Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি মধ্যবিত্তের জীবন

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি মধ্যবিত্তের জীবন

ব্যাংকে কত টাকা রাখলে ৪ জনের একটা মধ্যবিত্ত পরিবার মোটামুটি খেয়ে-পরে চলতে পারে? প্রশ্নটি তুলেছি তার কারণ আছে। কিছুদিন আগে আমার পরিচিত এক মধ্যবয়স্ক ছেলে হঠাৎ বাসায় এসে হাজির। সে আমার সাহায্য চায়। একটা চাকরির জন্য। আমি তো অবাক। তুমি চাকরি খুঁজছ কেন, তুমি তো একটা ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে।

ও বলল, ঠিকই বলেছেন স্যার। কিন্তু সেই চাকরিটি আর নেই। বাধ্য হয়ে চাকরিটি ছাড়তে হয়েছে। নতুবা চাকরিচ্যুত হতে হতো। তাহলে তো আর কোথাও চাকরি পেতাম না। এই বলে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

ওর সংসার- স্ত্রী, দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে। বয়স হবে ৫০-এর মতো। ছেলেটি অনার্স পড়ে, মেয়েটি ছোট। ভীষণ বিপাকে পড়েছে সে। সঞ্চয় খুব বেশি নেই যে তা দিয়ে চলতে পারে। চাকরি ছাড়ার সময় যে টাকা পেয়েছে তা খুবই সামান্য। ঘর ভাড়াতেই চলে যায় ৩০ হাজার টাকা। আগে অসুবিধা খুব একটা হতো না। ৮০-৯০ হাজার টাকার একটা চাকরি করত।

বাড়ি থেকেও কোনো সাহায্য পাওয়া সম্ভব নয়। বাড়িতে বুড়ো বাবা-মা। তারা দেশের বাড়ির একটা আয় দিয়ে চলে। ও আগে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করত। সেটি এখন বন্ধ। এ অবস্থা শুনে আমি লা-জওয়াব। কাকে বলব, কাকে অনুরোধ করব বুঝতে পারছি না।

প্রভাবশালী লোক ছাড়া কেউ কারও কথা শুনতে চায় না। তবু আমি তার জীবনবৃত্তান্তটি রাখলাম। শত হোক মুখের ওপর নেতিবাচক কিছু বললে মানুষের দুর্দিনে- মানুষ বড় কষ্ট পায়। আর আমি তা পারিও না।

জীবনবৃত্তান্তটি পড়ে পড়ে ভাবছিলাম অর্থনীতির অবস্থা কী? দেশের উন্নতি হচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ, ঘরবাড়ি, দালানকোঠা চারদিকে। এর মধ্যে চাকরিহীনতা। পাওয়া চাকরি নেই। বেকারত্ব থেকে কর্মহীন জীবন। এখন রাস্তায়। তাও মধ্যবয়সে।

এই অবস্থায় কে দেখবে এসব লোককে? রাষ্ট্রের এমন কোনো ব্যবস্থা নেই। বেকার অথবা চাকরিচ্যুত লোকদের দেখাশোনার কোনো ব্যবস্থা নেই। আবার মধ্যবয়সে আমাদের দেশে চাকরি জোগাড় করাও কঠিন। একমাত্র বাঁচোয়া ব্যবস্থা হচ্ছে সঞ্চয়। ভালো সঞ্চয় থাকলে তার থেকে সুদ/লভ্যাংশ দিয়ে সংসার দুঃখ-কষ্টের মধ্যে চালানো যায়। কিন্তু কত সঞ্চয়?

এক সময় অল্প সঞ্চয়ে, অল্প টাকা বিনিয়োগে ডাল-ভাত খাওয়া যেত। এখন আর তা সম্ভব নয়। এখন টাকার কাঁড়ি থাকলেও চলে না। সেই জন্যই নিবন্ধটির প্রথমে প্রশ্ন তুলেছি কত টাকা ব্যাংকে থাকলে ৪ জনের একটা ছোট সংসার চলে, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া চলে, ঘর ভাড়ার খরচ সংগ্রহ হয়, কাঁচাবাজার চলে। এর একটা হিসাব দিলে মাথা খারাপ হয়ে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা তথ্যে দেখা যায়, ব্যাংকিং খাতে গড় সুদ ২০১৮ সালে ছিল মাত্র ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। যদি কারও এক কোটি টাকা থাকে তাহলে বছরে সুদ পাওয়া যাবে মাত্র ৫ লাখ ২৬ হাজার টাকা। সরকার অগ্রিম আয়কর হিসেবে কেটে নেবে ১০ শতাংশ। কিন্তু ‘টিআইএন’ না থাকলে কাটবে ১৫ শতাংশ। আমরা ১০ শতাংশ হিসাবেই যাই। এতে ‘অগ্রিম আয়কর’ ব্যাংক কাটবে ৫২ হাজার ৬০০ টাকা।

অতএব, সর্বসাকুল্যে পাওয়া যাবে বছরে মাত্র ৪ লাখ ৭৩ হাজার ৪০০ টাকা। মাসে হয় ৩৪ হাজার ৪৫০। সুদের হার যদি ৭ শতাংশও ধরি তাহলে মাসে আসে ৫২ হাজার ৫০০। ব্যাংকিং খাতের গড় সুদের হারের চেয়ে একটু বেশি। মনে রাখা দরকার এক কোটি টাকা মেয়াদি আমানত রাখলে মাসে মোটামুটি ৫০ হাজার টাকা। এই টাকায় কী একটি মধ্যবিত্ত পরিবার চলতে পারবে?

আমি যে অফিসারটির কথা নিবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করলাম তাদের মতো মধ্যবিত্তের বাড়ি ভাড়াই লাগবে কমপক্ষে ২৫-৩০ হাজার। দুই ছেলেমেয়ের শিক্ষাতেই মাসে যাবে কমপক্ষে ১০-১৫ হাজার। গাড়ি থাকলে ড্রাইভারের বেতনই হবে মাসিক কমপক্ষে ১৫ হাজার। তেল খরচ, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ লাগবে। কাঁচাবাজার, মাছ-মাংসের খরচ আছে। চিকিৎসার খরচ আছে। সব যোগ করলে কত টাকা হয়? দেখা যাবে এক কোটি টাকার সঞ্চয় দিয়েও সংসার চালানো সম্ভব নয়।

অথচ কয়জনের পক্ষে এক কোটি টাকার মেয়াদি আমানত করা সম্ভব? খুব কম লোকই হবে। কেউ কেউ আরও কম সঞ্চয় দিয়ে তাই নানা ধরনের সঞ্চয়পত্র কিনে। পারিবারিক সঞ্চয়পত্র, ৫ বছরী সঞ্চয়পত্র, তিন বছরী ত্রৈমাসিক সুদ প্রদায়ী সঞ্চয়পত্র ইত্যাদি। এতে সুদের হার একটু বেশি। কিন্তু এসব অফুরন্ত কেনা যায় না। প্রত্যেকটির সিলিং দেয়া আছে।

উল্লেখিত তিন ধরনের সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে সর্বমোট এক কোটি ৫ লাখের মতো। প্রশ্ন এখানেও, কয়জনের এই পরিমাণ সঞ্চয় আছে? আবার প্রশ্ন, এ সবের ওপর সুদের হার কমানোর জন্য সরকারের ওপর চাপ আছে। আমানতের ওপর সুদের হার যা তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে সুদের হার পুনঃনির্ধারণের কথা হচ্ছে।

তাহলেই দেখা যাচ্ছে কী ব্যাংক আমানত, কী সঞ্চয়পত্র কোনোটাই বিশাল পরিমাণের না হলে অবসর জীবনের সংসার চলবে না। চলবে না চাকরিচ্যুতদের জীবন। বলাবাহুল্য এই সমস্যাটি এখন সমাজে একটা অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করছে। কারণ দেখাই যাচ্ছে একমাত্র সরকারি চাকরি ছাড়া আর কোথাও শান্তি নেই।

এক সময় বেসরকারি খাতে চাকরি করলে মালিকরা আমৃত্যু দেখতেন। এমনকি গ্রামের যে সব বড় মহাজন শ্রেণীর ব্যবসায়ী ছিলেন, তারা তাদের কর্মচারীদের আজীবন দেখাশোনা করতেন। অনেকে তো তাদের পরিবারের অংশ বলেই মনে করতেন।

শহরেও দেখেছি, দেখেছি আজ থেকে ২০-৩০ বছর আগেও কোম্পানির মালিকরা কারও চাকরি খেতেন না। কর্মচারীরাও বিশ্বস্ততার সঙ্গে সেবা দিয়ে যেতেন। আমি একটি পরিবারের কথা জানি। চাকরিরত অবস্থায় ভদ্রলোক মারা গেলে মালিক এই কর্মচারীর ‘শ্রাদ্ধের’ টাকা দিয়েছেন; মৃত কর্মচারীর এক ছেলেকে ওই কোম্পানিতে চাকরি দেয়া হয়েছে।

আজকে এ অবস্থা নেই। আজকে সরকারি চাকরি হচ্ছে সবচেয়ে লোভনীয়। সেখানে আজ বাড়ি করার জন্য ঋণ আছে স্বল্প সুদে, গাড়ি আছে এবং তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসে প্রচুর টাকা আছে। ঘন ঘন পদোন্নতির সুযোগ আছে।

বেসরকারি খাতের সব সুযোগ-সুবিধা তারা পাচ্ছে। আর চাকরি? আসলে-গেলে বেতন পাই, কাজ করলে ‘ওভারটাইম’ পাই। স্কুলে যেতে হয় না, হাসপাতালে যেতে হয় না, অফিসে যেতে হয় না। এসব খবর প্রতিদিন খবরের কাগজে ছাপা হচ্ছে।

অন্যদিকে বেসরকারি খাতের চাকরি হয়ে পড়েছে একটা অনিশ্চিত বিষয়। নীরবে সারা দেশে প্রতি বছর হাজার হাজার লোকের চাকরি যাচ্ছে। একটা বড় সংগঠিত খাতের খবর কিছুদিন আগে কাগজে ছাপা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে ২০১৭ সালে সেই খাতে ৯ হাজার লোকের চাকরি গেছে। স্টেক-কোম্পানিগুলোতে নিয়মিত চাকরি যায়।

বড় বড় বেসরকারি খাতের কোম্পানিতে এখন কম টাকার চাকরি হয়। বেশি বেতনের লোকের চাকরি যায়। ওই স্থলে ঢুকে কম বেতনের চাকরিজীবী। অনেক চাকরি হয়ে গেছে চুক্তিভিত্তিক, তাও আবার ‘আউটসোর্সিং’ করা হয়।

বলা হচ্ছে, মুনাফার জন্যই এসব করা হচ্ছে। চাকরি যাচ্ছে গার্মেন্টস খাতেও। সেখানে ‘রোবট’ বসছে। একটা স্টাডিতে দেখা যাচ্ছে, আগামীদিনে গার্মেন্টস খাতে কয়েক লাখ লোকের চাকরি যাবে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে কী? সরকারের চাকরি পোক্ত হচ্ছে, সেখানে সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে, বেতন দ্বিগুণ হচ্ছে, ইলিশ খাওয়ার জন্যও বোনাস দেয়া হচ্ছে।

আর বেসরকারি খাতের চাকরি হয়ে যাচ্ছে চরম অনিশ্চয়তাপূর্ণ। কার চাকরি কখন যায় এ হচ্ছে অবস্থা। অথচ বেসরকারি খাতই এখন সবচেয়ে বড় খাত। সেখানকার এ অবস্থা সমাজকে ধীরে ধীরে অস্থির করে তুলছে।

আগে কিছু ছেলেমেয়ে বিদেশে যেতে পারত। বিলাত, আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশে যাওয়ার সুযোগ ছিল। এখন তা ধীরে ধীরে সংকুচিত হচ্ছে। থাকতে হয় দেশেই থাকতে হবে। কিন্তু কর্মসংস্থান কোথায়? ‘টেকনোলজি’ভিত্তিক বড় বিনিয়োগ হওয়ায় কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে।

একদিকে নতুন চাকরি সেভাবে হচ্ছে না, অন্যদিকে যখন-তখন মানুষের চাকরি যাচ্ছে। মানুষের সঞ্চয় কোত্থেকে আসবে? সংসারই চলে না, আবার সঞ্চয়! অথচ দেখা যাচ্ছে প্রচুর পরিমাণে সঞ্চয় না থাকলে অবসর জীবন অথবা চাকরিচ্যুত জীবনযাপন করা এক কঠিন বিষয় হয়ে যাচ্ছে।

যারা পুরনো মধ্যবিত্ত, ঢাকায় এসেছে আগে, তাদের কেউ কেউ হয়তো কিছুদিন চলতে পারবে। হয়তো তাদের কেউ কেউ একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট কিনেছে। তাদের বাড়ি ভাড়া লাগে না। অনেকে বাবার অথবা শ্বশুরের কাছ থেকে হয়তো ফ্ল্যাট পেয়েছে। তারা হয়তো কিছুটা স্বস্তিতে আছে। কিন্তু যারা ঢাকায় এসেছে নতুন, এসেছে চাকরি পেয়ে নতুনভাবে- তাদের হাল কী হবে? তারা একটা ফ্ল্যাট কিনবে কীভাবে? কত টাকা লাগে একটা ফ্ল্যাট কিনতে? সেই সঞ্চয় কোথায়? আর জমি?

জমি- যারা পাকিস্তান আমলে চাকরি করত তারা পেয়েছে বা ক্রয় করেছে। সরকারের বড় বড় কর্মকর্তা সরকার থেকে বস্তুত বিনামূল্যে জমি পায়। আর বাকিরা? বাকিরা কোটি কোটি টাকা খরচ করে কোত্থেকে জমি কিনবে? তাহলে দেখা যাচ্ছে জমি নেই, ফ্ল্যাট নেই, চাকরি নেই, চাকরিচ্যুত মধ্যবিত্তের জীবন এক কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন। কোটি টাকা, দুই কোটি টাকা সঞ্চয় থাকলেও মধ্যবিত্তের সংসার এখন চলে না। নিবন্ধের শুরুতে যে মধ্যবয়সী চাকরিচ্যুতের কথা বললাম, এটা কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা?

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মধ্যবিত্ত চাকরি ফ্ল্যাট

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম