Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

শহীদ হাদির জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি

ড. মাহবুব উল্লাহ্

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শহীদ হাদির জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি

মাও জে দং বলেছেন, কোনো কোনো মৃত্যু পাখির পালকের চেয়ে হালকা, আবার কোনো কোনো মৃত্যু থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী। শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যু ছিল থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী। তার মৃত্যু ছিল শহীদি মৃত্যু। এমন মৃত্যু, যা মৃত্যুকে জয় করে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে ওঠে, তেমন মৃত্যু কয়জনের কপালে জোটে!

ঘাতক পিস্তলের গুলি ছুড়ে হাদির মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার ফলে তার মস্তিষ্কের সবচেয়ে স্পর্শকাতর এলাকাটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এমন অবস্থায় বেঁচে থাকলে অলৌকিক ঘটনা হতো। আমাদের দুর্ভাগ্য, অলৌকিক ঘটনা ঘটেনি।

মস্তিষ্কে গুলিবিদ্ধ শরিফ ওসমান হাদিকে বাঁচানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে। তার চিকিৎসা হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, এভারকেয়ার হাসপাতাল ও সিঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতালে। আল্লাহতায়ালা বাংলাদেশের লক্ষ-কোটি মানুষের আকুতির প্রতি সাড়া না দিয়ে, হাদিকে তুলে নিয়ে গেছেন। বিধাতার এই বিধানকে রুদ্ধ করে এমন সাধ্য কার? আমরা শুধু আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করব, আল্লাহ যেন তাকে শহীদি মৃত্যুর মর্যাদা প্রদান করেন এবং বেহেশতের সর্বোচ্চ মাকামে তাকে ঠাঁই দেন।

হাদি ছিলেন ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক। তিনি এই অভ্যুত্থানে মুহূর্তের উত্তেজনা ও আবেগে যোগদান করেননি। তার ছিল একটি সুগঠিত রাষ্ট্রচিন্তা ও মতাদর্শ। তিনি চেয়েছিলেন, দেশটি যেন তার স্বপ্নের দেশ হয়। তার মধ্যে কোনো স্বার্থপরতা ছিল না। তার ধ্যান ও জ্ঞান সবই ছিল দেশ ও দেশের মানুষের জন্য নিবেদিত। বিরল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি। চমৎকার আবৃত্তি করতেন। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতাটি ছিল তার অত্যন্ত প্রিয়। এই কবিতা তিনি অনবদ্যভাবে আবৃত্তি করতেন বইয়ের প্রতি চোখ না রেখে। কবি নজরুল ইসলামকে এক সময় ধর্মান্ধ মোল্লারা কাফের উপাধি দিয়েছিল। কবি ইকবালের ভাগ্যেও এমন তকমা জুটেছিল। সমাজে যদি তমসাবাদীরা রাজত্ব করে, তাহলে এমনটিই হয়। কোনো মহৎ সৃষ্টিকে সম্মুখভাবে বোঝার ক্ষমতা এদের নেই। বিদ্রোহী কবিতায় এমন কিছু উচ্চারণ রয়েছে, যার প্রতি তমসাবাদীদের চরম বিতৃষ্ণা থাকার কথা; কিন্তু হাদি ছিলেন ভিন্ন প্রকৃতির এক মানুষ। তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে মুক্তকণ্ঠে বিদ্রোহী কবিতাটি আবৃত্তি করতেন, একজন খাঁটি বিদ্রোহী হিসাবে।

হাদি ছিলেন অনলবর্ষী বক্তা। তার বক্তৃতায় ভাস্বর হয়ে উঠত প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও দেশপ্রেমের অগ্নিমন্ত্র। তিনি অযৌক্তিক কোনো কথা বলতেন না। দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলোর সমালোচকদের প্রতি তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন, পারলে নিজেদের মতো করে আরও ১০টি প্রথম আলো পত্রিকা বের করুন। তিনি এ পত্রিকার অফিস জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানাননি। তিনি প্রসঙ্গ এলেই শহীদ জিয়া ও তার সহধর্মিণীর দেশপ্রেম ও স্বচ্ছ রাজনীতির অকুণ্ঠ প্রশংসা করতেন। তিনি আরও বলেছিলেন, জিয়াউর রহমন সামরিক বাহিনীর লোক হওয়া সত্ত্বেও শেখ মুজিবের হাতে বন্ধ হওয়া গণতন্ত্রের অর্গল খুলে দিয়েছিলেন, যে দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল।

জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় হাদির জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জানাজায় কোনো কোনো হিসাবমতে ১২ লাখ মানুষের সমাবেশ ঘটেছিল। স্মরণকালে এত বড় জানাজা হয়তো হয়নি। প্রশাসন আশঙ্কায় ছিল জানাজাকে ঘিরে উদ্বেগজনক কিছু ঘটতে পারে। না, তার ধারেকাছেও কিছু ঘটেনি। জনগণকে নিষেধ করা হয়েছিল, ভারী কোনো ব্যাগ বহন যেন না করে। মানুষ সর্বোচ্চ শৃঙ্খলার পরিচয় দিয়ে তেমন কিছু করেনি। বিপুল মানুষের সমাবেশ সত্ত্বেও কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেনি। এ দৃশ্য দেখে আশান্বিত হয়েছি। ভেবেছি, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ হারিয়ে যায়নি। এ জাতি ঐকবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল থাকলে, অনেক কিছু অর্জনে সক্ষম।

হাদির জানাজায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এবং তিন বাহিনীর প্রধানসহ রাষ্ট্রের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। প্রফেসর ইউনূস তার সংক্ষিপ্ত ভাষণে কণ্ঠরোধ করা স্বরে বলেছেন, হাদি তুমি আমাদের ছেড়ে যাওনি। তুমি রয়েছ আমাদের হৃদয়ে। মৃত্যুর পরও মানুষের হৃদয়ে থেকে যাওয়া পরম প্রাপ্তি। হাদির ভাগ্যে তাই ঘটেছিল।

হাদির জানাজায় বিশাল জনসমাগম কী বার্তা দিল? যে বার্তা আমরা পেয়েছি, তা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। জুলাই অভ্যুত্থানের পর ১৮ মাস কেটে গেলেও জনতা এখনো ঐকবদ্ধ। জুলাইয়ের চেতনা এখনো অত্যন্ত উজ্জ্বল। এই ঔজ্জ্বল্য বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি। এই চেতনা জাগ্রত আছে বলেই কোনো আধিপত্যবাদী শক্তি বাংলাদেশের প্রতি দন্ত-নখর বিস্তার করতে সাহস পাবে না। মওলানা ভাসানী বলতেন, ঐক্যবদ্ধ জনতার শক্তি অ্যাটম বোমার চেয়েও শক্তিশালী। একটি জাতি যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, সে যদি স্বাধীনতা চায়, তাহলে দুনিয়ার কোনো পরাশক্তি তাকে দমন করতে পারবে না। ভিয়েতনাম তার প্রকৃত প্রমাণ। দুই দশক প্রতিরোধযুদ্ধ করে ভিয়েতনামিরা ফরাসি ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের কবল থেকে স্বাধীনতা ও মুক্তি ছিনিয়ে এনেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসও তাই বলে।

আমাদের জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও উপলব্ধির জগতে কোনো শূন্যতা নেই। মানুষের প্রত্যাশায় নেই কোনো বিভ্রান্তি। তবে একটি জিনিসের ঘাটতি আছে। আর তা হলো, ত্যাগের ও সাহসের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনকারী নেতৃত্ব ও এমন নেতৃত্বের কমান্ডের অধীনে একটি সুশৃঙ্খল আদর্শবাদী রাজনৈতিক সংগঠন বা শক্তি। যে শক্তি জাতিকে দুর্দিনের দুর্গ শিরে বিজয় কেতন উড়িয়ে দেওয়ার সাহস জোগাবে। আমরা যদি সে রকম কিছু করতে পারি, তাহলেই শুধু একটি সুখী, সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ ও অগ্রসরমান বাংলাদেশ তৈরি করতে পারব। আমাদের শত্রুদের দ্বারা প্ররোচিত হওয়া চলবে না। ঝোপে-ঝাড়ে শত্রু খুঁজতে গিয়ে বিভ্রান্ত ও উতলা হওয়া চলবে না। আমরা যদি সে রকম অবিমৃশ্যকারিতায় লিপ্ত হই, তাহলে আমাদের ললাটে আরেকটি পলাশীর মৃত্যুরেখা অঙ্কিত হয়ে যাবে। আমাদের কোনো ফাঁদে পা দেওয়া চলবে না। জানতে হবে, কারা আমাদের শত্রু এবং কারা মিত্র। এটি চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হলে, মহাদুর্যোগ নেমে আসবে। আমাদের মন্ত্র হবে, Unite the many, Defeat the few. শত্রুর বৃত্ত যতি ছোট করে আনা যায়, তাতেই মঙ্গল। তাতেই বিজয়। জুলাই অভ্যুত্থানে এমনটি হয়েছিল বলেই ভারতের সেবাদাসী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন সম্ভব হয়েছিল। তেমন ঐক্য ধরে রাখতে হবে।

১৮ ডিসেম্বর রাতে একদল দুর্বৃত্ত প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার পত্রিকার ভবনে অগ্নিসংযোগ করে বড় ধরনের ক্ষতি করে। অগ্নিসংযোগে আক্রান্ত ডেইলি স্টারের সাংবাদিকরা ভবনের ছাদে উঠেছিলেন প্রাণরক্ষার জন্য। ভাগ্যক্রমে তারা এখনো বেঁচে আছেন। ডেইলি স্টার ভবনের সামনে সাংবাদিক ও সম্পাদক নূরুল কবীরকে হেনস্তা করা হয়েছে। নূরুল কবীর শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সাহসী প্রতিবাদী কণ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাকে কেন অপমান করা হলো, কোন বিচারে এবং কোন স্বার্থে, তা বোধগম্য নয়। একথা সত্য, পত্রিকা দুটির সম্পাদকীয় নীতিমালার বিরুদ্ধে অনেকেরই ঘোর আপত্তি আছে।

অনেকেই মনে করেন, পত্রিকা দুটি আধিপত্যবাদের স্বার্থের ধারক ও বাহকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। কিন্তু পত্রিকা দুটির অফিস জ্বালিয়ে দেওয়াই কি সমস্যার সমাধান? কেন আমরা ওই পত্রিকা দুটির চেয়েও অনেক বেশি জোরালো ধারণাসম্পন্ন দেশভক্ত পত্রিকা প্রকাশ করতে পারি না? এ ব্যর্থতার গ্লানি কি আমাদের লজ্জিত করে না? শহীদ শরিফ ওসমান হাদি আমাদের কাছে সেই জিজ্ঞাসাই রেখে গেছেন। যে কেউ অনলাইনে তল্লাশি চালালে, হাদির কথাগুলো শুনতে পারবেন। গণতন্ত্রে বহু মত ও পথের প্রতিযোগিতা হয়। এ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই গণতন্ত্র প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, রাষ্ট্র ও স্বাধীন সংবাদপত্রের মধ্যে বাছাই করতে হলে, আমি রাষ্ট্রহীন স্বাধীন সংবাদপত্রই পছন্দ করব।

দুটি সংবাদপত্র অফিসে অগ্নিসংযোগের পর কে বা করা লাভবান হয়েছে? আমার দৃষ্টিতে মনে হয়, এতে ভারতীয় আধিপত্যবাদই লাভবান হবে। কারণ, তারা বিশ্বময় প্রচার করবে, বাংলাদেশে একটি সভ্যতা-ভব্যতাহীন অপশক্তির অভ্যুদয় ঘটেছে এবং এদের কাছে কোনোরকম সৌন্দর্যবোধ ও সুকুমারবৃত্তির মূল্য নেই। এরা সভ্যতাবিরোধী বর্বর একটি গোষ্ঠী, ভারতীয় আধিপত্যবাদের এ প্রচারণা আমাদের জন্য খুবই ক্ষতিকর হবে। বুঝতে হবে, সম্ভবত একই অপশক্তি হাদিকে হত্যা করেছে এবং দুটি পত্রিকার অফিসে অগ্নিসংযোগ করেছে। এ অপশক্তির একটি মাত্র লক্ষ্য এবং তা হলো, বাংলাদেশে তাদের হারানো স্বর্গ পুনরুদ্ধার। এটি আমরা কোনো মতেই ঘটতে দিতে পারি না।

আততায়ীর হাতে হাদির মৃত্যু আমাদের মনে সেই আশঙ্কাই জাগায়, যা আরও অনেক দেশপ্রেমিককে গুপ্তহত্যার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা। এখন চিরন্তন সচেতনতা ছাড়া আমরা আমাদের স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারব না। তবে হামলার সময় সরকারের নীরবতা ছিল বিস্ময়কর। দেশের এ সংকটকালে রাষ্ট্রশক্তি যদি দোদুল্যমান ঝেড়ে ফেলে সঠিক অবস্থান নিতে না পারে, তাহলে দেশের জন্য সমূহ বিপদ অপেক্ষা করছে। আল্লাহ আমাদের সব মুছিবত থেকে রক্ষা করুন, এটাই সময়ের প্রার্থনা।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম