কালজয়ী কবি সিকানদার আবু জাফর
সৈয়দ দীদার বখত
প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কবি সিকানদার আবু জাফর। ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের এক আশ্চর্য সুন্দর বর্ণাঢ্য চরিত্রের অধিকারী ছিলেন কবি সিকানদার আবু জাফর। বাংলা সাহিত্য অঙ্গনের সব ধারায় তার বিচরণ ছিল অনবদ্য ও জাজ্বল্যমান। তিনি একাধারে ছিলেন অসাধারণ কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, গীতিকার, সুরকার, সাংবাদিক, সম্পাদক ও শিল্পী। কোনো একটি বিশেষ ধারায় তাকে আবদ্ধ রাখলে তাকে খণ্ডিতভাবে বিচার করা হবে। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার একটি প্রতিষ্ঠান।
এ বরেণ্য কবি ১৯৫০-এ বাংলাদেশে আসার পর দেশের প্রগতিশীল সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করেন এবং কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের একতাবদ্ধ করে সামাজিক ন্যায়বিচার, খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার, সব ধরনের অত্যাচার, অবিচার, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন, তথা রাষ্ট্রগঠনের জন্য একতার অমোঘবাণী প্রচারের মাধ্যমে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছিলেন।
চল্লিশের দশকে তার প্রথম উপন্যাস ‘পূরবী’ প্রকাশিত হয়। ওই সময়ে গোটা ভারতবর্ষে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের আর্তনাদ ও সামাজিক অনাচার, নারী নির্যাতনের চিত্র তার এ উপন্যাসে তুলে ধরে অত্যাচার, অনাচার, অধিকারবঞ্চিত মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস বর্ণনা করে আলোড়ন তোলেন। চল্লিশের দশকে তার একটি ছোট গল্পের সংকলনও প্রকাশিত হয়। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রসন্ন প্রহর’ প্রকাশিত হয়। ভারত দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার পূর্বে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমাপ্তি, ১৯৪৭-এর ১৪/১৫ পাকিস্তান/ভারত সৃষ্টি আবেগপ্রাণ কবি সিকানদার আবু জাফরের জীবনে প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করে।
ভারতে থাকতেই তিনি তার কাব্যগ্রন্থ ‘তিমিরান্তিক’ রচনা শুরু করেছিলেন। ওই সময় থেকে তিনি তদানীন্তন রেডিও পাকিস্তানের জন্য কিছু গান রচনা করেন। সেগুলো ঢাকায় রেডিও কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। ১৯৫০-এ ভারতে স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কিছু রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে ভারত সরকারের মতবিরোধ সৃষ্টি হয় এবং বেশ কয়েকজন যারা স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের গ্রেফতার করা হয়। সে কারণে সিকানদার আবু জাফর পূর্ব পাকিস্তানে তার নিজ গ্রামে চলে আসেন। ১৯৫০-এর শেষদিকে তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের রেডিওতে স্টাফ আর্টিস্ট হিসাবে যোগদান করেন।
সম্ভবত ১৯৫৭ সালে তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের নতুন প্রজন্মের দেশপ্রেমের উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত তরুণ লেখক, কবি, সাহিত্যিকদের বিকাশের ধারা উন্মুক্ত করার চিন্তাচেতনায় এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি তার অত্যন্ত প্রিয় ভ্রাতৃসমতুল্য কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক হাসান হাফিজুর রহমানকে সহসম্পাদক করে বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে প্রতিষ্ঠা করেন যুগান্তকারী সাহিত্য পত্রিকা ‘সমকাল’। সম্পাদক হিসাবে তিনি এ পত্রিকায় নতুন প্রজন্মের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ কবি, সাহিত্যিকদের লেখনী প্রকাশ করা শুরু করেন। বাংলাদেশে খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিক, যারা নিজেদের চিন্তাচেতনার বিকাশ ঘটাতে পারছিলেন না, তারা কবি সিকানদার আবু জাফরের সাহিত্য পত্রিকা ‘সমকালে’র মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে তাদের প্রতিভাকে বিকশিত করার সুযোগ পেলেন এবং বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত হলেন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ‘সমকাল’ অফিস ছিল মুক্তচিন্তার লেখকদের তীর্থস্থান।
কবি সিকানদার আবু জাফর নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় তুলে ধরেছিলেন তার নবাব সিরাজউদ্দৌলা নাটক রচনা করে। আমরা বাংলার শেষ নবাব যৌবনদীপ্ত তেজস্বী পুরুষ সিরাজউদ্দৌলাকে ইতিহাস থেকে জেনেছি। সেই শেষ স্বাধীন নবাবকে তিনি সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে ইতিহাসের আলোকে তুলে ধরেন তার নাটকে। বিশ্লেষণধর্মী সিরাজউদ্দৌলা নাটকটি ঢাকায় মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে। নাটকটি পরিচালনা করেছিলেন কবির ঘনিষ্ঠতম বন্ধু উদয়ন চৌধুরী ওরফে ইসমাইল মোহাম্মাদ। কবির ছোটভাই নতুন প্রজন্মের শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর নাটকের দৃশ্য পরিচালনা ও মঞ্চসজ্জা করেছিলেন।
সিরাজউদ্দৌলা ছাড়াও কবি সিকানদার আবু জাফরের অনবদ্য সৃষ্টি নাটক ‘মহাকবি আলাউল’ ইউনিভার্সিটি ছাত্রদের পাঠ্যবই। এ মহাকবি আলাউল সম্পর্কে দৈনিক যুগান্তর সম্পাদক বর্তমান প্রজন্মের কালজয়ী কবি আবদুল হাই শিকদার তার মন্তব্যে বলেন, বরেণ্য কবির এ নাটকটি তিনি ভার্সিটির ছাত্রদের পড়ান। তার মন্তব্য, মহাকবি আলাউলকে কবি সিকানদার আবু জাফর নাটকের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে এক অপূর্ব অনুপ্রেরণাদায়ক চরিত্রের কবি হিসাবে তুলে ধরে ইতিহাসের পাতায় অমর করে গেছেন; যার কবিতা ও গান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
১৯৬৯ থেকে ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ পাকহানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কবি সিকানদার আবু জাফর তার প্রতিবাদী কলম দিয়ে সাহিত্যাঙ্গনে আলোড়ন তুললেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় ছাপা হলো তার অনবদ্য বলিষ্ঠ কবিতা ‘বাংলা ছাড়ো’। ওই সময়ে তিনি রচনা করলেন স্বৈরশাসনের নির্যাতন চিত্র তার ‘অভিযান’ পত্রিকার মাধ্যমে। তার লেখনীর কারণে পাকহানাদার বাহিনী তার সমকাল অফিস পুড়িয়ে দেয়। তিনি ভারতে পালাতে বাধ্য হন। এ সময় তিনি গণহত্যাকারী নরাধম ইয়াহিয়ার মানবতাবিরোধী অপরাধ বর্ণনা করে রচনা করেন ‘অভিযোগ’। এ অবর্ণনাতীত বর্বরোচিত গণহত্যার রচনাটি বিশ্বনেতৃত্বের কাছে সাতটি ভাষায় অনূদিত হয়ে প্রচার করা হয়। তার বর্ণনায় বিশ্বনেতৃত্ব বিবেকের তাড়নায় গণহত্যাকারী ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে এবং বাংলাদেশের নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়।
স্বাধীনতা-উত্তর দেশের দুর্যোগ ও দুঃসময়ে সিকানদার আবু জাফর ছিলেন সোচ্চার। কলকাতায় থাকতে তার অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন প্রধানমন্ত্রী, তার গণবিরোধী কাজের সমালোচনা করতে তিনি দ্বিধা করেননি। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধাচরণ ও সমালোচনা করায় গণকণ্ঠ ও হলিডে পত্রিকা সরকার বন্ধ করে দিয়েছিল। এ নির্ভীক সাহসী মুক্তচিন্তার কবি, কবি সিকানদার আবু জাফর শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সখ্য থাকা সত্ত্বেও ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে সমকাল প্রকাশনী থেকে গণকণ্ঠ ও হলিডে ছাপানোর ব্যবস্থা করেছিলেন।
কবির এ কাজে কুপিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী তাকে ডেকে পাঠান এবং তাকে তিরস্কার করেন। কবি সিকানদার আবু জাফর চুপচাপ তার তিরস্কার শুনে খুব শান্তভাবে বলেছিলেন, আমি আমার জীবনে এক সংগ্রামী বন্ধুকে দেখেছি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আন্দোলন করতে। অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দেখেছি। তাকে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে দেখেছি। জীবনের অর্ধেক সময় তাকে জেলের মধ্যে কাটাতে দেখেছি। সেই মানুষটি ক্ষমতার আসনে বসে মানুষের কণ্ঠরোধ করছে, এ আমি দেখতে চাই না। তাই আমি তাকে জনতার রুদ্ররোষের হাত থেকে বাঁচাতে ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে সরিয়ে আনার জন্য গণকণ্ঠ ও হলিডে ছেপে দিয়েছি।
তিনি প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, তোমার এখন অনেক ক্ষমতা, তুমি ইচ্ছা করলে আমাকে জেলে দিতে পার, এমনকি মেরে ফেলতেও পার, এতে আমি ভয় পাই না। আমি শুধু আমার বন্ধুকে মানুষের কল্যাণের নেতৃত্বে দেখতে চাই। আর আমার চাওয়ার কিছু নেই। এখন তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পার। এই বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং ‘চলি বলে’ চলে এলেন। এ কথোপকথন এবং আলাপচারিতার সময় তার অনুজ সাংবাদিক সৈয়দ দীদার বখত কবির সঙ্গে ছিলেন। তার সামনেই এ অসাধারণ কথোপকথন ও আলাপচারিতা হয়েছিল। এই মহান কবির স্মৃতি ধারণ করে তার পরিবারের সদস্যরা এবং গ্রামবাসী তার নামে একটি মাধ্যমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে এবং তার স্মৃতিকে অম্লান রাখার মানসে কবি সিকানদার ফাউন্ডেশন তৈরি করে তার লেখা, তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র সংরক্ষণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সৈয়দ দীদার বখত : সাংবাদিক, কলামিস্ট
