’৪৭, ’৭১ ও ’২৪ একটা সিরিজ
মোবায়েদুর রহমান
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ইংরেজিতে একটি কথা আছে-Serpent in the grass. অর্থাৎ, ঘাসের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সাপ। গত বছরের ৫ আগস্ট অর্থাৎ জুলাই বিপ্লব সমাপ্ত হওয়ার পর ফ্যাসিস্ট আওয়ামী স্বৈরাচার দলবলসহ ভারতে পালিয়ে গেলেও অনেকে পালানোর সুযোগ পায়নি। প্রাণ বাঁচানোর জন্য তারা ঘাপটি মেরে এখানে-ওখানে লুকিয়ে ছিল। তারা অপেক্ষা করছিল, সময় কিছুটা অনুকূল হলে তারা আবার উঁকিঝুঁকি মারবে। এরপর ১৬ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। একটি বিপ্লব হওয়ার পর যে সহিংসতা হয়, বাংলাদেশে বলতে গেলে তার কিছুই হয়নি। ফরাসি বিপ্লবের দিকে বা সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট বিপ্লবের দিকে তাকান, দেখবেন প্রতিশোধ এবং সহিংসতা কত নৃশংস। সেখানে বাংলাদেশে পতিত স্বৈরাচারের একজন সিনিয়র নেতার টিকিটিও স্পর্শ করা হয়নি। অনেক নেতা গ্রেফতার হয়েছেন; কিন্তু কারাগারে তাদের কারও বিরুদ্ধে কোনো অসদাচরণ করার কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। বরং বেশ কয়েকজনের নামে গণমাধ্যমে রিপোর্ট এসেছে, তারা নাকি জেলখানার মধ্যে রাজার হালে রয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের বিচার হবে। অনেকের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই অভিযোগপত্র দায়ের হয়েছে। অনেকের মামলা শুরু হয়েছে। আবার অনেকের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে এবং তদন্ত শেষে চার্জশিট প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ব্যস্ত রয়েছে। কারও প্রতি বেইনসাফ করা হবে না।
কিন্তু এ নমনীয়তার পরও ঘাপটি মেরে থাকা স্বৈরাচারের ছদ্মবেশী দোসররা উঁকিঝুঁকি মারা শুরু করেছে। স্বৈরাচারের পক্ষে বা স্বৈরাচারের প্রধান পেট্রন ভারতের পক্ষে কথা বলার অনুকূল সময় এখনো আসেনি। তাই তারা ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া শুরু করেছে। এমন সব ইস্যু নিয়ে তারা কথা বলছে, যেগুলো জনগণ এবং জুলাই বিপ্লবের নেতাকর্মীদের মাথায় এখনো আসেনি।
তেমনি একটি ইস্যু হলো মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই যুদ্ধ। সচেতন পাঠকরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, একটি মহল জুলাই যুদ্ধের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকে দাঁড় করানোর অথবা মুক্তিযুদ্ধকে জুলাই যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর অপচেষ্টা করছেন। তাদের এ অপচেষ্টা দেখে আমরা বিস্মিত হয়ে যাই। আমি দৈনিক ৮/১০টি সংবাদপত্র পাঠ করি। এছাড়া টেলিভিশন ও কম্পিউটার তো রয়েছেই। অথচ বিগত ১৬ মাসে কোথাও দেখিনি যে, কেউ মুক্তিযুদ্ধকে জুলাই যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করছেন অথবা মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। এদের উদ্দেশ্য অত্যন্ত পরিষ্কার। একটি নন ইস্যুকে ইস্যু বানানো। অর্থাৎ জুলাই যুদ্ধের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকে টেনে এনে এ দুটি মহান সংগ্রামের মাঝে একটি বৈরী ভাব সৃষ্টি করা। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ইত্যাদি ইস্যুকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে নিজেদের ইচ্ছমতো ব্যাখ্যা ও ন্যারেটিভ প্রচার করেছে। উদ্দেশ্য, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা। স্বীকার করতেই হবে, আওয়ামী ঘরানা বিগত ১৫ বছর এ অপচেষ্টায় অনেকটা সফল হয়েছে।
কিন্তু মিথ্যা অপপ্রচারে সত্যকে তো আর চিরদিন ঢেকে রাখা যায় না। তাই কঠিন সত্য যখন বেরিয়ে এসেছে, তখন মিথ্যাচারীদের তল্পিতল্পা গুটিয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে। নতুন করে যারা এ ধরনের একটি বিরোধ পাকাতে চায়, তাদের সাধারণ মানুষের উদ্দেশে বিষয়টি পরিষ্কার করা দরকার।
২.
প্রতিটি জাতির জীবনেই কতগুলো ক্ষণ আসে, যেগুলোকে মাহেন্দ্রক্ষণ বলা যায়। বাংলাদেশিদের জীবনেও তেমনি তিনটি মাহেন্দ্রক্ষণ এসেছিল। এগুলো হলো, ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগ, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের জুলাই যুদ্ধ। তিনটিই ছিল গণমানুষের সংগ্রাম এবং যুদ্ধ। এসব ঘটনা সময়ের প্রয়োজনে ঘটেছে।
প্রায় ২০০ বছরের ইংরেজ শাসনে ভারতবর্ষের মুসলমানরা পদানত এবং বঞ্চিত হচ্ছিলেন। আজ যেটি বাংলাদেশ, সেটি একদিন বৃহত্তর বঙ্গ তথা উত্তর-পূর্ব ভারতের হিন্টারল্যান্ড বা পশ্চাৎভূমি ছিল। ২০০ বছরের ইতিহাস বর্ণনা করার সময় বা স্থান এখানে নেই। কিন্তু সংক্ষেপে এটুকু বলা যায়, ভারতবর্ষের মুসলমানরা হিন্দুদের সঙ্গে মিলে-ঝুলে একটি অখণ্ড দেশে বসবাস করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু ভারতবর্ষের স্বাধীনতার নামে কংগ্রেস শুধু হিন্দুদের স্বার্থ দেখার কারণে মুসলমানদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার সংরক্ষণে ভারত বিভাগ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। ফলে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে সৃষ্টি হয় দুটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। একটি ভারত ও অপরটি পাকিস্তান। সুতরাং, এটি বলতেই হবে, পাকিস্তান সৃষ্টি ছিল ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর আবার নতুন করে শোষণ-বঞ্চনার সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ প্রথমে পূর্ব বাংলা ও পরে পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চল তথা পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক শোষিত ও বঞ্চিত হচ্ছিল। এ বঞ্চনা ছিল সর্বক্ষেত্রে। রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রে। এটাকেই বলা হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের ওপর বৈষম্যমূলক আচরণ করা।
এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয় স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন। ১৯৫০ সাল থেকেই এ আন্দোলন শুরু হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় মানুষের গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষা ও মৌলিক অধিকারের স্পৃহা। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে সর্বপ্রথম নিখিল পাকিস্তানভিত্তিক সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সারা পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের অধীনে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকারী আওয়ামী লীগের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা অর্পণ করা উচিত ছিল; কিন্তু সেটি না করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে শুরু করা হয় মিলিটারি ক্র্যাকডাউন। এ ক্র্যাকডাউনের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা শুরু করেন মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারত সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ করে। পাকিস্তান পরাজিত হয় এবং পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ নামে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান লাভ করে।
এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাংলাদেশের জনসাধারণের যুদ্ধ। সব ক্ষেত্রেই যেমন কিছু সুযোগসন্ধানী থাকে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ও কিছু সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী ছিল। স্বাধীনতার পর তারা পালিয়ে যায়। তারা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি।
৩.
একটি রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে, যে স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিল দেশে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করা’ (বাংলাদেশের সংবিধান পৃষ্ঠা-১৫৫)। যে পাকিস্তানে ২৪ বছর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি, সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ৫৪ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। আগামী ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫৫ বছরে পদার্পণ করবে। অথচ এ ৫৫ বছরে শাসকগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা অসংখ্যবার বললেও সেই চেতনাকেই তারা ভূলুণ্ঠিত করেছে। প্রথমে শেখ মুজিবের আমলে বাকশাল নামক একদলীয় স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করা হয়। শেখ হাসিনার আমলে ১৫ বছরে রাজনীতি, অর্থনীতি ও মানবাধিকার যেভাবে লুণ্ঠিত হয়, সেটি এতই সাম্প্রতিক যে, সে কথা বিস্তারিতভাবে বলার কোনো প্রয়োজন নেই।
শেখ হাসিনার স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী ঘরানা ছাড়া সব রাজনৈতিক দল সংগ্রাম করে। কিন্তু তারা স্বৈরাচারের অবসান ঘটাতে সক্ষম হয়নি। গত বছরের জুলাই মাস থেকে ছাত্ররা কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু করলেও শেখ হাসিনা তার মজ্জাগত স্বভাব অনুযায়ী ছাত্রদের আন্দোলনকে অপমান করলে সাধারণ জনতাও ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়ায়। ছাত্র-জনতার এ আন্দোলনকে বুলেট ও বোমা দিয়ে নির্মমভাবে দমন করার চেষ্টা করেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা যতই বুলেট বোমা ব্যবহার করতে থাকেন, ততই আন্দোলন প্রথমে গণ-অভ্যুত্থান এবং পরে গণবিপ্লবে রূপান্তরিত হয়। অবশেষে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দলবল নিয়ে তার প্রভু ভারতে পালিয়ে যান। বিজয়লাভ করে জুলাই যুদ্ধ।
৪.
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার মানুষ যেমন দল-মত নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করেছিল, তেমনি মুক্তিযুদ্ধেও সামরিক জান্তার সুবিধাভোগী একটি গোষ্ঠী ছাড়া আমজনতা অংশগ্রহণ করেছিল। অনুরূপভাবে স্বৈরাচারী হাসিনা এবং তার মেন্টর ভারতের উচ্ছিষ্টভোগী একটি গোষ্ঠী ছাড়া জনগণ জুলাই বিপ্লবে অংশ নিয়েছিলেন।
উপরের এ আলোচনা থেকে দেখা যায়, সময়ের প্রয়োজনেই ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান হয়েছিল, যেখানে ছিল সর্বশ্রেণির মানুষের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। তেমনি সময়ের তাগিদেই সংঘটিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ, যে যুদ্ধ ছিল আমজনতার আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ। একইভাবে সময়ের তাগিদেই সংঘটিত হয়েছে জুলাই বিপ্লব, যে বিপ্লব ছিল জনগণের অভিপ্রায়ের বহিঃপ্রকাশ। যেহেতু তিনটি ঐতিহাসিক ঘটনাই ছিল গণমানুষের ইচ্ছায় সংঘটিত, তাই এ তিনটি ঘটনার প্রতিটিই ছিল একে অপরের সাপ্লিমেন্ট বা পরিপূরক। কেউ কারও সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। তাই মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই বিপ্লবও একে অপরের পরিপূরক। একটির বিরুদ্ধে আরেকটিকে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যারা মুক্তিযুদ্ধ এবং জুলাই যুদ্ধকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপচেষ্টা করছে, তারা সুনিশ্চিতভাবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের দুয়ারে করাঘাত করছে। আমাদের আবেদন, প্রতিটি প্রতিদ্বন্দ্বী দল এবং প্রার্থী এ বিভাজনের চক্রান্তের ফাঁদে পা দেবেন না। জনগণ আশা করে, তারা ’৪৭, ’৭১ ও ’২৪কে একই সূত্রে গ্রথিত করবেন।
মোবায়েদুর রহমান : সিনিয়র সাংবাদিক
journalist15@gmail.com
