দৃষ্টিপাত
বিপ্লবী হাদির আত্মদান বৃথা যেতে পারে না
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অগ্রপথিক, ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য সংসদ সদস্যপ্রার্থী, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদি ঘাতকের গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৩২ বছর। এ অল্প বয়সেই অমায়িক আচরণ ও নিজস্ব নেতৃত্বগুণে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। এর আগে ১২ ডিসেম্বর দুপুরে ওসমান হাদি রাজধানীর পুরানা পল্টন এলাকায় পরাজিত স্বৈরাচারী সরকারের দোসরদের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হলে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা করার পর তার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি না হলে উন্নততর চিকিৎসার জন্য ওসমান হাদিকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থাতে তিনি দেশবাসীকে কাঁদিয়ে পরপারে চলে যান।
কিছু কিছু মৃত্যু আছে, যা পাখির পালকের চেয়েও হালকা, যা সহজেই ভোলা যায়। আবার কিছু মৃত্যু আছে, যা পাহাড়ের চেয়েও ভারী, ইচ্ছা করলেই এমন মৃত্যুকে উপেক্ষা করা যায় না। ওসমান হাদির মৃত্যু আমাদের জন্য ছিল পাহাড়ের মতো ভারী। চাইলেও এ অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুকে আমরা ভুলতে পারব না। মাত্র ৩২ বছরেই শেষ হয়ে গেল একটি সম্ভাবনাময় জীবন। হাদি বেঁচে থাকলে আগামীতে দেশ ও দেশের জনগণের কল্যাণে অবদান রাখতে পারতেন। ওসমান হাদি ১৯৯৩ সালে ৩০ জুন বৃহত্তর বরিশালের ঝালকাঠি জেলার নলছিটির এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক আবহে ইসলামি ভাবধারায় গড়ে উঠেন তিনি। ওসমান হাদি ঝালকাঠি এনএম কামিল মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে আলিম পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। শিক্ষাজীবন শেষে একটি ইংরেজি কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিতেন।
ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে মানবিক গুণাবলির বিকাশ প্রত্যক্ষ করা যায়। একবার তার এক বন্ধু হাদিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমাকে যদি এক কোটি টাকা দেওয়া হয়, তাহলে কী করবে? উত্তরে হাদি বলেছিলেন, লাখ পাঁচেক টাকা দিয়ে আমার মনের মতো বই ক্রয় করব। অবশিষ্ট টাকা গরিব মানুষ, বিশেষ করে শিশুদের কল্যাণে ব্যয় করব। এ একটি মাত্র মন্তব্য থেকেই হাদির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। ছোটবেলা থেকেই তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তিনি প্রত্যক্ষভাবে কোনো রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ত হননি।
গত বছর জুলাই-আগস্টে দেশব্যাপী ছাত্রদের গণ-আন্দোলন শুরু হলে একপর্যায়ে ওসমান হাদি তাতে যোগদান করেন এবং নেতৃত্বের পর্যায়ে চলে আসেন। স্বভাবসুলভ নেতৃত্বগুণ এবং সরল ব্যবহার তাকে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সবার প্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। তিনি সমাজে বিদ্যমান সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন। যে কোনো বিদেশি আধিপত্য নিরসন এবং বাংলাদেশকে একটি সত্যিকার স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার চূড়ান্ত লক্ষ্য। তিনি আধিপত্যবাদের সব চিহ্ন মুছে ফেলার জন্য ছিলেন তৎপর। তিনি একবার বলেছিলেন, আমি যদি ৫০ বছর বেঁচে থাকি, কিন্তু কোনো ধরনের ইম্প্যাক্ট তৈরি করতে না পারি, তাহলে কী লাভ হবে? আর আমি যদি ৫ বছর বেঁচে থেকে ৫০ বছরের ইম্প্যাক্ট তৈরি করতে পারি, সেটাই কি ভালো নয়? বৈষম্য নিরসন ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় আমার সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। আমি মরে গেলে আমার উত্তরাধিকারীরা বংশানুক্রমিকভাবে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালিয়ে যাবে। যুদ্ধের ময়দানে আমি যদি মৃত্যুবরণ করি, তাহলে শহীদি মর্যাদা নিয়ে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হতে পারব। আল্লাহ তার এ আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেছেন। তিনি নিজের জন্য নয়, দেশ ও দেশের মানুষের জন্য আত্মত্যাগ করেছেন। ওসমান হাদির মতো বীর শত বছরে একবার জন্মে। তাদের কোনো মৃত্যু নেই। তারা অমর হয়ে থাকবেন যুগের পর যুগ।
চব্বিশের সফল গণ-অভ্যুত্থানের পর যারা এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের নানাভাবে পরাজিত শক্তির দোসররা হুমকি দিয়ে আসছিল। মাসখানেক আগে ওসমান হাদি মোবাইলে হত্যার হুমকি পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। তিনি তার ফেসবুকে লিখেছিলেন, অন্তত ৩০টি দেশি-বিদেশি মোবাইল নম্বর থেকে তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও লিখেন, আওয়ামী লীগের খুনিরা তাকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখছে। তবে আমি জীবনের বিনিময়ে হলেও ইনসাফের লড়াই চালিয়ে যাব। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেছিলেন, আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না। কারণ মৃত্যুর ফয়সালা জমিনে নয়, আসমানে হয়। ওসমান হাদি কোনো ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার জন্য নিহত হননি; তিনি সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে আত্মত্যাগ করেছেন। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর আন্দোলকারীদের অংশগ্রহণে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ গঠিত হলে ওসমান হাদি তাতে যোগদান করেন এবং সংগঠনটির মুখপাত্র হিসাবে দায়িত্ব লাভ করেন। ইনকিলাব মঞ্চের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে বিভিন্ন সময় দেওয়া তার বক্তব্য তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। আওয়ামী লীগের পতনের পর রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভে তিনি নেতৃত্ব দেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িকে ‘ফ্যাসিবাদের আঁতুড়ঘর’ আখ্যা দিয়ে ছাত্র-জনতা ওই বাড়ি ভেঙে ফেলার যে উদ্যোগ গ্রহণ করে, ওসমান হাদি তাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
ওসমান হাদি অনেকদিন ধরেই পরাজিত শক্তির টার্গেটে ছিলেন। তিনি তা জানতেন, কিন্তু কখনো ভীত হননি। তাকে যেভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে সঠিক নিশানা করে গুলিবিদ্ধ করা হয়েছে, এটি কোনো সাধারণ দুষ্কৃতকারীর কাজ নয়। অত্যন্ত উচ্চপর্যায়ের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষেই এভাবে চলন্ত অবস্থায় সঠিক নিশানায় গুলি করা সম্ভব। দুষ্কৃতকারীরা পতিত স্বৈরাচারের দোসর বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে; কিন্তু হাদির ওপর হামলার পর তারা কীভাবে পালিয়ে গেল, তা এক রহস্য বটে। এমনকি তারা দেশে আছে, না ভারতে পালিয়ে গেছে, তা নিয়েও ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে মনে করছেন, খুনিরা দেশেই আছে। তাদের রক্ষা করার জন্য একটি মহল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুনিরা ভারতে পালিয়ে গেছে এমন বয়ান তুলে ধরছে। কোনো অপরাধ সংঘটিত হলেই একটি মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে তা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে। একটি মহল ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনাকেও ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে।
অপরাধ বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, ওসমান হাদির মৃত্যুই শেষ নয়। আগামীতে এ ধরনের আরও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র দাবি করে, জুলাই বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে ভারতবিরোধী এমন অন্তত ৫০ জনকে টার্গেট কিলিংয়ের তালিকায় রাখা হয়েছে। প্রতিটি সফল বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কা থাকে। যদি বিদ্যমান পরিস্থিতি সঠিকভাবে সামাল দেওয়া না যায়, তাহলে বিপ্লবের অর্জন ভণ্ডুল হয়ে যেতে পারে।
বর্তমান মুহূর্তে আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি রোধ করা। বিগত সরকারের ১৬ বছরের অবৈধ শাসনকালে দেশের প্রতিটি সেক্টরে ব্যাপক দলীয়করণের মাধ্যমে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ বাহিনী, যারা তৃণমূল পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে; ব্যাপক দলীয়করণের মাধ্যমে তাদের দলীয় সরকারের আজ্ঞাবহ বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছিল। পুলিশ বাহিনীর নৈতিক মনোবল ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বিগত সরকার আমলে রাজনৈতিক পরিচয়ে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে বিত্তবৈভব গড়ে তুলেছেন, তারা এখন চেষ্টায় আছেন কীভাবে আবারও পতিত স্বৈরাচারকে ফিরিয়ে আনা যায়। স্বীয় অপকর্মের কারণে তারা এখন বাইরে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করছেন। পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকেই বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন। অনেকেই অভিযোগ করছেন, পুলিশ বাহিনীর একশ্রেণির সদস্য পরিকল্পিতভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তি ধ্বংস করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। তারা বিভিন্নভাবে পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। পতিত স্বৈরাচারের দোসররা ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ভণ্ডুল করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে।
ওসমান হাদির এ মৃত্যু বৃথা যাবে না। তার রক্তের স্রোতধারা আগামীতে বাংলাদেশকে বৈষম্যবিরোধী, সন্ত্রাসমুক্ত এবং আধিপত্যবাদবিরোধী প্রকৃত স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করবে। কথায় বলে, ‘একটি ফুল ছিঁড়ে নেওয়া যায়, কিন্তু বসন্তকে থামানো যায় না। আজ একটি ফুল হয়তো ঝরে পড়েছে, কিন্তু আগামীকাল আরও শতফুল ফুটবে।’ এভাবেই আমাদের সংগ্রাম চলতে থাকবে। ২০১৯ সালে আবরার ফাহাদ, ২০২৪ সালে আবু সাঈদ ও ২০২৫- এ ওসমান হাদির মৃত্যু গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে থামাতে পারবে না। বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনে শহীদ রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, উনসত্তরের আসাদ, নব্বইয়ে ডা. মিলন ও আশির দশকে নূর হোসেন যেমন মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অমর হয়ে আছেন, তেমনি ওসমান হাদিও চিরদিন এ দেশের মানুষের মনে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
গত ২০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় স্মরণকালের জনসমাবেশের মধ্য দিয়ে ওসমান হাদির জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। দল-মত নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এ জানাজায় অংশগ্রহণ করেন। অনেকেই ওসমান হাদিকে স্মরণ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ওসমান হাদির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পুরো জাতি আবারও জুলাইয়ের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। হাদির আত্মদান যুগ যুগ ধরে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অনুপ্রেরণা জোগাবে।
ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত

