যে কারণে আরব বসন্ত কখনোই ব্যর্থ নয়
লারবি সাদিকি
প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আরব বসন্তকে ব্যাপকভাবে একটি ‘ব্যর্থতা’ হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। বিশ্বজুড়ে বিশ্লেষকরা একে আদর্শবাদের একটি ক্ষণস্থায়ী বহিঃপ্রকাশ হিসাবে চিত্রিত করেন, যা শেষ পর্যন্ত দমনপীড়ন, গৃহযুদ্ধ এবং স্বৈরশাসনের প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিউনিসিয়ার সিদি বাউজিদে রাস্তার বিক্রেতা মোহাম্মদ বুয়াজিজির আত্মাহুতির মাধ্যমে যে গণজাগরণের সূচনা হয়েছিল, তাকে আজ অনেকেই শুধু এক ট্র্যাজেডি বা দুঃস্বপ্ন হিসাবে স্মরণ করেন। কিন্তু এ দৃষ্টিভঙ্গি শুধু অসম্পূর্ণই নয়, বরং বিভ্রান্তিকরও বটে। বুয়াজিজির সেই চরম আত্মত্যাগ শুধু পুলিশি বর্বরতা বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ছিল না; এটি ছিল যুগ যুগ ধরে পুঞ্জীভূত অপমানের বিরুদ্ধে একটি নৈতিক বিদ্রোহ। এটি স্বৈরাচারী শাসনের ভিত্তিকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল। তিউনিসিয়া থেকে শুরু করে আরব বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে যা ঘটেছিল, তা শুধু বিক্ষোভ ছিল না-তা ছিল এক সামষ্টিক জাগরণ। মানুষ প্রথমবারের মতো মর্যাদা (কারামাহ), নাগরিকত্ব এবং আনুগত্যের সীমা সম্পর্কে নতুনভাবে সচেতন হয়ে উঠেছিল। তাই আরব বসন্তকে একটি ‘ব্যর্থ রাজনৈতিক রূপান্তর’ হিসাবে না দেখে, বরং ‘রাজনৈতিক চেতনার স্থায়ী রূপান্তর’ হিসাবে দেখা উচিত। এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবগুলো প্রাতিষ্ঠানিক নয়, বরং অভিজ্ঞতামূলক। এটি মানুষের মনে নাগরিকত্ব, বৈধতা এবং নিজের ভাগ্য নিজে গড়ার সক্ষমতা সম্পর্কে ধারণাকে আমূল বদলে দিয়েছে। অনেক দেশে শাসকগোষ্ঠী টিকে গেলেও বা আবার নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেলেও, মানুষের চেতনার এ পরিবর্তন মুছে যায়নি।
তিউনিস থেকে কায়রো, সানা থেকে বেনগাজি-প্রতিটি বিদ্রোহের নিজস্ব ইতিহাস থাকলেও তাদের ভাষা ও আবেগ ছিল অভিন্ন। বিক্ষোভকারীরা শুধু বস্তুগত সুযোগ-সুবিধা চায়নি, বরং তারা নিজেদের ‘রাজনৈতিক সত্তা’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। তারা এ বার্তাই দিয়েছিল যে, শক্তি প্রয়োগ করে কোনো সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য তাদের কণ্ঠস্বর রোধ করতে পারে না। আরব বসন্তের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল রাজপথ এবং চত্বরগুলোকে ‘গণশিক্ষার কেন্দ্রে’ রূপান্তর করা। কায়রোর তাহরির স্কয়ার, তিউনিসের বুর্গুইবা অ্যাভিনিউ বা সানার চেঞ্জ স্কয়ারে সাধারণ মানুষই নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে, রাস্তা পরিষ্কার করেছে এবং দাবি-দাওয়া নিয়ে বিতর্ক করেছে। রাষ্ট্রকে দখলমুক্ত করে এ গণপরিসরগুলোকে তারা গণতন্ত্রের হাতেকলমে শেখার পাঠশালায় পরিণত করেছিল। এ অভিজ্ঞতাটি অত্যন্ত মূল্যবান; কারণ এটি প্রমাণ করেছে যে, গণতন্ত্র শুধু কোনো সাংবিধানিক কাঠামো নয়, বরং এটি একটি সামাজিক অনুশীলন যা সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিখতে হয়। একবার যে মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে, সে স্মৃতি সে কখনোই ভুলতে পারে না।
এ অভ্যুত্থানগুলো শহরগুলোর গুরুত্বকেও নতুন করে ফুটিয়ে তুলেছে। সিদি বাউজিদের মতো প্রান্তিক জনপদ থেকে বিদ্রোহের আগুন জ্বললেও তা পূর্ণতা পেয়েছে নাগরিক কেন্দ্রগুলোতে। শহরগুলো প্রতিষ্ঠান, সামাজিক নেটওয়ার্ক এবং ঐতিহাসিক স্মৃতির মিলনস্থল। বাজার, পাড়া-মহল্লা, মসজিদ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গড়ে ওঠা সংহতি ও বিশ্বাসের নেটওয়ার্কগুলোই এ গণজাগরণকে টিকে থাকার শক্তি জুগিয়েছে। স্বভাবতই, এরপর দমনপীড়ন এসেছে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে। অনেক দেশে সামরিকায়ন ও গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। স্বৈরাচারী শাসকরা আবারও দেওয়াল থেকে মানুষের ছবি নামানো বা স্লোগান মোছার মতো কাজ করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। তবে দমনপীড়ন ২০১১ সালের সেই প্রতীকী সংগ্রামকে মুছে ফেলতে পারেনি। মানুষ দেখেছে যে ক্ষমতার দম্ভকে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব, বিদ্রুপ করা সম্ভব এবং তাকে নড়বড়ে করে দেওয়াও সম্ভব। এই শিক্ষা দমনের মাধ্যমে বিলীন হয় না।
এ কারণেই আরব বসন্ত আজও মৃত নয়। যা টিকে আছে তা কোনো বিশেষ প্রতিষ্ঠান নয়, বরং ‘মুক্তির পাঠ’ (Pedagogy of Liberty)। এ পাঠ নতুন প্রজন্মের রক্তে মিশে গেছে। আজকের তরুণরা যখন সামাজিক ন্যায়বিচার বা জবাবদিহিতার দাবিতে সোচ্চার হয়, তখন তারা সরাসরি ২০১১ সালের নাম না নিলেও সেই উত্তরাধিকার বহন করে। তিউনিসিয়ার একটি প্রান্তিক এলাকার দেওয়ালে লেখা গ্রাফিতি-‘তিউনিসিয়া কি একটি প্রজাতন্ত্র, রাজতন্ত্র, পশুর খামার নাকি জেলখানা?’-প্রমাণ করে যে মানুষের প্রশ্ন করার সাহস এবং সংশয়বাদী চেতনা এখনো জীবন্ত।
আরব বসন্তের সবচেয়ে বড় অবদান হলো, এটি আমাদের কল্পনার দিগন্তকে প্রসারিত করেছে। বুয়াজিজির প্রতিবাদ হয়তো তাৎক্ষণিক গণতন্ত্র এনে দেয়নি; কিন্তু এটি এমন এক সমালোচনামূলক চেতনা জাগ্রত করেছে, যা অন্যায় ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামকে আজও রসদ জোগাচ্ছে। আরব বসন্ত ব্যর্থ হয়নি; এটি শুধু রূপ বদলেছে, তার অর্থ ও উদ্দেশ্য আজও অপরিবর্তিত।
আল-জাজিরা থেকে ভাবানুবাদ
লারবি সাদিকি : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও গবেষক, স্কলার, চিবা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান
