Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নিউইয়র্কের চিঠি

ট্রাম্পযুগে আলোচিত মিডিয়ার ‘ঐতিহাসিক নীরবতা’!

Icon

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ট্রাম্পযুগে আলোচিত মিডিয়ার ‘ঐতিহাসিক নীরবতা’!

ডোনাল্ড ট্রাম্প। সংগৃহীত ছবি

বাংলাদেশসহ এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশে ব্যক্তি, দলীয় অথবা সামরিক কর্তৃত্ববাদী শাসক ও সরকারগুলো গণমাধ্যমকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, যাতে গণমাধ্যমে তাদের দুর্নীতি, সহিংসতা এবং অন্যান্য অপশাসনমূলক কর্মকাণ্ডের ওপর কোনো সংবাদ অথবা নেতিবাচক সমালোচনা প্রকাশিত ও প্রচারিত না হয়। এজন্য তারা সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের মালিকপক্ষ ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হুমকি প্রয়োগ করে, সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করতে বাধ্য করে এবং আইনি ব্যবস্থা নেয়। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত শেখ হাসিনা ও তার দলের সরকারের মেয়াদে সরকারি দল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সাংবাদিক হত্যার ঘটনা ঘটেছে, অনেকে মামলায় অভিযুক্ত হয়ে কারাগারে গেছেন এবং বিরোধীদলীয় সংবাদপত্র ও টেলিভিশন যাতে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করেছে। টিকে থাকা গণমাধ্যগুলো প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের প্রশংসা ছাড়া দেশ ও জনগণের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেনি।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়ার ওপর এখন কর্তৃত্ববাদী আচরণের প্রভাব পরিদৃষ্ট হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে সংবাদপত্রের অবাধ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হলেও প্রভাবশালী সংবাদপত্র ও বড় বড় টেলিভিশন চ্যানেলকে ট্রাম্পযুগে ‘ঐতিহাসিক নীরবতা’ পালন করতে হচ্ছে তার বিরাগভাজন না হয়ে বাজার ঠিক রাখার জন্য। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সমর্থকদের উদ্দেশে বলতেন, ‘আমি জয়ী হলে, এবং আমি অবশ্যই জয়ী হব, তখন আমি যা করব, তার একটি হচ্ছে, গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে আমি আমাদের মানহানির আইন প্রয়োগ করব। সাংবাদিকরা যখন উদ্দেশ্যমূলকভাবে নেতিবাচক এবং চরম মিথ্যা নিবন্ধ লিখে, আমরা তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারি এবং এর মাধ্যমে প্রচুর অর্থ আদায় করতে পারি।’ এবং তিনি তা করছেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন হোয়াইট হাউজের বাইরে ছিলেন, তখনো তিনি গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অনেক মানহানির মামলা করেছেন। দশ বছর পর ট্রাম্প আবারও হোয়াইট হাউজে ফিরে এসেছেন এবং প্রথম মেয়াদের চেয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি আরও শক্তিশালী, আরও বেপরোয়া এবং মিডিয়ার বিরুদ্ধে আরও খ্যাপা। ট্রাম্প তার অপছন্দের মিডিয়া এবং ওইসব মিডিয়ার রিপোর্টার তার সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থেকে কোনো প্রশ্ন করলে তাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ ও অপমান করতে দ্বিধা করেন না। মিডিয়া ও সাংবাদিকদের ঢালাওভাবে অভিযুক্ত করে বলেন, তারা পক্ষপাতদুষ্ট।

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসাবে হোয়াইট হাউজে প্রবেশ করার আগে ও পরে ‘প্রেস ফ্রিডম ট্রেকার’ গণমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে তার করা মামলাগুলোর ওপর নজর রাখছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনি অভিযানের সময় থেকে তিনি মিডিয়া হাউজগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে দীর্ঘকাল ধরে আচরিত তার কৌশল নতুন করে এবং আগের চেয়ে আরও প্রবলভাবে প্রয়োগ করার নীতি অবলম্বন করেছেন। টাইমসের দুই রিপোর্টার তাদের লেখা একটি গ্রন্থ প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে নির্বাচনে তার জয়ের সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ দৈনিক দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এবং বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা পেঙ্গুইন র‌্যান্ডম হাউজ ও নিউইয়র্ক টাইমসের দুই রিপোর্টারের বিরুদ্ধে ফ্লোরিডার এক ফেডারেল আদালতে গত সেপ্টেম্বরে ১৫ বিলিয়ন ডলারের মানহানির মামলা করেছেন। উল্লেখ্য, রিপোর্টার রাস বুয়েটনার এবং সুজান ক্রেইগ রচিত এ গ্রন্থের নাম ‘লাকি লুজার : হাউ ডোনাল্ড ট্রাম্প স্কোয়ানডার্ড হিজ ফাদার’স ফরচুন অ্যান্ড ক্রিয়েটেড দি ইলিউশন অফ সাকসেস।’ এ মামলাটি ট্রাম্পের প্রতি কথিত ‘অন্যায় আচরণের’ অভিযোগে প্রধান মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে তার গৃহীত সর্বশেষ আইনি ব্যবস্থা।

মামলার বিবরণী অনুযায়ী, নিউইয়র্ক টাইমসের দুই রিপোর্টার ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কে একটি বই রচনা এবং তার ওপর তিনটি ‘মিথ্যা, বিদ্বেষপূর্ণ, মানহানিকর ও অপমানজনক’ রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন। মামলা করার আগে ট্রাম্পের আইনজীবীরা তার মানহানির জন্য ১০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। নিউইয়র্ক টাইমস এবং পেঙ্গুইন র‌্যান্ডম হাউজ তাদের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের মামলা করার ঘটনাকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেনি। এক বিবৃতিতে টাইমস বলেছে, ট্রাম্পের করা মামলার আইনগত কোনো বৈধতা নেই। এ ধরনের আইনি উদ্যোগ স্বাধীন রিপোর্টিংকে স্তব্ধ ও নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। পেঙ্গুইন র‌্যান্ডম হাউজ পৃথক এক বিবৃতিতে ট্রাম্পের মামলার অভিযোগকে ভিত্তিহীন উল্লেখ করে বলেছে, পেঙ্গুইন তাদের প্রকাশিত গ্রন্থ এবং দুই লেখকদের পাশে দাঁড়াবে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন ব্যক্তিত্বের, যারা সরকারি দায়িত্বে নিয়োজিত, তাদের পক্ষে মানহানির মামলায় জয়ী হওয়া কঠিন। কারণ এক্ষেত্রে তাদের প্রমাণ করতে হবে, অভিযুক্তরা যে তথ্য প্রকাশ করেছেন, তারা তা জানতেন এবং তারা যা জেনেছেন তা মিথ্যা ছিল।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে তার দ্বিতীয় মেয়াদে মিডিয়ার ওপর কতটা খ্যাপা, তা বড় বড় মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তার আইনগত আক্রমণ থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গত জুলাইয়ে ট্রাম্পের আইনজীবীরা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের বিরুদ্ধে ১০ বিলিয়ন ডলারের মানহানির মামলা করেছেন। একই মাসে তিনি সিবিএসের মূল মালিক কোম্পানি প্যারামাউন্টের বিরুদ্ধে এই মর্মে মামলা করার হুমকি দেন যে, ২০২৪ সালের নির্বাচনে ডেমোক্রেটদের বিজয়ের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে সিবিএসের নিউজ প্রোগ্রাম ‘সিক্সটি মিনিটস’-এ সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী কমলা হ্যারিসের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকার সম্প্রচারের ক্ষেত্রে প্রতারণামূলকভাবে সম্পাদনা করা হয়েছিল। এজন্য মানহানির ক্ষতিপূরণ দাবি করার আগেই সিবিএস প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরির জন্য ১৬ মিলিয়ন ডলার প্রদানের মাধ্যমে ঝামেলা নিষ্পত্তি করে। এবিসি নিউজ গত বছর ডিসেম্বরে ই জিন ক্যারল কর্তৃক ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ নিয়ে অ্যাঙ্কর জর্জ স্টেফানোপোলোস তার প্রোগ্রামে যে মন্তব্য করেন, সেটিকে কেন্দ্র করে ট্রাম্পের আইনজীবীরা এবিসি নিউজের বিরুদ্ধে মামলা করলে এবিসি ট্রাম্পের লাইব্রেরিতে ১৫ মিলিয়ন ডলার দান করে মামলা নিষ্পত্তি করতে সম্মত হয়। এর সঙ্গে আইনি খরচ বাবদ এবিসি নিউজকে গচ্চা দিতে হয় আরও এক মিলিয়ন ডলার।

ডোনাল্ড ট্রাম্প মিডিয়ায় বহুল আলোচিত ও সমালোচিত ব্যক্তিত্ব। তাকে নিয়ে সাধারণভাবে আমেরিকানদের কাছে এবং ব্যাপকভাবে বিশ্বে নন্দিত ও নিন্দিত। তার প্রতি মিডিয়ার আগ্রহও সীমাহীন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্বরত একজন ব্যক্তিত্বের নিন্দা ও বিরূপ সমালোচনা করা প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষে যতটা সহজ, মিডিয়ার পক্ষে তেমন সহজ নয়। সেজন্য ট্রাম্প ক্ষমতার বাইরে থাকাকালে মিডিয়ায় তার বিরুদ্ধে যেসব কথা প্রচার করা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে দায়েরকৃত মানহানির মামলা এখন প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্বের ওপর হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে। অধিকাংশ মামলা উত্থাপিত অভিযোগ বাদী অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পক্ষে হয়তো প্রমাণ করা অসম্ভব ব্যাপার, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে আইনি প্রতিষ্ঠানগুলো আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে ঝামেলা ছাড়াও উভয়পক্ষ থেকে যে বিপুল অঙ্কের ফি আদায় করবে, তা ভেবে অভিযুক্ত মিডিয়া হাউজগুলো বিবাদী পক্ষকে অর্থ প্রদানের মাধ্যমে নিষ্পত্তিতে উপনীত হওয়াকেই শ্রেয় বিবেচনা করে। সিবিএস ও এবিসি নিউজের মামলা নিষ্পত্তির দৃষ্টান্ত থেকে তা স্পষ্ট। তবে ট্রাম্প যেহেতু মিডিয়াবান্ধব হিসাবে খ্যাত নন, সেজন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান মানহানি আইনকে অভিযুক্ত মিডিয়া ও সাংবাদিকদের শাস্তির আওতায় আনার ক্ষেত্রে অপ্রতুল মনে করেন এবং আইনটি পরিবর্তন করার ব্যাপারে বারবার আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। তার মতে, মানহানির জন্য সংশ্লিষ্ট অযোগ্য সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পরিবর্তে বিদ্যমান আইনে তাদের শাস্তি থেকে রক্ষা করা হয়।

আমেরিকান সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে নিশ্চিত করা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দীর্ঘদিন থেকেই প্রচ্ছন্ন হুমকির মধ্যে ছিল; এখন তা দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো মুক্ত ও অবাধ বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতার দেশে মিডিয়াকে অনেক বেশি সতর্ক হয়ে কাজ করতে হচ্ছে। মানহানির মামলাগুলো মিডিয়া প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের মধ্যে চলমান উত্তেজনাকে প্রতিফলিত করে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রথম সংশোধনীকে পাশ কাটিয়ে মিডিয়ার স্বাধীনতা সংকুচিত করা এবং স্পর্শকাতর সরকারি তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট করার এখতিয়ার খর্ব করার জন্য ভিন্ন ধরনের বিধিবিধান কার্যকর করা হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। মিডিয়াকে যেভাবে আদালতে টেনে নেওয়া হচ্ছে, তাতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে মিডিয়ার স্বাধীনতা গুরুত্ব হারাবে। ভীতির মধ্যে সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে লিখতে দ্বিধাগ্রস্ত হবেন। যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস তাদের সর্বশেষ নির্দেশনায় সংরক্ষিত এলাকায় আয়োজিত কোনো অনুষ্ঠানেও সাংবাদিকদের অনুসন্ধানী সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং আদালত প্রয়োজনে সাংবাদিকদের সংগৃহীত ক্লাসিফাইড ডকুমেন্টের তথ্যের সূত্র প্রকাশের জন্য আদেশ দিতে পারে, এমন ইঙ্গিত দিয়েছে। এ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে বিশ্লেষকদের মধ্যে।

রিপোর্টার্স কমিটির প্রেসিডেন্ট ব্রুস ডি ব্রাউন জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের নির্দেশনায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এভাবে : যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে ফলপ্রসূ কিছু রিপোর্টিং, ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি থেকে ৯/১১-এর ঘটনার পর মিডিয়া যা প্রচার করেছে, তা সম্ভব হয়েছিল সাংবাদিকরা তাদের গোপনীয় সূত্রের পরিচয় রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে। সাংবাদিকদের জন্য শক্তিশালী সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং তথ্যপ্রবাহ অবাধ রাখার ওপরই আমেরিকান জনগণের ও গণতন্ত্রের অব্যাহত বিকাশ নির্ভর করে।

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু : যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক ও অনুবাদক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম