Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের মাঝে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি

Icon

ড. দেলোয়ার হোসেন

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের মাঝে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি

পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটা শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে। আমরা জানি, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে একটা সোচ্চার অবস্থানও রয়েছে বাংলাদেশের। অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি মূল স্তম্ভ ছিল বহুপাক্ষিক সহযোগিতার বিষয়টি।

বাংলাদেশ একসময় সার্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেও এ ধরনের সহযোগিতার চেষ্টা করেছে। বিমসটেক এবং বিসিআইএম (বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার) ইকোনমিক করিডোরের মাধ্যমেও অনেক দিন ধরে এ চেষ্টা করে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে এ আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সংস্থাগুলো সবসময় অতটা কার্যকর নয়। আমরা জানি, আঞ্চলিক শক্তিগুলো তাদের নানা কৌশলগত কারণে এগুলোর গুরুত্বকে অবহেলা করে।

আমরা যদি চীন, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্য রাষ্ট্রগুলোর দিকে দৃষ্টি দেই, তাহলে দেখতে পাই তারা অনেকটা দ্বিপাক্ষিক উপায়ে তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য বহুপাক্ষিক যে কাঠামো, সেই কাঠামোর অংশ হিসেবে এ উপআঞ্চলিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতাকে গুরুত্ব দেয়া উচিত। আর এ কারণে উপআঞ্চলিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়টিকে কার্যকর করা এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে এগুলোর গুরুত্ব যেন কোনোভাবেই হারিয়ে না যায়, সেদিকে লক্ষ রেখে এগোতে হবে আমাদের। গত ১০ বছরে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রসহ বৃহৎ শক্তিগুলোর সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। আমরা জানি, বাংলাদেশের একদিকে যেমন প্রাচ্যমুখিতা আছে, তেমনি পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গেও আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত শক্তিশালী।

আসিয়ানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করা উচিত। এআরএফের (আসিয়ান রিজিওনাল ফোরাম) সঙ্গে বাংলাদেশের একটা সম্পর্ক আছে। কিন্তু আসিয়ানের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একটা শক্তিশালী অবস্থান এখনও আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। বাংলাদেশ আসিয়ানের একটা ডায়ালগ পার্টনার হওয়ার চেষ্টা করছে। সেটা এখনও হয়নি। কিন্তু সেটা করা উচিত। কারণ আসিয়ানকে যদি আমরা কাছে পাই, তাহলে ভারতসহ অন্যান্য রাষ্ট্রের ওপর একটা চাপ সৃষ্টি হবে।

আমাদের শুধু সার্ক, বিমসটেক ও বিসিআইএমের ওপর নির্ভর করে বসে থাকা কোনোভাবেই উচিত হবে না। কেননা এগুলো সবসময় অতটা কার্যকর প্রভাব রাখতে পারেনি, যদিও এগুলোকে কার্যকর করাও আমাদের অন্যতম উদ্দেশ্য। এর পাশাপাশি আমরা যদি আসিয়ানসহ আরও কিছু আঞ্চলিক সংস্থার সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করি, তাহলে তার সুবিধাও আমরা পাব। কারণ আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান উদ্দেশ্য সবসময়ই বহুপাক্ষিক কূটনীতিকে ব্যবহার করা। আর এর মাধ্যমেই বাংলাদেশের যে ন্যায্য দাবিগুলো রয়েছে, সেগুলোকে আমরা অনেক কার্যকরভাবে উপস্থাপন করতে পারি, যা দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে করা অনেকটা জটিল। সুতরাং এ বিষয়গুলোকে আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।

ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের একটা নতুন মাত্রা তৈরি করা প্রয়োজন। অবশ্য ইতিমধ্যেই দুই দেশের সম্পর্ক অত্যন্ত শক্তিশালী হয়েছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের একটি নতুন দিক হচ্ছে, দিল্লিতে শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তন সত্ত্বেও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের কোনো টানাপোড়েন হয়নি, সম্পর্কের কোনো অবনতি হয়নি- যেটা আগে কখনও দেখা যায়নি। বিজেপি সরকার ২০১৪ সাল থেকে ক্ষমতায় আছে। কংগ্রেস সরকারের আমলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কোন্নয়নের মূল কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। বিজেপি সরকার বাংলাদেশ-ভারতের সে সম্পর্ককে টেনে সামনে নিয়ে গেছে এবং একে আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছে।

২০১৯ সালের মে মাসে ভারতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচনে বিজেপি নাকি কংগ্রেস কারা ক্ষমতায় আসবে, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা থাকলেও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ নিয়ে কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ নেই। অর্থাৎ ভারতের নির্বাচনে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, আমরা নিশ্চিত করেই বলতে পারি, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে এর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি আমাদের একটি বড় অর্জন। এ অর্জনকে আমাদের কাজে লাগানো প্রয়োজন। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির ক্ষেত্রে আমাদের আরও মনোযোগী হতে হবে। ভারতের সঙ্গে আমাদের জ্বালানি সহযোগিতা বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। এ অঞ্চলে আমাদের কানেকটিভিটি বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারত ও নেপালের মধ্যে মোটর ভেহিকল চুক্তি (২০১৫) হয়েছে। যদিও এ চুক্তি থেকে ভুটান কিছুটা সরে এসেছে, তবুও এটি নিয়ে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আরও একটি বড় দিক হচ্ছে, উত্তর-পূর্ব ভারত, ভুটান ও নেপাল- এ অঞ্চলটিকে একটা অর্থনৈতিক অঞ্চল বা উন্নয়ন অঞ্চল হিসেবে চিন্তা করা। এতে করে একদিকে আমাদের পণ্যের যেমন একটি বাজার তৈরি হবে, সেই সঙ্গে এ দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগও বাড়বে। নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভালো। কিন্তু এর পরিমাণ খুবই কম। আমাদের দেশের অনেক পণ্যই এ দেশগুলোতে রফতানি করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সেই সুযোগটি তৈরি হবে যদি আমরা ভারতকে সঙ্গে নিয়ে এ রকম একটা অর্থনৈতিক অঞ্চল কার্যকরভাবে তৈরি করতে পারি। এর কোনো বিকল্প নেই।

কারণ ভারত আমাদের সঙ্গে যে রকমভাবে সহযোগিতা চাচ্ছে এবং কানেকটিভিটির কথা বলছে, সেটি শুধু দ্বিপাক্ষিক বিষয়ের ওপর নির্ভর না করে বহুপাক্ষিক ও আঞ্চলিক বিষয়কে মাথায় রেখেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এ নিয়ে ভারতের আগ্রহ কম থাকতে পারে, তবে এ বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশকে অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।

পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কখনোই বড় ধরনের কোনো হুমকির মধ্যে পড়েনি। তারপরও আমার মনে হয়, পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন। পশ্চিমা দেশগুলো, জাতিসংঘ এবং আমাদের উন্নয়ন অংশীদাররাও বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) অর্জন করার জন্য আরও সহযোগিতার প্রয়োজন আছে।

আসলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন না ঘটলে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বলি আর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল বলি, কোনো লক্ষ্যই অর্জন করা সম্ভব হবে না। এ সবকিছু বিবেচনা করলে বিশ্বরাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটছে এবং নতুন করে অনেক মেরুকরণ হচ্ছে, নতুন নতুন ইস্যু তৈরি হচ্ছে, নতুন নতুন নেতৃত্ব আসছে। যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বরাজনীতিতে একটা নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছেন। তার পলিসি দেখে কখনও কখনও মনে হয় তারা বিচ্ছিন্নতাবাদের দিকে যাচ্ছেন, আবার কখনও তারা সেখান থেকে সরে এসে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। এ রকম পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব নিয়ে তাদের দেশের ভেতরেই প্রশ্ন উঠছে। দেশের বাইরে তো আছেই। এ ধরনের নেতৃত্বের ফলে বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা আরও বেশি শক্তিশালী হচ্ছে।

এই শক্তিশালী বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশকে সব দেশের সঙ্গেই এক ধরনের হিসাব-নিকাশ করে চলতে হবে এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশ নিজেও একটা বড় ধরনের আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। কারণ জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম অবস্থানে রয়েছে। এ বিশাল জনসংখ্যা আমাদের জন্য একটা বিশাল শক্তি। ইতিমধ্যে বিশ্বে আমরা ৩১তম অর্থনৈতিক দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছি। ২০৩৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২১তম বৃহৎ অর্থনৈতিক দেশ। এই যে সম্ভাবনা ও বাস্তবতা- এ দুটিই আমাদের অনুকূলে রয়েছে। সুতরাং নতুন একটা অর্থনীতি, নতুন একটা পররাষ্ট্রনীতির মধ্য দিয়ে সম্ভাবনার একটি বাংলাদেশ নিয়ে আমরা ভাবতে পারি। এ সম্ভাবনাকে আরও এগিয়ে নেয়ার জন্য পররাষ্ট্রনীতিতে আমাদের অর্জনগুলোকে সুসংহত করা এবং আমাদের যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে সেগুলো মোকাবেলা করা অত্যন্ত জরুরি। পররাষ্ট্রনীতিতে আমাদের যে সক্রিয়তা ও সক্ষমতা, সেটিকেও ধরে রাখতে হবে। পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে অভ্যন্তরীণ নীতির একটা সম্পর্ক আছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা এবং একটি শান্তিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা আমাদের পররাষ্ট্রনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে, আরও গতিশীল করবে। এ গতিশীলতাকে সামনে এগিয়ে নিতে বর্তমান সরকার তার তৃতীয় মেয়াদেও কাজ করে যাচ্ছে।

জঙ্গিবাদ মোকাবেলার বিষয়টিও আমাদের পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। দেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূল করাও বাংলাদেশের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা অভ্যন্তরীণভাবে অনেকটা সফল। হলি আর্টিজান ঘটনার ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ অনেকভাবে সমালোচনার মুখে পড়ার কারণে একটা ইমেজ সংকটে পড়েছিল। এ ইমেজ সংকট থেকে বাংলাদেশ অনেকটা বেরিয়ে আসতে পেরেছে। আমরা লক্ষ করেছি, হলি আর্টিজানে যারা হামলা করেছিল, তাদের শুধু চিহ্নিত করা বা বিচারের আওতায় আনা হয়নি, এর পাশাপাশি এ ধরনের ঘটনা যেন বাংলাদেশে আর না ঘটে সেটিও অনেকটা নিশ্চিত করা হয়েছে। জঙ্গিবাদ নিয়ে বাংলাদেশের যে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি, সেটি এ ব্যাপারে অনেকটা ভূমিকা রেখেছে। তবে জঙ্গিবাদ যে পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে না বা আমাদের জন্য মাথাব্যথার কারণ হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সমগ্র বিশ্বই এ ধরনের হুমকির মধ্যে রয়েছে। যদিও আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাক- এ অঞ্চলগুলোয় আইএসের অস্তিত্ব অনেকটা নির্মূল করা হয়েছে, তারপরও এ বিষয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশকেই সদা সতর্ক থাকতে হবে।

সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ একটা সম্ভাবনার দিকে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে আমরা একটা চ্যালেঞ্জিং সময়ের মধ্যে আছি। বিশ্বরাজনীতিও একটা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সেই রূপান্তরের ভেতরে আমাদের পররাষ্ট্রনীতিকে আরও কার্যকর করে এবং এর সঠিক বাস্তবায়ন ঘটিয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়া আমাদের জন্য খুব জরুরি। আমাদের আগামীর সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগাতে হলে অবশ্যই এ বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনতে হবে।

ড. দেলোয়ার হোসেন : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

delwar@duir.ac.bd

পররাষ্ট্রনীতি

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম