ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটির কি কোনো প্রয়োজন ছিল?
আবদুল লতিফ মাসুম
প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন রয়েছে প্রায় এক দশক। এ সময়টায় মানুষের বাকস্বাধীনতা কতটা খর্ব হয়েছে তা বিবেচনার দাবি রাখে। স্বাধীনতা আর গণতন্ত্র সমার্থক। এই সেদিন খবর বেরিয়েছে গণতন্ত্রের সূচকে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে তাদের মুখে মুখে ছিল স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের বাণী। তারা বলেছিল, স্বাধীনতার স্বাদ ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবে।
মানুষের বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের সর্বশেষ নমুনা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। ২৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রস্তাবিত আইনটির খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। এ ধরনের আইন প্রথম করা হয় ২০০৬ সালে। পরে ২০১৩ সালে শাস্তি বাড়িয়ে সেটিকে আরও কঠোর করা হয়। এবার আইসিটি অ্যাক্ট-২০১৮ আরও কঠিন এবং কঠোরভাবে উপস্থাপিত হল। গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সমালোচনার মুখে সরকার ওই আইনের ৫৭ ধারা বাতিল করে। ৫৭ ধারায় মানহানি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো- ইত্যাদি বিষয় সন্নিবেশিত ছিল। এখন ওইসব বিষয়ই আছে। তবে বিষয়গুলো ভিন্ন ভিন্নভাবে উল্লেখ করে। এছাড়া অনুমোদিত আইনের খসড়ায় কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরসংক্রান্ত ৩২ ধারায় আইনটি আরও কঠোর করা হয়েছে। ওই আইনের খসড়ায় মোট ৬৩টি ধারায় সাইবার অপরাধসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় রাখা হয়েছে। আইন অনুযায়ী ১১ সদস্যের ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এর প্রধান। প্রণীত আইনটিকে সংশ্লিষ্ট মহল ‘নতুন করে পুরনো ঘটনা’ বলে উল্লেখ করেছেন।
আইনটি যারা প্রণয়ন করেছেন তারা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের মানুষের স্মৃতিশক্তি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। তা না হলে বিতর্কিত এবং নিপীড়নমূলক ধারাগুলো ঘুরেফিরে আবার সংযোজিত হতো না। ডিজিটাল আইন সম্পর্কে দেশের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার প্রবক্তা সুলতানা কামাল বলেছেন, ‘আইনের খসড়াটি পড়ে মনে হয় না কোনো মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। আগে একটি ধারায় ছিল, এখন বিভিন্ন ধারায় ভাগ করে দেয়া হয়েছে। এতে সাংবাদিকসহ যে কোনো মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহারের সুযোগ থাকছে। আগে যেমন অপব্যবহার হওয়ার সুযোগ ছিল তা রয়েই গেছে। রাষ্ট্র বাকস্বাধীনতার পক্ষে কোনো পরিষ্কার অবস্থান নেয়নি।’ ইতিমধ্যে আইনটি নিয়ে গণমাধ্যমসহ সর্বস্তরে সমালোচনা শুরু হয়েছে। ড. কামাল হোসেন আইনটি পুনর্বিবেচনার উদ্যোগ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানান। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ৩২ ধারা যেভাবে আছে সেভাবে থাকলে অনুসন্ধানী রিপোর্ট বা বিশেষ রিপোর্ট অসম্ভব হয়ে পড়বে। আর এ ধরনের রিপোর্ট না থাকলে সরকারের জবাবদিহিতার জায়গাটিও বন্ধ হয়ে যাবে।’ তিনি মন্তব্য করেন, এ ধরনের আইন করা হয় সংবাদমাধ্যমকে পঙ্গু করে দেয়ার জন্য। গণমাধ্যমে মতামত এসেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খড়্গ যে শুধু সাংবাদিকতার ওপর নামছে তা নয়, এটি পুরো সমাজেরই মুক্তচিন্তা এবং স্বাধীন মতপ্রকাশের পথে বাধার সৃষ্টি করবে। প্রস্তাবনাটি প্রকাশিত হওয়ার পর সাংবাদিক সমাজের সব মত ও পক্ষ এ আইনটি প্রত্যাহারের দাবি করেছে। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি বলেছেন, আইনটি সংসদে পাস করার আগে সাংবাদিক প্রতিনিধি, শিক্ষক ও মানবাধিকার কর্মীদের মতামত নেয়া উচিত।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এর খসড়ায় বলা হয়েছে, এ আইন কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইসিটি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা বিলুপ্ত হবে। বাতিল হয়ে যাওয়া আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহলে এ কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে। এ অপরাধে সর্বোচ্চ ১৪ বছর ও সর্বনিন্ম ৭ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেয়ার বিধান আছে। পরিবর্তিত আইনে ৫৭ ধারার এ বিষয়গুলো ২৫, ২৮, ২৯ এবং ৩১ ধারায় ভাগ করে রাখা হয়েছে। ২৫ ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে ইচ্ছাকৃতভাবে আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শন করার মতো তথ্য সম্প্রচার বা প্রকাশ করতে পারবেন না। রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ণ করার বা বিভ্রান্তি ছড়ানোর উদ্দেশ্যে কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ করলে তা অপরাধ হবে। সংযোজিত ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করলে তা অপরাধ হবে। ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে মানহানিসংক্রান্ত দণ্ডবিধির (১৮৬০) সেকশন ৪৯৯-এ বর্ণিত অপরাধ করলে তিনি দণ্ডিত হবেন। ৩১ ধারা অনুযায়ী, বিভিন্ন শ্রেণী বা সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার মতো উপাদান থাকলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে। বর্ণিত উপরোক্ত ধারাগুলোতে অপরাধের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রচারণা চালালে বা তাতে মদদ দিলে সেটি অপরাধ বলে গণ্য হবে। এ অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। সবচেয়ে আলোচিত ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি-আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে ধারণ-প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন তাহলে সেই কাজ হবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ।
আইনটি যথার্থভাবে পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হবে যে, নতুন করে ৫৭ ধারা কায়দা-কৌশলে পুনঃস্থাপিত হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে এ আইনের বিরুদ্ধে গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ যে আন্দোলন করেছে, তার প্রতিফল কোনোভাবেই পরিদৃষ্ট হচ্ছে না। যথা পূর্বং তথা পরং। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বিষয়টি গোপন করেননি। তিনি ব্যাখ্যায় বলেন, ‘৫৭ ধারায় সব বিষয় সংক্ষেপে একসঙ্গে লেখা ছিল। এখন যে প্রকৃতির অপরাধ, ধারা অনুযায়ী সে রকম শাস্তি হবে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরও নিশ্চিত করেন, ইতিপূর্বে ৫৭ ধারায় দায়েরকৃত মামলাগুলো আগের মতোই চলবে।’ উল্লেখ্য, আগের ৫৭ ধারায় সাংবাদিক, প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ অসংখ্য মানুষ হয়রানির শিকার হয়েছে। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে পুলিশ সদর দফতরের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, জানুয়ারিতে আইসিটি আইনে ৪২টি মামলা হয়। জুনে তা বেড়ে হয় ৭৯টি। পরবর্তী ৬ মাসে মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫১। ওইসব মামলার বেশিরভাগই ৫৭ ধারা মোতাবেক করা হয়। ওই সময়ে সংবাদপত্রের সব পক্ষ এবং সিভিল সোসাইটির তীব্র প্রতিবাদের মুখে ৫৭ ধারা বাতিলের অঙ্গীকার করা হয়। কার্যত তা না করে এখন আরও কঠোরভাবে আইনটি প্রয়োগের চেষ্টা চলছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে প্রশ্নোত্তরে এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এ আইন দ্বারা সাংবাদিকতা কঠিন হয়ে পড়বে। এক সময় জাতে ওঠার জন্য সরকার তথ্য কমিশন গঠন করেছিল। এ আইনের দ্বারা লেখক, সাংবাদিক, গবেষক, তথা সুশীল সমাজের কার্যক্রম একরকম অচল হয়ে পড়বে। নির্বাচনের বছরে মূলত এ আইনটি যে বিরোধী পক্ষ দমনের জন্য ব্যবহৃত হবে অতীতের রেকর্ড এবং বর্তমান মামলার হিড়িক তার প্রমাণ বহন করে। এ আইনের দ্বারা যে কোনো ব্যক্তিকে যে কোনো সময়ে ফাঁসানোর সুযোগ রয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদকে নিরেট সত্য কথাটি বলার জন্য ধন্যবাদ। তিনি বলেছেন, ‘মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত খসড়া অনুমোদন পাওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ করে সাংবাদিকদের দমিয়ে রাখা যাবে না এবং সে কারণে আইনটি করা হয়নি বরং সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে বানোয়াট সংবাদ বন্ধ করতেই ডিজিটাল আইন করা হয়েছে।’
তাহলে বোঝা যাচ্ছে, আওয়ামী এমপিদের বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতো এ আইন বাস্তবায়িত হলে তা আর সম্ভব হবে না। খসড়া আইনের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য এবং প্রতিটি ধারা সংবিধানে বর্ণিত নাগরিক অধিকারের তথা মৌলিক স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপের প্রয়াস। ক্রমেই সংকুচিত স্বাধীনতা যাতে আরও সংকুচিত না হয়, তা নিশ্চিত করা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য।
আবদুল লতিফ মাসুম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
