্রতিষ্ঠিত ইসলাম’।

শান্তির অন্বেষায় ভাসানী আজীবন সংগ্রাম করেছেন। দেশ ও দেশের বাইরে সর্বত্র তিনি ছিলেন আপসহীন। এ সম্পর্কে কবি, সম্পাদক আবদুল হাই শিকদার লিখেছেন, ‘বিশ্বশান্তি সম্পর্কে মওলানার দরদ ছিল সত্যিকার অর্থে গভীর। আজকালকার পেশিনির্ভর অন্তঃসারশূন্য রাষ্ট্রনায়ক কিংবা খামখেয়ালি কিংবা কালো টাকার বদৌলতে রাজনীতিবিদ এ রকম লোকরা যে অর্থে লোক দেখানো শান্তি শান্তি করে বেড়ায় সে রকম যে মওলানার জীবন ও সংগ্রাম নয় তা বলাই বাহুল্য।’ (লেখকের ‘মওলানা ভাসানী : রাজনীতি, দর্শন ও ধর্ম’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া)

ড. মো. ফোরকান মিয়া : সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন, সরকারি শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, বরিশাল

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম