শতফুল ফুটতে দাও
উদার গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গত ২৯ জানুয়ারি দার্শনিক বার্নার্ড হেনরি লেভি, লেখক মিলান কুন্ডেরা, সালমান রুশদি, এলফ্রিড জেলিনেক এবং ওরহান পামুকসহ আরও ২৫ জন বুদ্ধিজীবী ইউরোপের বর্তমান পরিস্থিতির ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি দিয়েছেন।
বিবৃতিটি দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাদের বিবৃতির শিরোনাম ছিল, ‘ইউরোপের জন্য লড়াই করো, নইলে প্রতিশোধবাদীরা একে ধ্বংস করবে’। বিবৃতিতে তারা বলেছেন, এই মহাদেশটি ১৯৩০-এর দশকের পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। তারা আহ্বান জানিয়েছেন, ইউরোপীয় দেশপ্রেমিকদের জাতীয়তাবাদী আক্রমণ প্রতিহত করতে হবে। তারা আরও বলেছেন, ইউরোপ তাদের চোখের সামনেই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।
তাদের বিবৃতির মূল ভাষ্যটি হল : ‘‘ইউরোপের ধারণা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সব দিক থেকে সমালোচনা, অপমান এবং লক্ষ্য থেকে সরে যাওয়ার আওয়াজ আসছে। তারা চিৎকার করে বলছে, ইউরোপ নির্মাণের যথেষ্ট হয়েছে। এর পরিবর্তে আমাদের জাতীয় আত্মার সঙ্গে পুনঃসংযোজিত হতে হবে। আমাদের হারানো পরিচয় (Identity) পুনরাবিষ্কার করতে হবে। আমাদের মহাদেশকে ধুয়েমুছে সাফ করার জন্য লোকরঞ্জনবাদীরা সম্মিলিত এজেন্ডা দাঁড় করিয়েছে।
কিছু মনে করবেন না, আত্মা ও পরিচয়জাতীয় বিমূর্ত ধারণাগুলো বক্তৃতাবাগিশদের কল্পনাতেই অবস্থান করে। ইউরোপ ভণ্ড নবীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। তারা প্রতিবাদে বুঁদ হয়ে আছে এবং লোকসমক্ষে আসার সুযোগ ব্যবহারের জন্য প্রলাপ বকছে। এটা দুটি বিশাল মিত্র কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছে।
যারা পূর্ববর্তী শতাব্দীতে দু’বার একে আত্মহত্যা থেকে রক্ষা করেছে। এর একটি চ্যানেলের ধার ঘেঁষে রয়েছে, অন্যটি রয়েছে আটলান্টিকের ধার ঘেঁষে। মহাদেশটি ক্রেমলিনের দখলদারদের নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের ফলে ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ইউরোপের ধারণা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। এই বিষাক্ত আবহাওয়ার মধ্যেই ইউরোপের সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে মে মাসে। যদি কোনো পরিবর্তন না ঘটে, যদি উদীয়মান, ফুঁসে ওঠা অপ্রতিরোধ্য জোয়ারকে ঠেকানোর জন্য প্রতিরোধের নতুন চেতনার অভ্যুদয় না হয়, তাহলে এ নির্বাচনগুলো আমাদের জানামতে সবচেয়ে বিপর্যয়কর হবে।
তারা প্রতিশোধবাদীদের বিজয় উপহার দেবে। যারা এখনও ইরাসমাস, দান্তে, গ্যাটে ও কমিনিয়াসের ঐতিহ্যে বিশ্বাসী, তাদের জন্য ঘটবে কেবল লজ্জাকর পরাজয়। বুদ্ধিবৃত্তি ও সংস্কৃতির প্রতি ঘৃণা পোষণকারী রাজনীতির বিজয় ঘটবে। উগ্র জাত্যাভিমান এবং সেমিটিক জাতিবিদ্বেষবাদের বিস্ফোরণ ঘটবে। আমাদের ওপর নেমে আসবে বিপর্যয়। আমরা নিম্ন স্বাক্ষকারীরা হলাম সেইসব ব্যক্তি, যারা এ ঘনায়মান বিপর্যয়ের প্রতি নতিস্বীকার করতে রাজি নই।
আমরা আমাদেরকে ইউরোপিয়ান দেশপ্রেমিক (সাধারণ ধারণার বাইরে এ গোষ্ঠীটিই হল সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু তারা বেশিরভাগ সময় নিশ্চুপ ও আত্মসমর্পণ করে থাকতে চায়) হিসেবে ভাবতে চাই, যারা বুঝতে পারে এখানে বিপদটা কোথায়। এক শতাব্দীর তিন-চতুর্থাংশ বছর আগে ফ্যাসিবাদের পরাজয় হয়েছিল এবং বার্লিন প্রাচীরের পতনের ৩০ বছর পর সভ্যতাকে কেন্দ্র করে নতুন যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে।
আমরা যেসব মহৎ ধারণার উত্তরাধিকারী তাতে বিশ্বাসী থাকতে চাই। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের যথেষ্ট শক্তি আছে, ইউরোপের জনগণকে তাদের ওপর টেনে তুলতে পারি এবং তাদের যুদ্ধোন্মত্ততা থেকে রক্ষা করতে পারি। আমরা বিশ্বাস করি, এটাই একমাত্র শক্তি যার পুণ্য বলে ‘একদল-এক জাতির’ মতবাদের নতুন লক্ষণগুলোকে দূর করতে পারি। এগুলো অন্ধকার যুগের পুরনো দুর্দশাকে এদের উত্থানের মধ্য দিয়ে টেনে আনছে।
সামনে যে বিপদ আসছে তা বলে দেয়, চেষ্টা ছেড়ে দেয়া চলবে না। সেজন্যই নতুন এ জাগরণের প্রতি আমন্ত্রণ। এ নির্বাচনের আগে আমরা সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানাই। যারা ইউরোপিয়ান চিন্তার কবর রচনা করতে চায়, আমরা তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করব না। এজন্যই আমাদের উপদেশ হল, আবারও ইউরোপের আলোকবর্তিকাটি বহন করতে হবে। ভুল-ভ্রান্তি, ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং সময়ান্তরে কাপুরুষোচিত কার্যকলাপ সত্ত্বেও এটাই হল সব মুক্ত পুরুষ ও নারী, যারা এ গ্রহের বাসিন্দা, তাদের জন্য আলোকবর্তিকা।
আমাদের প্রজন্ম ভুল করেছিল। গ্যারিবোল্ডির ঊনবিংশ শতাব্দীর অনুসারীরা মন্ত্রের মতো জপত, ‘ইতালি তাকে তার নিজকে দিয়েই গড়বে’, সেরকমভাবেই আমরা বিশ্বাস করতাম মহাদেশটি নিজের দ্বারাই একত্র হবে। এর জন্য আমাদের কোনো সংগ্রাম করতে হবে না, অথবা কাজ করতে হবে না। আমরা ভেবেছি এটাই ইতিহাসের গন্তব্য। আমাদের অবশ্যই স্পষ্টভাবে পুরনো সেই বিশ্বাস থেকে সরে আসতে হবে। আমাদের কোনো পছন্দ নেই। আমাদের অবশ্যই ইউরোপের ধারণার জন্য সংগ্রাম করতে হবে। অথবা আমরা দেখব লোকরঞ্জনবাদের তলায় পিষ্ট হয়ে এটি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
জাতীয়তাবাদ ও পরিচয়বাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের অবশ্যই সক্রিয়তাবাদের চেতনার পুনরাবিষ্কার করতে হবে, নইলে প্রতিবাদ ও ঘৃণা আমাদের ঘিরে ফেলবে এবং আমরা ডুবে যাব। অতি জরুরিভাবে আমাদের এসব আত্মা ও চেতনার ধ্বজাধারীদের বিরুদ্ধে সাবধান বাণী উচ্চারণ করতে হবে। এটা প্যারিস থেকে রোম এবং মাঝপথে বার্সেলোনা, বুদাপেস্ট, দ্রেসদেন, ভিয়েনা, ওয়ারশ ইত্যাদি স্থানে আমাদের স্বাধীনতার বহ্নুৎসব করতে চাচ্ছে।
দিগন্তে ইউরোপের অদ্ভুত পরাজয় উঁকি দিচ্ছে। নতুন এ ইউরোপীয় চেতনার সংকট যা কিছু আমাদের সমাজগুলোকে মহান, সম্মানজনক ও সমৃদ্ধ করেছে, তার সবকিছুকেই ছিঁড়ে ফেলতে চাচ্ছে। ১৯৩০-এর দশকের পরবর্তী সময়ে যতসব চ্যালেঞ্জ এসেছে তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড়। এ চ্যালেঞ্জ উদারনৈতিক গণতন্ত্র এবং এর মূল্যবোধের বিরুদ্ধে।”
এসব দার্শনিক ও লেখকের বিবৃতি থেকে বোঝা যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ধারণা লোকরঞ্জনবাদী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। লোকরঞ্জনবাদীরা জয়ী হলে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটবে। দেখা যাচ্ছে, শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর সভ্য দেশগুলোতেও গণতন্ত্র বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। তা না হলে এসব বরেণ্য ব্যক্তি কেন এমন একটি বিবৃতি দিলেন লোকরঞ্জনবাদ এবং ফ্যাসিবাদের নব্য সম্ভাবনার বিরুদ্ধে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের সময় আওয়াজ তুলেছিলেন, We shall make America great again, আমেরিকা আমেরিকানদের জন্য। ট্রাম্পের এ স্লোগান মার্কিন জনগোষ্ঠীর বেশকিছু অংশকে প্রভাবিত করেছিল। এদের বেশিরভাগই হাইস্কুল পরীক্ষায় পাস না করতে পারার দল। এরা বেশিরভাগই বেকার, চাকরি পায় না। ২০০৮ সালে যে অর্থনৈতিক রিসেশন শুরু হয়েছিল, তার ফলে এদের অবস্থা আরও সঙ্গীন হয়ে পড়ে। ট্রাম্পের স্লোগান থেকে তারা ইঙ্গিত পেল অভিবাসীদের আমেরিকায় আগমন নিষিদ্ধ করা হবে।
কারণ তারা নিুস্তরের চাকরির বাজার দখল করে আছে। ছয়টি দেশ থেকে, বিশেষ করে মুসলিম অধ্যুষিত দেশ থেকে আমেরিকায় আসার ভিসা বন্ধ করে দেয়া হল। এসব নিয়ে আইনি লড়াইও চলল। অন্যদিকে ট্রাম্প হুমকি দিলেন, মেক্সিকো সীমান্তে এমন একটি দেয়াল তৈরি করা হবে যাতে মেক্সিকোসহ অন্যান্য লাতিন আমেরিকার দেশ থেকে অনুপ্রবেশকারীরা আমেরিকায় ঢুকতে না পারে। তিনি দম্ভভরে বললেন, এ দেয়াল নির্মাণের খরচ মেক্সিকোকে বহন করতে হবে। এর ফলে বেকার আমেরিকানদের অনেকে ভাবতে শুরু করল চাকরির বাজারে তাদের কোনো প্রতিযোগী থাকবে না। শুধু তাই নয়, ট্রাম্প সস্তা চীনা পণ্যের ওপর উচ্চহারে শুল্ক ধার্য করলেন।
এ থেকেও অনেক বেকার ভাবতে শুরু করল আমেরিকার দেশীয় শিল্পগুলো আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবে। ফলে বেকারদের কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু বিধি বাম। আমেরিকার অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির ধারা সূচিত হলেও এ প্রবৃদ্ধি নতুন কোনো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারল না। অর্থনীতিবিদরা এ প্রবৃদ্ধির নামকরণ করলেন Jobless growth, কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি। এটাই স্বাভাবিক ছিল। কারণ প্রযুক্তি যে জায়গায় পৌঁছেছে, সে জায়গায় শ্রমশক্তি নিয়োগের প্রয়োজন হয় না।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠিত হয়েছিল অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। এ ইতিহাসটি আলোচনা করতে হলে আরও একটি কলাম লিখতে হবে। আমরা সবাই জানি ইউরোপীয় ইউনিয়ন আছে। তার একটি তারকাখচিত নেভি ব্লু পতাকাও আছে। রয়েছে একক ইউরোপীয় মুদ্রা ‘ইউরো’। বেশ ক’বছর এ ইউনিয়নের সঙ্গে থাকার পর ব্রিটেনবাসী ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার জন্য গণভোটের মাধ্যমে রায় দিলেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া কী হবে তা নিয়ে দরকষাকষি চলল। ব্রিটেনের থেরেসা মের সরকার এখন ব্রেক্সিট নিয়ে মহাসংকটে আছে। ব্রিটেনের অনেকে আবার নতুন গণভোটের দাবি তুলেছেন।
কারণ গণভোটে ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’-এর মধ্যে ব্যবধান বড় ছিল না। এমনকি ব্রিটেনের সব অঞ্চলের ভোটের প্যাটার্নও একরকম ছিল না। অন্যদিকে ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে বিভিন্ন দেশে লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির উন্মেষ ঘটেছে। এরা অনেকে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলগুলোকে নাকানি-চুবানি দিচ্ছে। এ লোকরঞ্জনবাদের চরিত্র মূলত দক্ষিণপন্থী। ফ্যাসিবাদের কাছাকাছি। অর্থাৎ নিজস্ব পরিচয় ও শিকড় সন্ধানের নামে এ রাজনীতির চরিত্র হল বিভিন্ন জাতিবিদ্বেষী। এ জাতিবিদ্বেষ ও ঘৃণার রাজনীতির মূলে রয়েছে অভিবাসী সমস্যা। এমনিতেই ফ্রান্স ও জার্মানির মতো দেশে ভিন্ন দেশ থেকে আসা বিরাটসংখ্যক অভিবাসী রয়েছে, যাদের অনেকে নাগরিকত্বও পেয়েছেন।
কিন্তু জীবনযাত্রার দিক থেকে তারা ফ্রান্স ও জার্মানির আদি বাসিন্দাদের থেকে অনেক পিছিয়ে। এরা দরিদ্রও বটে। গত ক’বছরে গৃহযুদ্ধ ও রাজনৈতিক সংঘাতের ফলে অনেকে সিরিয়া ও লিবিয়াসহ আফ্রিকার অনেক দেশ থেকে ইউরোপ অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে। আমরা মিডিয়ায় ভূমধ্যসাগরের জলরাশিতে জাহাজডুবিতে এদের অনেকের সলিল সমাধির খবর পাই। তারপরও অনেক অভিবাসী ইউরোপে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে। নতুন অভিবাসীদের দেখে ইউরোপের অনেক দেশে জাতিবিদ্বেষী ঘৃণার আগুন জ্বলে উঠেছে। এ সুযোগে ইউরোপের অনেক দেশে নতুন ধরনের এক রাজনীতির সূচনা হয়েছে। এ রাজনীতির ধারক-বাহকরা রাজনৈতিক অঙ্গনের নতুন খেলোয়াড়। এরা খুব সহজে সাধারণ মানুষের সমর্থন অর্জনের জন্য মনসই কথা বলে। এদের বক্তব্যের মূল কথা হল- নিজস্ব আইডেনটিটি বা পরিচয়কে কোনোক্রমেই কলুষিত করা যাবে না। ভিনদেশি যারা আসছে তাদের ঠেকাতে হবে। ‘আমরা’ এবং ‘ওরা’ বলে যে রাজনীতি তৈরি হয় তার মূলে থাকে সব ধরনের ঘৃণা ও বিদ্বেষ।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের পর সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ পেছনে চলে গিয়েছিল। গড়ে উঠেছিল একে অপরকে আলিঙ্গন করে নেয়ার এক আবহ। কিন্তু এখন লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির উত্থানের ফলে ইউরোপের মানুষদের মধ্যে ঘৃণা-বিদ্বেষের দুষ্ট মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে। আগামী মে মাসে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের নির্বাচনে যদি লোকরঞ্জনবাদীদের প্রাধান্য কিংবা বড় ধরনের শক্তি দেখা যায়, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ধারণা সংকটের মুখোমুখি হবে।
তবে লোকরঞ্জনবাদ সম্পর্কে ভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যাও রয়েছে। এ ব্যাখ্যা হাজির করেছেন চ্যাংটাল মুফে নামের একজন অধ্যাপক যিনি রাজনীতি তত্ত্বের ওপর গবেষণা করেন। তার বক্তব্য হল, আমরা এখন পশ্চিম ইউরোপে একটি লোকরঞ্জনবাদী মুহূর্ত দেখতে পাচ্ছি। এর ফলে নব্য উদারনীতিবাদী আধিপত্য সংকটের মধ্যে পড়বে। মূল যুদ্ধটি হবে ডান ও বাম লোকরঞ্জনবাদের মধ্যে। বাম লোকরঞ্জনবাদীরা যদি জনগণ ও গোষ্ঠী চক্রের মধ্যে একটি সীমারেখা স্থাপন করতে পারে এবং আত্মসমর্পণবাদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে নানামুখী সংগ্রামকে সংঘবদ্ধ করতে পারে, তাহলে বাম লোকরঞ্জনবাদের একটি ভবিষ্যৎ আছে।
ইউরোপীয় সমাজে রাজনৈতিক কল্পলোকে গণতান্ত্রিক আলাপ-আলোচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যৌথ ইচ্ছা সৃষ্টির মাধ্যমে এবং সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে পারলে দক্ষিণপন্থী লোকরঞ্জনবাদের বিদ্বেষবাদী নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব হবে। এ লোকরঞ্জনবাদী আন্দোলন নতুন একটি রাজনৈতিক সীমান্ত তৈরি করবে, যা রাজনীতি-উত্তর বছরগুলোর পর রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি করবে। একথা তো সত্য, ইউরোপ-আমেরিকার সাধারণ মানুষ বহু বছর ধরে রাজনীতিবিমুখ হয়ে আছে। তারা ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিস্পৃহ। এটাই রাজনীতি উত্তরকাল। প্রয়োজন নিবিড় গণতান্ত্রিক আলোচনার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে ফিরে যাওয়া। এভাবে রাজনীতিতে ফিরে যাওয়ার ফলে কর্তৃত্ববাদী সমাধানের পথ উন্মুক্ত হয়ে যেতে পারে। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের শাসনের ফলে দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। কিন্তু এটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ইতিবাচক চর্চার পক্ষে নতুন শক্তিও জোগাতে পারে।
আসল কথা হল পুঁজিবাদী, আধিপত্যবাদী রাজনীতি গণতন্ত্রের জন্য সংকট সৃষ্টি করেছে। এ রাজনীতির ছাইভষ্ম বাংলাদেশের ওপরও পড়তে শুরু করেছে। ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা যেমন ভেবেছিলেন, ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটেছে বার্লিন প্রাচীরের পতনের মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ পৃথিবীর নিরন্তর ভবিষ্যৎ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেই। অন্যদিকে এসেছে স্যামুয়েল হান্টিংটনের সভ্যতার দ্বন্দ্বের প্রকল্প। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ প্রকল্প বাস্তবায়নে হাত দিয়েছে। দুনিয়া এখন এ প্রকল্পের চক্করে বিপর্যস্ত। দেখা যাক বাম লোকরঞ্জনবাদ থেকে ভালো কিছু বেরিয়ে আসে কিনা। তবে এ শতাব্দীতে আমাদের এবং আমাদের সন্তানদের জন্য সুখকর কিছু ঘটবে বলে আশা করতে পারছি না। পরবর্তী শতাব্দীতে ভালো কিছু ঘটলেও ঘটতে পারে। হয়তো কোনো মহামানবের আবির্ভাব ঘটবে।
ড. মাহবুব উল্লাহ্ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
