বিজিবি দিবস
সীমান্ত সুরক্ষায় অদম্য প্রহরীদের গৌরবগাথা
কর্নেল কাজী শরীফ উদ্দিন (অব.)
প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আজ ২০ ডিসেম্বর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) দিবস। বিজিবি বীরত্ব ও ঐতিহ্যের গৌরবমণ্ডিত এক সুশৃঙ্খল আধাসামরিক বাহিনী। এ বাহিনী বাংলাদেশের সীমান্ত সুরক্ষা, চোরাচালান প্রতিরোধ, নারী, শিশু ও মাদক পাচার প্রতিরোধসহ অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে অতন্দ্র প্রহরীর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের আগে এর নাম ছিল ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)। পরে নাম হয় বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর)। ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি বাহিনীর সদর দপ্তর পিলখানায় সংঘটিত বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে ৫৭ সেনাকর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন।
মর্মান্তিক ওই ঘটনার পর বাহিনী পুনর্গঠনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। মহান জাতীয় সংসদে ২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আইন, ২০১০ পাশ হয়ে ২০ ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকর হয়। ২৩ জানুয়ারি-২০১১ বাহিনীর সদর দপ্তরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর নতুন পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন এবং মনোগ্রাম উন্মোচনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ বাহিনীর নতুন পথচলা।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে পরিবর্তন ও উন্নতির দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বিজিবি আজ এক আধুনিক, দক্ষ ও পেশাদার বাহিনী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের ৪ হাজার ৪০০ কিলোমিটারেরও বেশি স্থল ও নদী সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করা কোনো সহজ দায়িত্ব নয়। সীমান্তের প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষায় বিজিবি সদস্যরা প্রতিদিন মুখোমুখি হন নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের-চোরাচালান, মানব পাচার, মাদক অনুপ্রবেশ, অস্ত্র ও বিস্ফোরক পাচার, সীমান্ত উত্তেজনা, প্রাকৃতিক বৈরিতা ইত্যাদি। সশস্ত্র কিংবা অসশস্ত্র প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা তাদের নিত্যদিনের কর্তব্য। কিন্তু পেশাদারত্ব, শৃঙ্খলা, সততা এবং সর্বোপরি দেশপ্রেমকে বর্ম করে তারা সেই দায়িত্ব পালন করে চলেছেন অটল সাহস নিয়ে।
বিজিবি কেবল সীমান্তরক্ষী বাহিনীই নয়-জাতীয় সংকট বা দুর্যোগে তারা জনগণের পাশে দাঁড়ানো এক নির্ভরতার প্রতীক। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভূমিধস বা অন্যান্য দুর্যোগে বিজিবি সদস্যদের তাৎক্ষণিক উদ্ধার ও মানবিক সহায়তা বহু মানুষের জীবন রক্ষা করেছে। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, বিশেষ অভিযান, ভিআইপি সিকিউরিটি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাতেও তাদের ভূমিকা প্রশংসনীয়।
বর্তমান সরকারের আধুনিকায়ন কর্মসূচির ফলে বিজিবির সক্ষমতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। আধুনিক নজরদারি প্রযুক্তি, সিসিটিভি মনিটরিং, ড্রোন পেট্রোল, উন্নত অস্ত্রভাণ্ডার, দ্রুতগামী টহলযান, নতুন ব্যাটালিয়ন সংযোজন, প্রশিক্ষণ সুবিধার সম্প্রসারণ-সব মিলিয়ে বাহিনী আজ আগের চেয়ে আরও সুসংগঠিত, শক্তিশালী এবং প্রযুক্তিনির্ভর। আন্তর্জাতিক মিশন ও বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতাও পেশাগত মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
এ বিশেষ দিনে আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি সেসব বীর সদস্যকে, যারা সীমান্ত রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাদের আত্মত্যাগ দেশের ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। আর যারা আজও নিঃস্বার্থভাবে সীমান্তের প্রতিটি ইঞ্চি পাহারা দিচ্ছেন-তাদের প্রতি রইল অসীম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও প্রেরণা।
দেশের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য বিজিবির অবদান অপরিসীম। তাই বিজিবি দিবস কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি জাতীয় স্বার্থ, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মিলিত অঙ্গীকার পুনঃনিশ্চিত করার এক তাৎপর্যময় মুহূর্ত। এ দিনটি হোক সীমান্ত সুরক্ষায় আরও দক্ষ, আধুনিক ও মানবিক বিজিবি গঠনের প্রত্যয়ে সমৃদ্ধ। সীমান্তরক্ষার এ অদম্য যোদ্ধাদের জন্য রইল গভীর সালাম ও শ্রদ্ধা।
কর্নেল কাজী শরীফ উদ্দিন (অব.) : নিরাপত্তা বিশ্লেষক, লেখক ও কলামিস্ট
