Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

মহিমান্বিত মৃত্যু

Icon

আবদুল লতিফ মাসুম

প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মহিমান্বিত মৃত্যু

মৃত্যু একটি অবধারিত সত্য। ‘জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে’। ‘কুল্লু নাফসিন জাইকাতুল মউত’। প্রতিটি জীবকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। মৃত্যু শেষ করে দেয় জীবন। কিন্তু যে জীবন মৃত্যুকে জয় করতে পারে, সেটিই সার্থক জীবন। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, শরিফ ওসমান হাদি সত্য ও ন্যায়ের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। যারা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করে মৃত্যুবরণ করে ইসলামের পরিভাষায় তাদের শহীদ বলা হয়। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বিশ্বাস করতে চায়, হাদি শাহাদতবরণ করেছেন। সময় টিভির সাক্ষাৎকারে হাদি বলেছিলেন : ‘হায়াত মউতের মালিক আল্লাহ, ন্যূনতম সিকিউরিটি নিয়ে চলাও হচ্ছে সুন্নাহ। কিন্তু আমাদের লড়াইটা হলো-আমার মা স্বাভাবিকভাবেই কান্নাকাটি করেন, আমার পরিবারের সবাই। তো আমি আমার মাকে বলেছি, দেখো আমরা তো একটা লড়াইয়ে নেমেছি। আমার মনে হয় কী, কোনো রাজনীতিবিদের বাসায় মৃত্যু হইতে পারে না। এটি কোনো ভালো মৃত্যু না। যিনি রাজনীতি করেন, যিনি লড়াই করেন, যিনি বিপ্লবী, যিনি সংগ্রামী, তার মৃত্যু হবে একটি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। একটা রাজপথে একটা গ্লোরির মৃত্যু। আমি তো ভীষণভাবে প্রত্যাশা করি, আমি ছোটবেলা থেকে এ স্বপ্নটা দেখি, আমি অনেক জায়গায় বলেছি, একটা তুমুল মিছিল হচ্ছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সেই মিছিলের সামনে আমি আছি, কোনো একটা বুলেট এসে আমার বুকটা হয়তো বিদ্ধ করে দিয়েছে। এবং সেই মিছিলে আমি হাসতে হাসতে শহীদ হয়ে গেছি। এবং সবাই যখন মৃত্যুটাকে ভীষণ ভয় পায়, আমি তখন হাসতে হাসতে আল্লাহর কাছে ভীষণ সন্তুষ্টি নিয়ে পৌঁছাতে চাই। যে আমি একটা ন্যূনতম ওই জীবনটা লিড করতে পারলাম যে, আমি একটা ইনসাফের হাসি নিয়ে আমি আমার আল্লাহর কাছে পৌঁছাতে চাই।’ এ কঠিন উচ্চারণ সহজ নয়। লক্ষ মানুষের মধ্যে কেবল নিবেদিতপ্রাণ মানুষ এ ধরনের উচ্চারণ করতে পারে। হাদির নিবেদিতপ্রাণ অনির্বাণ হয়ে বাংলাদেশের মানচিত্রে চির অমর হয়ে থাকবে। হাদির মৃত্যু মহিমান্বিত মৃত্যু।

কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে জুলাই যুদ্ধের এক সাহসী সেনাপতি ওসমান হাদি সমাহিত হলো রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। যে কবির উচ্চারণে উচ্চকিত হতো সে, তারই পাশে তাকে কবর দেওয়া হলো। এ প্রাণ প্রদীপ্ত বীর তরুণ জীবনের বিনিময়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন। এত আকুলতা, ব্যাকুলতা ও ভালোবাসা হয়তো কারও জন্য প্রদর্শিত হয়নি। তার জানাজা ছিল স্মরণকালের বাংলাদেশের এক ব্যতিক্রম। ৩৩ বছর বয়সি সাহসী এ তরুণ প্রতিবাদের ভাষায় জাগ্রত করেছে বাংলাদেশকে। যুদ্ধে যুদ্ধে দুনিয়া কাঁপানোর ইতিহাস শুনেছি। কিন্তু একটি মাত্র মৃত্যু যেভাবে দেশকে কাঁপিয়ে গেল, তার তুলনা নেই।

শরিফ ওসমান হাদি বিপ্লবের সন্তান। ১৭ বছরের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সে ছিল সোচ্চার। প্রতিবাদী পিতার সন্তান হিসাবে এ বছরগুলোতে সে তার বক্তব্য, অধ্যয়ন ও প্রচলিত কাঠামোর বাইরে ছিল সক্রিয়। অবশেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তার মতো সাহসী তরুণের জন্য আন্দোলন-সংগ্রামের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। সবার সঙ্গে একাত্ম হয়ে সহসা সহজাত নেতৃত্বের এ বীর তরুণ সহযোদ্ধার ভূমিকা পালন করেছে। প্রচলিত তথা গতানুগতিক রাজনীতির বিপরীত চরিত্রের হাদি যখনই অনুভব করেছে, ব্যতিক্রম কিছু তখনই কারও সঙ্গে দ্বন্দ্ব-কলহ, বিভেদ-বিদ্বেষে না জড়িয়ে তৈরি করেছে প্রতিবাদের আরেক সংগঠন-ইনকিলাব মঞ্চ। যেখানে অন্যায়, অনাচার, অত্যাচার লক্ষ করেছেন, প্রতিবাদে অগ্রণী হয়েছে হাদি। অনেকেই যখন বেছে নিয়েছেন সুবিধাবাদীর পথ, তখন ওসমান হাদি নির্মাণ করেছেন প্রতিরোধের প্রাচীর। জুলাই-পরবর্তী বাংলাদেশে নতুন ইতিহাস, নতুন অধ্যায় নির্মাণে স্বকীয় সত্তায় যারা এ জাতির প্রতিবাদের ভাষাকে উচ্চকিত করেছে, ওসমান হাদি সেসব যুব নেতার একজন।

তার যুদ্ধটি ছিল অভ্যন্তরীণ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। আনুষ্ঠানিক পদত্যাগ ও পলায়নের পর জুলাই নেতৃত্বের একাংশ যখন প্রশ্নবিদ্ধ, তখন ফ্যাসিবাদবিরোধী ঝান্ডাটি খুব শক্তভাবে তুলে নেন ওসমান হাদি। এ অভ্যন্তরীণ ফ্যাসিবাদকে মোকাবিলার জন্য তিনি প্রথমে ইনকিলাব মঞ্চ ও পরে ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার সবচেয়ে দৃশ্যমান সংগ্রাম হচ্ছে প্রবল প্রতিবেশীর আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। তার মৃত্যুর পর যেসব রাজনৈতিক বিশ্লেষণ বেরিয়েছে, তাতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়, তার মৃত্যুর বিষয়টি সরল সমীকরণের কিছু নয়। হত্যাকারীরা যত দ্রুততার সঙ্গে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে, তত দ্রুততার সঙ্গে মানুষের কাছে আসল খুনিদের পরিচয় উদ্ঘাটিত হয়েছে। একটি হত্যার মধ্য দিয়ে তাদের রক্তপাতের আরও খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। দিল্লি প্রকাশ্যে নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্কের কথা বলছে। অপরদিকে নির্বাচনকে অসম্ভব করার যাবতীয় সম্ভব কার্যক্রম চালু রেখেছে। তারা কূটনৈতিক ও অকূটনৈতিক ভাষায় বাংলাদেশকে উপদেশ দিচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের। তার মানে হচ্ছে, এ পতিত ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক পুনর্বাসন চায় তারা। আর সে পথে তরুণ হাদি ছিল এক বিরাট বাধা। সে ছিল একরকম একা মানুষ। কিন্তু তার চিন্তা ও চেতনার মানুষ ছিল অনেক। হাদি যে লক্ষ প্রাণের ভাষায় কথা বলেছেন, তার মৃত্যু-পরবর্তী ঘটনাবলি এর উজ্জ্বল প্রমাণ।

হাদি ছিল আগামী নির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থী। নির্বাচনব্যবস্থাটি গণতন্ত্রের একটি উত্তম উপায়, যার মাধ্যমে মানুষ তার প্রতিনিধিত্ব নির্ধারণ করেন। নিশ্চয় হাদি নির্বাচনকে ক্ষমতা আরোহণের একটি উপায় মনে করেননি। যদি তাই করতেন, তাহলে তার জন্য বড় বড় দলের একটি বড় আসন পাওয়া কঠিন ছিল না। হাদি নির্বাচনটি নিয়েছিলেন প্রতীকী অর্থে। প্রতিবাদের মাধ্যম হিসাবে। অবাক হওয়ার বিষয়, পথে পথে সাধারণ মানুষ তার সাথী হয়েছে। গরিব রিকশাওয়ালা, ভ্যানওয়ালা, হকার ও ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা তার হাতে গুঁজে দিয়েছে তাদের ভালোবাসার অর্থ। এ প্রতীকী নির্বাচনের মাধ্যমে হাদি উদ্ধার করতে চেয়েছেন প্রকৃত নির্বাচন। ওসমান হাদি ছিলেন প্রকৃত বিপ্লবী। তিনি আপস করতে চাননি। তিনি বলতেন, জান দেব তবু বিপ্লব বিসর্জন দেব না।

হাদির মৃত্যু মহিমান্বিত এ কারণে যে, বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রকে তিনি একটি বড় ধাক্কা দিয়েছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষের উত্তাল উত্তপ্ত ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন। ওসমান হাদির মৃত্যু মহিমান্বিত এ কারণে যে, দেশের গণমাধ্যম শুরু থেকে শেষ অবধি যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে তাকে প্রকাশ করেছে। মানুষ আবেগাপ্লুত হয়েছে। সংবাদপত্র তার জন্য সম্পাদকীয় লিখেছে। শোকগাথা ছেপেছে।

হাদির মহিমান্বিত মৃত্যু বাংলাদেশের মানুষের জন্য এক কঠিন বার্তা দিয়ে গেছে। সে বার্তা যেমন স্বাধীনতার সপক্ষে, অধীনতার বিপক্ষে, তেমনি ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, অন্যায়ের প্রতিবাদে। হাদির ওপর হামলার পরে রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে পারস্পরিক দোষারোপে লিপ্ত হয়েছিল, এখনো সে প্রবণতার যে রেশটুকু রয়ে গেছে, তাতে নাগরিক সাধারণ উদ্বিগ্ন না হয়ে পারে না। এটি অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত ও অন্যায়। হাদির রক্তঋণের মধ্য দিয়ে যেভাবে জাতীয় ঐক্য আরও সুদৃঢ় হওয়ার কথা, সেখানে যদি আবারও বিরোধ, বিতর্ক ও বিদ্বেষ লক্ষ করা যায়, তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা আর কিছু হতে পারে না। এতে নির্বাচনে নির্ভেজাল শান্তি ও স্বস্তি বিনষ্ট হবে। দোষারোপের রাজনীতিতে লাভবান হবে পরাজিত ফ্যাসিবাদ ও প্রতিবেশী আধিপত্যবাদ।

হাদি ছিল আমার সন্তানসম। কবি বলছেন যে, ‘পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ হিমালয়ের চেয়েও ভারী।’ একজন পিতৃপুরুষ হিসাবে হিমালয়সম শোকাতর হৃদয় আমার। অবশেষে প্রার্থনা মহান আল্লাহতায়ালা তাকে যেন বেহেশতের সর্র্বোচ্চ মোকামে স্থান দান করেন।

আবদুল লতিফ মাসুম : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম