Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নিউইয়র্কের চিঠি

অভিবাসী বহিষ্কার প্রক্রিয়া আরও কঠোর ও নির্মম হচ্ছে

Icon

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অভিবাসী বহিষ্কার প্রক্রিয়া আরও কঠোর ও নির্মম হচ্ছে

ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত জানুয়ারি মাসে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে চলতি ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কমবেশি ৩০০ বাংলাদেশি অভিবাসীকে বহিষ্কার করে তাদের দায়িত্বে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে। দেশটির হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্টের (আইস) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ যাবৎ যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন দেশের ৫ লাখ ৭৯ হাজার বিদেশিকে বহিষ্কারের যে পরিসংখ্যান, তার মধ্যে বাংলাদেশের ৩০০ খুব বড় সংখ্যা না হলেও কাগজপত্রবিহীন বাংলাদেশি অভিবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ প্রবাসী বাংলাদেশি বসবাস করে নিউইয়র্ক এবং ক্যালিফোর্নিয়ার লসঅ্যাঞ্জেলেস সিটিতে। যাদের বৈধতার কাগজপত্র নেই, তারাও তাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও অন্যান্য পরিচয় সূত্রে এবং কাজের সুবিধার জন্য এ দুটি বড় শহরকেই বেছে নেয়। যাদের ইতোমধ্যে বহিষ্কার করা হয়েছে, তাদের মূলত এ দুটি শহর থেকেই আটক করার পর কয়েকদিন ডিটেনশনে রেখে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রতিশ্রুতির অন্যতম প্রধান ছিল অবৈধ অভিবাসীদের বহিষ্কারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং তিনি তা করেছেন। তার এ পদক্ষেপ আগামী দিনগুলোতে আরও জোরালো ও নির্মম হতে যাচ্ছে বলে অভিবাসী অধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট এজেন্টদের হাতে আটক না পড়ার প্রশ্নে অধিকার সংগঠনগুলো অবৈধ অভিবাসীদের নানা পরামর্শও দিচ্ছে। নিউইয়র্ক যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনবহুল শহর, অতএব সংগত কারণেই এ শহরে বৈধ ও অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যাও বেশি। শহরের মেয়র হিসাবে নির্বাচিত হয়েছে একজন মুসলিম ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট জোহরান মামদানি। আগামী ১ জানুয়ারি তিনি নিউইয়র্কের ১১২তম মেয়র হিসাবে শপথ গ্রহণ করবেন। মেয়র নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুমকি দিয়েছিলেন, মামদানি যদি নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচিত হন, তাহলে তিনি নিউইয়র্কের বার্ষিক ফেডারেল আর্থিক অনুদান বন্ধ করে দেবেন। জোহরান মামদানি ইতোমধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং তারা হোয়াইট হাউজে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রেখেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, অবৈধ অভিবাসীদের জন্য ‘স্যাঙ্কচুয়ারি সিটি’ হিসাবে পরিচিত নিউইয়র্ক থেকে অভিবাসীদের ধরপাকড়ে ফেডারেল অভিবাসন সংস্থাগুলোকে নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের সহায়তা প্রদানে মামদানি ট্রাম্পের চাপের কাছে নতি স্বীকার করেছেন। কারণ এ সহায়তা প্রদান না করার কারণে ট্রাম্প যদি শহরের বাজেটের প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার ফেডারেল অনুদান বন্ধ করে দেন, তাহলে তিনি শহরবাসীকে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেগুলো বাস্তবায়নে চরম এক সংকটের মধ্যে পড়বেন। মেয়র হিসাবে শপথ গ্রহণের পর নিউইয়র্কে যদি অভিবাসী ধরপাকড় বৃদ্ধি পায়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এ অভিযান শুরু হলে আরও কিছু বাংলাদেশি অভিবাসী বহিষ্কারের কবলে পড়তে পারেন।

অবৈধ অভিবাসী বিতাড়ন যে কতটা নির্মম পর্যায়ে পৌঁছতে পারে, তার একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত এক খবর থেকে। ওই খবরে বলা হয়েছে, বহিষ্কারের উদ্দেশ্যে আটক রাখার জন্য অভিবাসীদের ব্যয়বহুল ডিটেনশন সেন্টারের পরিবর্তে কিছু ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে, যারা পরিত্যক্ত বা অব্যবহৃত বিশালাকৃতির কিছু ওয়্যারহাউজ বা গুদাম সংস্কার করে একসঙ্গে ৮০ হাজারেরও বেশি অভিবাসীকে কিছু সময়ের জন্য অর্থাৎ তাদের আটক করার পর বিভিন্ন দেশগামী বিমানে উঠিয়ে দেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সেখানে রাখা হবে। এ ব্যবস্থায় আটক অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোসংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়া শেষ করার জন্য প্রথমে কয়েক সপ্তাহের জন্য প্রসেসিং সাইটে রাখা হবে। এরপর তাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত সাতটি বড় ওয়্যারহাউজের যে কোনো একটিতে পাঠানো হবে। প্রতিটি ওয়্যারহাউজের ধারণক্ষমতা হবে ৫ থেকে ১০ হাজার অভিবাসী। সেখান থেকেই অভিবাসীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা চূড়ান্ত করা হবে। বিশাল এ ওয়্যারহাউজগুলো ভার্জিনিয়া, টেক্সাস, লুইজিয়ানা, অ্যারিজোনা, জর্জিয়া এবং মিজৌরিতে যোগাযোগ সুবিধাযুক্ত স্থানের কাছাকাছি স্থাপন করা হবে। এ ছাড়া আরও ১৬টি ছোট আকারের ওয়্যারহাউজের প্রতিটিতে দেড় হাজার করে অভিবাসীকে সাময়িক সময়ের জন্য আটক রাখার প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিবাসী আটক ও বহিষ্কার অভিযানের পরবর্তী পদক্ষেপ হতে যাচ্ছে এ ওয়্যারহাউজ পরিকল্পনা।

চলতি আর্থিক বছরে আমেরিকান কংগ্রেস অবৈধ অভিবাসীদের আটকে রাখার জন্য ৪৫ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দিয়েছে। এ অর্থের একটি অংশ ব্যয় করে ইতোমধ্যে পরিত্যক্ত কিছু ডিটেনশন সেন্টার সংস্কার করে অভিবাসীদের আটকে রাখার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া ফেডারেল প্রশাসন রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত স্টেটগুলোর গভর্নরদের সঙ্গে আলোচনা করে দুর্গম এলাকায় কিছু সাময়িক স্থাপনা তৈরি করেছে অভিবাসীদের আটকে রাখার জন্য। আইস পরিচালক টড এম লিয়নস গত এপ্রিলে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘অবৈধ অভিবাসীদের আটক ও বহিষ্কারের কাজটিকে একটি ব্যবসার মতো পরিচালনা করার কৌশল শিখতে হবে আমাদের। প্রশাসনের লক্ষ্য হলো আমাজন যেভাবে তাদের প্যাকেজ পৌঁছে দেয়, ঠিক সেভাবে অবৈধ অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে যথাসম্ভব দ্রুত তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো।’ কৌশল বাস্তবায়নে প্রশাসনের সমস্যা সৃষ্টি হবে বলে অনেকে মনে করছেন। তাদের প্রশ্ন, মালামাল সংরক্ষণের উপযোগী করে নির্মিত ওয়্যারহাউজকে কীভাবে রাতারাতি মানুষের বসবাসের জন্য উপযোগী করে তোলা সম্ভব? ওয়্যারহাউজে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই এবং হাজার হাজার মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। চটজলদি কিছু করা হলে আটক অভিবাসীদের সেসব স্থানে মানবেতর জীবনযাপন করতে হবে। তারা প্রশ্ন তুলেছে, ট্রাম্প প্রশাসন কীভাবে মানুষকে পশুর মতো হীন বিবেচনা করে বসবাসের অনুপযোগী স্থানে অভিবাসীদের আটকে রাখার পরিকল্পনা নিয়ে মানবাধিকারের মহান দেশ হিসাবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের কাছে নিন্দিত করার কথা ভাবতে পারে?

হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের পক্ষ থেকে অবশ্য ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, অভিবাসীদের আটক রাখার উদ্দেশ্যে ওয়্যারহাউজগুলোর কাঠামোগত ও অভ্যন্তরীণ সংস্কার করা হবে। সেখানে প্রয়োজনীয় বাথরুম, কিচেন, ডাইনিং এরিয়া, চিকিৎসা সুবিধা ও বিনোদনের ব্যবস্থাসহ প্রশাসনিক অফিস তৈরি করা হবে। কোনো কোনো কেন্দ্রে অভিবাসী পরিবারের জন্যও পৃথক আবাসন ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন অবৈধ অভিবাসী বহিষ্কারে ইতোমধ্যে যেসব পদ্ধতি গ্রহণ করেছে, তা কোনো বিচারেই মানবিক ছিল না বা এখনো নেই। যেসব অভিবাসীকে বহিষ্কার করা হয়েছে, তাদের হাতকড়া ও পায়ে বেড়ি পরিয়ে দীর্ঘপথ বিমানভ্রমণে বাধ্য করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বিমানে তাদের পর্যাপ্ত খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ না করার অভিযোগও উঠেছে। চলতি বছরের প্রথমদিকে আমেরিকান সামরিক বিমানে প্রায় দেড়শ ভারতীয় অভিবাসীকে হাত-পা বেঁধে পাঞ্জাবের অমৃতসর বিমানবন্দরে নামানো হলে ভারতের পার্লামেন্টসহ সমগ্র দেশে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়; কিন্তু তাতে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রুক্ষেপও করেনি। এ সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশের কোনো নাগরিককে ফেরত পাঠায়, তাহলে তাদের যাতে হাত-পা বেঁধে না পাঠানো হয়। প্রথম দুই দফা বাংলাদেশি অভিবাসীদের সাধারণ বিমানযাত্রীর মতো পাঠানো হলেও পরবর্তীকালে তাদেরও হাতকড়া ও পায়ে বেড়ি পরিয়ে ফেরত পাঠানোর ঘটনা ঘটেছে।

ধরেই নেওয়া যায়, ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে অবৈধ অভিবাসী আটকের ঘটনা ব্যাপকতা লাভ করবে এবং তাদের প্রতি অমানবিক আচরণও বাড়বে। উদ্দেশ্য একটাই, যাতে এ কঠোরতা অবলম্বনের কারণে ভবিষ্যতে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে বিদেশিরা নিরুৎসাহিত হয়। অতএব রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত স্টেটগুলোতে অভিবাসীবিরোধী কার্যক্রম আগের চেয়ে জোরদার হবে এবং তা ডেমোক্রেটিক স্টেটগুলোতেও কার্যকর করা হবে বিভিন্ন কৌশল ও চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে। যেসব ওয়্যারহাউজকে অভিবাসী আটক কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগ রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত স্টেটে হলেও দুটি বড় ওয়্যারহাউজ ডেমোক্রেট নিয়ন্ত্রিত ভার্জিনিয়ার স্ট্যাফোর্ড ও মিজৌরির ক্যানসাস শহরে স্থাপন করা হবে। এর ফলে ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ‘আইস’ অবৈধ এবং অপরাধে অভিযুক্ত ও যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগও নেই, এমন অভিবাসীদেরও ছাড় দেওয়া হবে না। এবং এক্ষেত্রে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট স্টেটের কোনো বাছবিচার করা হবে না। ‘আইস’-এর তথ্য অনুযায়ী, চলতি ডিসেম্বরের শুরুতে আটক অভিবাসীর সংখ্যা ছিল ৬৮ হাজারের বেশি। তাদের মধ্যে প্রায় ৪৮ শতাংশের বিরুদ্ধে অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার বা অপরাধের কোনো অভিযোগ নেই।

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক ও অনুবাদক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম