ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি
বদরুদ্দীন উমর
প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ভারতের বর্তমান রাজনীতি। ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কয়েক বছর পর ভারতের রাজনীতিতে এখন এক নতুন হাওয়া বইছে। ২০১৪ সালে রাজনৈতিক আবহাওয়া উত্তপ্ত করে নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়লাভ করেছিল।
গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়েই নরেন্দ্র মোদির আঁতাত শুরু হয় ভারতের বড় পুঁজির সঙ্গে। আম্বানি, টাটা ইত্যাদি পুঁজিপতিদের তিনি অনেক ধরনের বিশেষ সুবিধা দেন। মোটর কারখানার জন্য টাটাকে তিনি নামমাত্র মূল্যে শত শত একর জমি দেন, যাকে দান ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।
এ জমি তিনি দিয়েছিলেন কৃষকদের তাদের জমি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে তখন আন্দোলনও হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতার গদিতে বসে নরেন্দ্র মোদির সেসব ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন হয়নি।
২০১৪ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনের সময়েই এ বড় পুঁজিই নরেন্দ্র মোদির নির্বাচন তহবিলে হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় সাহায্য করেছিল। নির্বাচনে জয়লাভ করে নরেন্দ্র মোদি কোনো নেমক হারামি করেননি। তিনি তার পাঁচ বছরের পুরো মেয়াদেই ভারতের বড় পুঁজির খেদমতগারি করেছেন।
তার এ খেদমতগারির মূল্য দিতে হয়েছে ভারতের কৃষকদেরকে এবং অন্য শ্রমজীবীদেরকে। মধ্যশ্রেণীর একটা বড় অংশও তার আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন।
বড় পুঁজির খেদমত যাতে মোটামুটি নিরাপদে করতে পারেন কৃষক, দলিত, নিুশ্রেণীর মানুষের ওপর শোষণ চাপিয়ে দিয়ে, এজন্য তিনি ধুয়া তোলেন হিন্দুত্বের। তার এ হিন্দুত্বের সঙ্গে সাধারণ কৃষক, দলিতসহ অন্য নিুশ্রেণীর লোকদের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও তিনি নির্বাচনের সময় হিন্দুত্বের বাতাস এমনভাবে তুলেছিলেন যে, গরিবরা নিজেদের স্বার্থের কথা ভুলে গিয়ে এবং নরেন্দ্র মোদির ধোঁকাবাজি ধরতে না পেরে বিজেপিকে ব্যাপক আকারে ভোট দিয়েছিল।
উত্তর প্রদেশে এটা যেভাবে দেখা দিয়েছিল, তাতে সেখানকার প্রধান দল মায়াবতীর নেতৃত্বাধীন বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) এবং মোলায়েম সিং যাদবের সমাজবাদী পার্টি ধরাশায়ী হয়েছিল। কংগ্রেসের অবস্থাও হয়েছিল একইরকম।
এখন সেই রাজনৈতিক আবহাওয়ার পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পার্লামেন্টারি ও রাজ্য নির্বাচনে উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ইত্যাদিতে বিজেপির প্রার্থীরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন। হিন্দুত্বের আওয়াজ এসব জায়গায় কোনো প্রভাব বিস্তার আর করতে পারেনি।
হিন্দুত্বকে তারা বিজেপির ধোঁকাবাজি হিসেবেই ধরে নিয়েছেন। রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশের নির্বাচনের আগে বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ তাদের এক সাংগঠনিক সভায় বলেছিলেন যে, এর পরবর্তী নির্বাচনে বিজেপি প্রতিটি আসনেই জয়লাভ করবে। কিন্তু দেখা গেল প্রতিটি আসনে জয়লাভ তো দূরের কথা, বিজেপি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। এ ফলাফল সামনে রেখেই এখন দিশেহারা বিজেপিকে তাদের নির্বাচনী চিন্তাভাবনা করতে হচ্ছে।
ভারতে এমন কোনো একক পার্টি নেই যারা বিজেপিকে পরাজিত করে সরকার গঠন করতে পারে। কাজেই আগামী নির্বাচনে বিজেপি যদি পরাজিত হয়, তাহলে ভারতে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হবে। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ ইত্যাদিতে দেখা গেছে যে, কংগ্রেসসহ বিজেপিবিরোধী দলগুলো যদি ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে বিজেপি নিশ্চিতভাবেই পরাজিত হবে।
তারা পাঁচ বছর ধরে বড় পুঁজির খেদমতগারি করতে করতে এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, তাদের প্রধান প্রচার অবলম্বন হিন্দুত্ব দিয়ে আর কোনো কাজ হচ্ছে না। তাদের হিন্দুত্বের আওয়াজ এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফাঁকা আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই নয়।
তবু লক্ষ করার বিষয় যে, বিজেপি এ অবস্থাতেও হিন্দুত্ব নিয়ে তাদের মাতামাতি কমায়নি। এখনও তারা মনে করে তারা নির্বাচনী প্রচারণায় হিন্দুত্বকে আঁকড়ে ধরে থাকলে তার মূল্য তারা পাবে। তাদের এ চিন্তা যে তাদের সর্বনাশ করবে এতে সন্দেহ নেই।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিজেপি যেভাবে তাদের কৃষকবিরোধী নীতি কার্যকর করে এসেছে সেটাই এখন তাদের জন্য ডেকে এনেছে সব থেকে বড় বিপদ। উত্তর ভারতের সর্বত্র, এমনকি দক্ষিণ ভারতেও, কৃষকরা বিপুল সংখ্যায় সংগ্রাম করছেন।
দূর-দূরান্ত থেকেও মিছিল করে এসে তারা মুম্বাই, দিল্লি, কলকাতা এবং অন্যান্য শহরে জমায়েত হচ্ছেন এবং সভা করছেন। তাদের জমি দখল, ঋণের বোঝা, ফসলের মূল্য, সার-বীজ ইত্যাদির দাবিতে তারা এখন বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যেভাবে নেমেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, কৃষকদের ভোটেই বিজেপির অবস্থা কাহিল হবে। হিন্দুত্বের ভেল্কি দেখিয়ে কৃষক ও দলিতদের মধ্যে আর কোনো কাজ হবে না।
এ পরিস্থিতিতে ভারতের বিরোধী দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনে জয়ের আশার সঞ্চার হয়েছে এবং তারা বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে। বিজেপি ইতিমধ্যেই তামিলনাড়–, অন্ধ্র, তেলেঙ্গানায় তাদের জোট শরিকদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। তারাও বিজেপিবিরোধী জোটের চিন্তাভাবনা করছে। ভারতের সর্ববৃহৎ রাজ্য হল উত্তর প্রদেশ। সেখানে পার্লামেন্টারি আসন সংখ্যা ৮০।
উত্তর প্রদেশে ইতিমধ্যেই মায়াবতীর নেতৃত্বাধীন বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) এবং অখিলেশ যাদবের নেতৃত্বাধীন সমাজবাদী পার্টি নির্বাচন সামনে রেখে জোট গঠন করেছে। এক্ষেত্রে তারা কংগ্রেসকে তাদের জোটের বাইরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মায়াবতী বলেছেন, কংগ্রেসকে এ জোটের মধ্যে রেখে কোনো লাভ নেই, কারণ কংগ্রেস তাদের পক্ষে কোনো ভোট ফেলতে পারবে না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এটা তাদের ক্ষতি করবে। এর মধ্যে দূরদৃষ্টির অভাব আছে।
কারণ কংগ্রেসের অবস্থা খারাপ হলেও তারা বিভিন্ন রাজ্যে তাদের হৃতশক্তি পুনরুদ্ধার করেছে। রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশই তার উদাহরণ। নির্বাচনের এখনও চার মাস বাকি। নির্বাচনের সময় অনেক ক্ষেত্রে দ্রুত পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। কাজেই উত্তর প্রদেশে কংগ্রেসের শক্তির যে হিসাব মায়াবতী ও অখিলেশ যাদব করেছেন সে হিসাব গণ্ডগোল হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা। কারণ যতদূর মনে হয়, উত্তর প্রদেশেও কংগ্রেস তার অবস্থার উন্নতি করছে।
এদিক দিয়ে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর ভূমিকাও কিছুটা কার্যকর হবে। যদিও বাজিমাত করার মতো কিছু করতে তিনি সক্ষম হবেন না। এখানে যে মূল সমস্যা দাঁড়াবে তা হল বিজেপি, এসপি ও কংগ্রেসের মধ্যে ভোট ভাগাভাগি। শেষ পর্যন্ত বিএসপি ও এসপি যদি কংগ্রেসের সঙ্গে জোটবদ্ধ না হয়, তাহলে এভাবে ভোট ভাগাভাগি হয়ে বিজেপির সুবিধা করে দেবে। এ কারণে বিজেপির অবস্থা খারাপ হলেও তারা অনেক ক্ষেত্রে জয়লাভ করতে পারে।
উত্তর প্রদেশে কংগ্রেসকে দুই পার্টির জোট থেকে বাইরে রাখার একটা কারণ তারা রাহুল গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চায় না। মায়াবতী নিজেই প্রধানমন্ত্রীর দাবিদার। বিরোধী দলগুলোর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নিয়ে ইতিমধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাভাবনা চলছে। পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জিও প্রধানমন্ত্রীর একজন দাবিদার, যদিও প্রকাশ্যে তিনি এখনও সেরকম কোনো দাবি করেননি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও তার সমর্থক আছে। নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপির অবস্থা এখন খারাপ।
কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের খুব ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। একক পার্টির মধ্যে বিজেপি এখনও সব থেকে শক্তিশালী। কাজেই তার বিরুদ্ধে অন্যরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে না দাঁড়ালে বিজেপির সুবিধা হওয়ার কথা।
উত্তর ও পূর্ব ভারত এবং দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো যদি জোট গঠন করে নির্বাচনে নামে তাহলে বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা আশা করা যায় যে, বিজেপি শোচনীয়ভাবে ২০১৯ সালের মে মাসের নির্বাচনে পরাজিত হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্ন নিয়ে অথবা অন্য কারণে যদি বিরোধীরা জোটবদ্ধ না হতে পারে, তাহলে শেষ পর্যন্ত কী হবে এটা এখন বলা মুশকিল।
বিজেপির পরই কংগ্রেস এখন হল একটা সর্বভারতীয় পার্টি। কাজেই কংগ্রেসকে বাইরে রেখে বিজেপির মোকাবেলা করার চিন্তা বিপজ্জনক। মায়াবতী, অখিলেশ যাদব, মমতা ব্যানার্জি প্রমুখ নিজেদের রাজ্যে যতই শক্তিশালী অবস্থানে থাকুন, সর্বভারতীয় নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তাদের সমর্থন খুব সীমিত।
কলকাতায় কয়েকদিন আগে মমতা ব্যানার্জি যে বিজেপিবিরোধী সমাবেশ করেছেন, তাতে তারা কংগ্রেসকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। রাহুল গান্ধী না গেলেও কংগ্রেসের প্রতিনিধি সেখানে বক্তৃতা করেছিলেন। এর থেকে মনে হয়, মমতা ব্যানার্জি কোনো ভবিষ্যৎ জোটের মধ্যে কংগ্রেসকে রাখার পক্ষে।
একসঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে তার কোনো আপত্তি নেই। দক্ষিণে তামিলনাড়–, অন্ধ্র প্রদেশ, তেলেঙ্গানা ইত্যাদিতেও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তেমন কোনো বিরাগ আছে বলে মনে হয় না। কংগ্রেস নিজেও জোট গঠনের চেষ্টা করবে এবং এভাবে যদি উপরোক্ত রাজ্যগুলোতে তারা জোটবদ্ধ হতে সক্ষম হয়, তাহলে শেষ পর্যন্ত এর প্রভাব উত্তর প্রদেশেও পড়তে পারে।
সেটা হলে সারা ভারতে বিরোধীদের ঐক্যজোটের মোকাবেলা করতে বিজেপি অক্ষম হবে। কারণ ইতিমধ্যেই বিজেপি জনগণ থেকে অনেকখানি বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং তারা বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিতে প্রস্তুত। বিশেষত কৃষকদের মধ্যে বিজেপির বিরুদ্ধে সর্বত্র যে ক্ষোভ ও বিক্ষোভ দেখা যাচ্ছে তাতে এ সম্ভাবনার ইঙ্গিত আছে।
ভারতে মাঝে মাঝে একদলীয় শাসন দেখা গেলেও তাদেরকেও জোট বেঁধেই শীর্ষস্থানে যেতে হয়েছে। বিগত কংগ্রেস সরকার এবং বর্তমান বিজেপি সরকারের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য। তবে ভারতে এখন একদলীয় শাসনের অবসান হয়েছে। কংগ্রেস ১৯৪৭ সালের পর থেকে যেভাবে টানা নিজের শাসন বজায় রেখে এসেছিল, সেরকম পরিস্থিতি ভারতে আর নেই।
এর মূল কারণ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের স্পষ্ট সংঘাত এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, ভারতের ঐক্য বলতে যা বোঝায় তার অবস্থা আর আগের মতো নেই। বিভিন্ন রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলোর গঠন এবং তাদের দ্বারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার মধ্যেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়।
কাজেই যে কারণে এভাবে রাজ্য পার্টিগুলো গঠিত ও শক্তিশালী হয়েছে, সে কারণেই ভারতে এখন এক দলের সর্বভারতীয় কোনো পার্টির সরকার প্রায় অসম্ভব। কাজেই আগামী নির্বাচনেও কে বা কোন দল থেকে প্রধানমন্ত্রী হবেন এটা অনিশ্চিত হলেও কোয়ালিশন সরকার ছাড়া অন্য পথ নেই। ভারত এখন কোয়ালিশন সরকারের যুগে প্রবেশ করেছে।
২৮.০১.২০১৯
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
