Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বাইফোকাল লেন্স

ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী বিপ্লবীর মৃত্যু নেই

Icon

একেএম শামসুদ্দিন

প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী বিপ্লবীর মৃত্যু নেই

শেষ পর্যন্ত চলেই গেলেন শরিফ ওসমান হাদি। হাদির অবশ্য মৃত্যুভয় ছিল না। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, আলোচনা ও সাক্ষাৎকারে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি অনেকবার তার অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা বলেছেন। আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ও ভারতবিরোধী অবস্থানের কারণে তিনি হয়তো আশঙ্কা করেছিলেন, যে কোনো মুহূর্তে তার জীবনাবসান হতে পারে। তিনি এমনও বলেছেন, ‘আমি তো ভীষণভাবে প্রত্যাশা করি, কোনো একটা বিপ্লবে, কোনো একটা মিছিলে আমি সামনে আছি, একটা বুলেট এসে বিদ্ধ হয়ে গেছে আমার মাথায়, আমি হাসতে হাসতে শহীদ হয়ে যাচ্ছি।’ তার কথাই যেন বাস্তবে ফলে গেল। তিনি মাথায় গুলিবিদ্ধ হলেন এবং তারপর মারা গেলেন। একজন মানুষ কত সাহসী হলে ‘অকাল মৃত্যু’র আশঙ্কা আছে জেনেও নিজ আদর্শ ও সংগ্রাম থেকে পিছু সরে যাননি। তিনি তার স্বভাবসুলভ তেজোদীপ্ত কণ্ঠে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে গেছেন। ওসমান হাদি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম সাহসী নেতা ছিলেন। স্বৈরাচারের পতনের পর থেকে গত দেড় বছর, হাদি তার কথা ও কাজের মাধ্যমে এদেশের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। এত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি এমনভাবে সবাইকে উজ্জীবিত করেছিলেন, তার মৃত্যুতে পুরো দেশ শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে।

ওসমান হাদি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না। কোনো রাজনৈতিক দলের আদর্শে বিশ্বাসীও ছিলেন না। অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি যখন কথা বলতেন, তখন কাউকে ছেড়েও কথা বলতেন না। তিনি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যেমন কথা বলেছেন, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ করেছেন। একইভাবে এনসিপির কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা করতে দ্বিধা করেননি। ভারতের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের নাক গলানো নিয়ে তিনি তীব্র সমালোচনা করতেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর হাসিনা ও তার নেতাকর্মীদের আশ্রয় দেওয়ায় তিনি ভারতবিরোধী আক্রমণাত্মক বক্তব্যও দিয়েছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অন্যায্য ও প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে, রাজনৈতিক দলের ধূর্ততা ও ভণ্ডামি নিয়ে প্রকাশ্যে সাহসী বক্তব্য রেখেছেন। তিনি যুক্তিবাদী ছিলেন। রাজনীতির ভণ্ডামি নিয়ে দলগুলোর অতীত কর্মকাণ্ডের উদাহরণ টেনে, অপকর্মের তারিখ ও সময় উল্লেখ করে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতে দেখা যেত তাকে। আলোচনা, জনসভা, সুধীসমাবেশ, টকশো ও সাক্ষাৎকারে দেশবিরোধী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তিনি যে দৃঢ়তার সঙ্গে কথা বলতেন, তা স্বার্থান্বেষী মহলের অনেকেরই পছন্দ হতো না। আওয়ামী লীগ ও ভারতবিরোধী বক্তব্য তিনি এমন সাহসিকতার সঙ্গে উপস্থাপন করতেন, যা এদেশের লক্ষ-কোটি মানুষ মনে করতেন, যে কথা বলতে চেয়েও তারা বলতে পারেননি, হাদির কণ্ঠে যেন তাদের সে কথাই উচ্চারিত হয়। তিনি তার ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী সাহসী বক্তব্যের জন্য সবার কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এটাই তার কাল হয়ে দাঁড়ায়। তিনি টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন।

প্রশ্ন হচ্ছে, ওসমান হাদি কাদের টার্গেট হয়েছিলেন এ নিয়ে অনেক মতামতই পাওয়া যায়। কেউ বলেন, হাদির হত্যার পেছনে আওয়ামী লীগের হাত আছে, অনেকে এ ব্যাপারে ভারতকেও দোষারোপ করছেন। আবার অনেকে এ হত্যাকাণ্ডটি আওয়ামী লীগ ও ভারতের কলাবোরেশনে হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। দেশের গণমাধ্যম, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও অন্যান্য অনুসন্ধানী সূত্রে, ওসমান হাদির ঘাতকের ভারতে পালিয়ে যাওয়ার যে তথ্য পাওয়া যায়, তাতে শেষোক্ত ধারণার প্রতিই ইঙ্গিত দেয়। এ ব্যাপারে কিছুটা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

ওসমান হাদি জুলাই আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা ছিলেন। ৫ আগস্টের পর তিনিই অন্যতম, যিনি কোনো রাজনৈতিক দলে নাম লেখাননি। অথচ সভা-সমাবেশ ও গণমাধ্যমের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে অবিরত আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে গেছেন। জুলাইয়ের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের ভেতর ঐক্যের ফাটল ধরার পর, হাদি নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ তৈরি করে তরুণ সমাজকে আবারও ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। বৈষম্যবিরোধী অন্য নেতাদের যেমন রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাব আছে, হাদির সে রকম কিছু ছিল না। তিনি এসব থেকে বেরিয়ে এসে নিজস্ব পথে এগিয়ে যাওয়ার পথ বেছে নিয়েছিলেন। হাসিনার দুঃশাসনের সময় রাজনৈতিক দলগুলো সরকারবিরোধী কোনো কার্যকর আন্দোলনই গড়ে তুলতে পারেনি। দলীয় স্বার্থ ও আপসকামী মনোভাবের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ডাকা কোনো আন্দোলনই দেশবাসীকে তেমনভাবে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, দেশ ও জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট যে কোনো আন্দোলনেই পুরো দেশবাসীকে অনায়াসেই এক করা যায়। আঠারোর ‘সড়ক নিরাপদ’ ও চব্বিশের ‘কোটাবিরোধী আন্দোলন’ (অরাজনৈতিক ইস্যু)-এর প্রমাণ। ওসমান হাদি তরুণ সমাজের মাধ্যমে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে আওয়ামী লীগ ও ভারতের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তেমন আন্দোলনই গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি দেশ, জাতি, ভাষা, সংস্কৃতি ও মাটির প্রতি গভীর ভালোবাসা, আনুগত্য ও শ্রদ্ধাবোধ, যা কেবল আবেগ নয়, বরং দেশের অগ্রগতি ও মঙ্গলের জন্য সততা, ত্যাগ ও দায়িত্বশীল আচরণে প্রকাশ পায় এবং যেখানে নিজের স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া যায়; সেভাবেই তরুণ সমাজকে উজ্জীবিত করেছিলেন। তরুণ সমাজের পাশাপাশি দেশের সাধারণ মানুষও তার এ প্রচেষ্টায় সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল। এখানেই আওয়ামী লীগ ও ভারতের দুশ্চিন্তার মূল কারণ। এছাড়া আরও একটি দুশ্চিন্তার কারণ আছে। ভারত হয়তো ওসমান হাদির ভেতর ভবিষ্যৎ মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর প্রচ্ছায়া দেখতে পেয়েছিল। অনেকে মনে করেন, এসব চিন্তা থেকেই ওসমান হাদিকে তারা দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। অনুমান করা যায়, আপাতত, দুটি লক্ষ সামনে রেখে তারা এ পরিকল্পনা করে। এক. আওয়ামী লীগবিরোধী তথা ভারতের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠস্বর অন্য তরুণ নেতাদের মনে আতঙ্ক ছড়ানো। দুই. আওয়ামী লীগবিহীন নির্বাচন বানচাল করা।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, এমন সাফল্যজনক টার্গেট কিলিং কাদের মাধ্যমে সম্ভব? উপরেই উল্লেখ করেছি, আওয়ামী লীগ ও ভারতের লক্ষ একই। ওসমান হাদির মৃত্যুর পর যেসব তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এ টার্গেট কিলিংয়ে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ যে গোড়া থেকেই জড়িত, সে সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাছাড়া, অতীতে ‘র’-এর এ ধরনের টার্গেট কিলিংয়ের রেকর্ডও আছে। সে অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, ওসমান হাদি হত্যার মূল পরিকল্পনাও করেছে তারাই। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের বিরুদ্ধে একাধিক আন্তঃরাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও ভারতীয় এ গোয়েন্দা সংস্থাটির ওপর নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি সাংবিধানিক সংস্থা। এর আগে কানাডা, যুক্তরাজ্য ও পাকিস্তানে ‘র’-এর বিরুদ্ধে টার্গেট কিলিংয়ের অভিযোগ আছে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে বিভিন্ন উপায়ে গুপ্তহত্যা তৎপরতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে তাদের। ২০২৩ সালের ১৮ জুন কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে খালিস্তানি নেতা হরদীপ নিজ্জার হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে করণ ব্রার, কামাল প্রীতি সি ও করণ প্রীতি সিং নামক তিন ভারতীয় ‘র’ এজেন্টকে ধরা হয়েছিল। এ ছাড়া ‘র’, ওই বছরই ভাড়াটিয়া ঘাতক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক গুরুতোয়ান্ত সিং পান্নুকে হত্যার চেষ্টা করে। পরে যুক্তরাষ্ট্র ওই ঘটনায় জড়িত ভাড়াটিয়া ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে এবং ঘটনার বিস্তারিত তথ্য-প্রমাণ ভারতের সামনে তুলে ধরলে ভারত প্রকাশ্যে দায়িত্ব স্বীকার না করলেও বিকাশ যাদব নামক ‘র’-এর এক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করে কোনোরকমে পরিস্থিতি সামাল দেয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা অনেক বিশ্লেষকই বলছেন, ‘র’ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডের জন্য কোনো ঘাতক ভাড়া করেনি। আওয়ামী লীগই ঘাতক জোগাড় করে দিয়েছে।

তবে যে লক্ষ্য নিয়ে ওসমান হাদিকে হত্যা করেছে, বাস্তবে তার বিপরীত ফল হয়েছে। ঘাতকরা যে ধারণা করেছিল, হাদির মৃত্যুর পর আধিপত্যবাদবিরোধী কণ্ঠগুলো স্তব্ধ হয়ে যাবে, তা ভুল প্রমাণ হয়েছে। তরুণ প্রজন্মের নেতারা বরং আরও বেশি সোচ্চার হয়েছে। ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তার দেখিয়ে দেওয়া পথেই ঐক্য গড়ে উঠছে। তারা ভেবেছিল, ওসমান হাদির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্যে আরও ফাটল ধরবে; তাদের সেই ভাবনায় নিশ্চয়ই ছেদ পড়েছে। ঘাতকরা হয়তো কল্পনাও করেনি, এভাবে হাদির জনপ্রিয়তা বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল। অবশ্য, আমরাও কি তার এ বিপুল জনপ্রিয়তার পরিমাপ করতে পেরেছিলাম? ওসমান হাদির শারীরিক মৃত্যু হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী বিপ্লবীর মৃত্যু হয়নি। তিনি বেঁচে থাকবেন আধিপত্যবিরোধী সংগ্রামী মানুষের ভেতর।

হাদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের মানুষ যে ঐক্যবদ্ধ, সে বার্তা পৌঁছে গেছে বিশ্ব দুয়ারে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডাসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ওসমান হাদির মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে। ওদিকে হাদি হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। এতসব দেখে ঘাতকদের উপলব্ধিতে নিশ্চয়ই বেঘাত ঘটেছে। এ কারণেই এখন শোনা যাচ্ছে, সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সরাসরি কোনো হস্তক্ষেপ করা হবে না বলে জানিয়েছে। তারপরও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে যখন ভারতের অভিজ্ঞ নিরাপত্তা বিশ্লেষকের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে,‘পরবর্তী টার্গেটর নাম উল্লেখ করা বার্তা দেখা যায়, কীভাবে, কোথায় আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হবে বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয়, তখন এসব বিবৃতি ও প্রতিশ্রুতির প্রতি কতটুকু আস্থা থাকে? গণহত্যার অপরাধে পলাতক হাসিনার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার পরও যখন ফেরত দেওয়ার নাম নেয় না; সর্বশেষ ওসমান হাদির ঘাতককে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি যে আচরণ করা হচ্ছে, তাতে ভারতের এসব বিবৃতি ও প্রতিশ্রুতির কতটুকু মূল্য আছে? ভারতের এসব মিষ্টি কথায় চোখ বুজে না থেকে আরও বেশি সতর্ক হতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই রাজনৈতিক মতবিরোধ কমিয়ে, ওসমান হাদির মৃত্যকে কেন্দ্র করে যে ঐক্য গড়ে উঠেছে, তা ধরে রাখতে হবে। যাতে, আগামী ফেব্রুয়ারিতে স্থিতিশীল পরিবেশে নির্বাচন হতে পারে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ, সুষ্ঠু গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে পারে।

একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, কলাম লেখক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম